ভালো নেই কুমিল্লা নগরীর ৫০হাজার শিক্ষার্থী

 

আবদুল্লাহ আল মারুফ।।

কুমিল্লা নগরীতে অবস্থানরত প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী ভালো নেই। ২৮ টাকার মিলের খাবার ৪৮ টাকা হয়েছে।দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে একদিকে টিউশন থেকে বিদায় করে দেয়া, অন্যদিকে কম খেয়ে শিক্ষার্থীদের দিন কাটাতে হচ্ছে। এতে তাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা।

একাধিক মেস পরিচালক, পুরনো মেস সদস্য, ভবন মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লা শহরে হাজার খানেক মেস রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মেস আছে কুমিল্লার ধর্মপুর, ঠাকুরপাড়া, টমছমব্রিজ, কান্দিরপাড়, চর্থা, সালাউদ্দিন মোড, চৌধুরীপাড়া, ঢুলিপাড়া, পুলিশ লাইনস্, ঝাউতলা, দৌলতপুর, কোটবাড়ি, বিশ্বরোড এলাকায়। এই এলাকা গুলোর অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। শিক্ষার্থীরা হচ্ছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ,কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়,কুমিল্লা সরকারি কলেজ, চক বাজার আলিয়া মাদ্রাসা,কুমিল্লা মহিলা কলেজসহ ১০/১২টি বেসরকারি স্কুল কলেজের।

 

তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পূর্বে যারা ৩টি অথবা তার বেশি টিউশনি করতো অনেকেই এখন একটি বা দুইটি করছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে টিউশনের বেতন না দিতে পেরে যেসব বাসায় টিউশন করতেন সেসব বাসা থেকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে নিষেধ করে দিচ্ছেন। একদিকে মেসের অতিরিক্ত খরচ অন্যদিকে টিউশন বন্ধ করে দেয়া। এসব কারণে অনেক শিক্ষার্থী শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। আবার অনেকে মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যেও কোন মতে শহরে খেয়ে না খেয়ে পড়ে রয়েছেন।

আলিমুল হক আজাদ। গ্রামের বাড়ি শহরের পাশে হলেও পড়ার সুবিধার্থে গত ছয় বছর ধরে কুমিল্লা শহরে থাকছেন তিনি। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। টিউশনি করে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা, পরিবারের বড় হিসেবে ছোটদের আবদার রেখে তার হাত খরচ থাকেনা বললেই চলে। তার ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মাথায় হাত পড়েছে।

তিনি জানিয়েছেন, পূর্বের খাবারের তুলনায় বর্তমানে ৪০ শতাংশের বেশি খাবার তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি। আগে মাসের আটটি বাজারের চারটিতে মুরগি থাকতো, দুইটিতে গরুর মাংস, দুইটিতে মাছ ও ডিম থাকতো। কিন্তু এখন সেগুলো ভাবাও যায়না। এখন দুইটিতে মুরগি আর বাকি গুলোতে মাছ, ডিম ও সবজি দিয়ে কোনরকম চালিয়ে নিতে হয়। তারপরেও মিল রেট২৮ থেকে ৪৫ থেকে ৫০টাকা পর্যন্ত উঠে যায়।

মো. জাহিদুল ইসলাম হৃদয়। গত তিন বছর ধরে কুমিল্লা শহরের ঠাকুরপাড়া এলাকার একটি মেসে থাকেন। দুইটি টিউশন করে তার পড়াশোনাসহ আনুসাঙ্গিক খরচ চালাতেন। টিউশনি থেকে পেতেন ৪ হাজার টাকা। এতে কোনরকম চলতো। এখন তার যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা। হুট করে একটি টিউশন থেকে নিষেধ করে দিলে তিনি আরও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন।
তিনি জানিয়েছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বদলে গেছে তার জীবনমান। গত তিন মাস আগেও মেসের মিল রেট (প্রতিবেলা খাবারের হিসাব) ছিল ২৮ টাকা। কিন্তু এখন তা বাড়তে বাড়তে গিয়ে থেমেছে ৪৮ টাকায়। অনেক শিক্ষার্থী সেকারণে তিন বেলার খাবার না খেয়ে দুই বেলা খাচ্ছেন। আবার অনেকে সকালে নাশতা আর বিকেলে ভাত খেয়েই সারাদিন পার করছেন।

আর্থিক সংকটে পড়ে শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া সাইফুল ইসলাম তানজিদ বলেন, অবস্থা কতটা খারাপ বলে বুঝানো যাবে না। দুইটা টিউশন ছিল। পরে একটা নিষেধ করে দেয়াতে একটা দিয়ে কোন মতে চলছিলাম। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। কদিন না খেয়ে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। পরে মা গিয়ে শহর থেকে আমাকে গ্রামে নিয়ে এসেছে। হুট করে সব কিছুর দাম বাড়ার কারণে শহর ছেড়ে গ্রামে আসতে বাধ্য হয়েছি। দাম কমা ছাড়া আর শহরে যাওয়ার নামও নেয়া দায়!
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. তাওহীদ হোসেন সানি বলেন, দুইটা টিউশন ছিল। বহু দিনের সম্পর্ক তাদের সাথে। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ার পর এক মাসের ব্যবধানে দুইটি টিউশন থেকেই নিষেধ করে দেয়। লজ্জা বাদ দিয়ে বলেই ফেলেছিলাম ‘আস্তে ধীরে সম্মানি দিয়েন সমস্যা নেই’। তারপরে আরও একমাস করিয়েছি। গত মাসে নিষেধ করে দিয়েছে। আর্থিক টেনশনে কার পড়ায় মন বসে? কম খেয়ে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ডাক্তার বলেছে পুষ্টিকর খাবার খেতে। এমনি খেতে পারি না আবার পুষ্টিকর খাবার!

কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তার বলেন, মাত্র ১০ দিন আগেও রুটির দাম ছিল ৫ টাকা। এখন তা ১০ টাকা। সিঙ্গারা, আলু পুরি, ডাল পুরি, আলুর চপ, বেগুনি, পেয়াজুর দাম ৫ টাকা ছিল। এখন তা দ্বিগুণ। বলার ভাষা নেই। সারা দিনে এখন খরচ লাগে একশো পঞ্চাশ টাকার মতো। এরমাঝে আরও অনেক বাড়তি খরচের চাপ। সামনের মাস থেকে হয়তো বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে হবে।

শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মেসে থেকে অনেকে চাকরিও করেন। তাদের কপালেও পড়েছে চিন্তার ভাজ। আগের তুলনায় এখন দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু মাসিক বেতন একই আছে।
কুমিল্লার একটি বেসরকারি কলেজের খ-কালীন শিক্ষক সুজন মজুমদার বলেন, এখনও পড়াশোনা করছি চাকরির জন্য। চাকরির আবেদন ফি, যাতায়াত খরচ দিতেই কষ্ট হয়ে যায়। তাই অনেক পরীক্ষা বাদ দিতে হয়। এখন দ্রব্যমূল্যের যেই হারে দাম বেড়েছে। বাঁচার রাস্তা দেখছি না। সামনের দিকে চাকরির পরীক্ষা দেয়া হবে না মনে হচ্ছে। মানসিকভাবে খুব একটা ভালো নেই।

কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বলেন, শিক্ষার্থীদের এমন সমস্যা আসলেই জটিল। আর্থিক দুশ্চিন্তা থেকে তাদের ঘুম কম হওয়া, হতাশা, হীনমন্যতা, অবসাধ, ক্লান্তিভাবসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। এসব সমস্যা থেকে পরে বড় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তাই তাদের জন্য যদি নিয়মিত কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা হয়। তবেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভব। নাহলে পরে ব্যয় বহুল চিকিৎসা করাতে হবে।