ভাষা সৈনিকদের ভালোবাসায় ঋদ্ধ

।। মতিন সৈকত।।

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য হাজার,হাজার শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রিত হন। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মত রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, মানতে হবে, মানতে হবে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে ছাত্ররা। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি আসতেই ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার অযুহাতে পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে শহিদ হন রফিক, সালাম, বরকত, জাব্বারসহ আরো অনেকে। পরের দিন দিন দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন শফিউর রহমান সফিক। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে অসংখ্য গ্রন্থ প্রামাণ্য আছে।

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে রাজপথে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন সে মহান ভাষা সৈনিকদের কয়েকজনের সাথে আমার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিলো। তাদের ভালোবাসায় আমি ঋদ্ধ। ভাষা সৈনিক, লেখক, গবেষক, সম্পাদক অধ্যাপক মোঃ শাহেদ আলী। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করলেও সচরাচর কবিতা লিখতেননা। আমার বিয়ে উপলক্ষে ১৯৯৬সালে ডাকযোগে চিঠিসহ আট লাইনের চমৎকার সুন্দর কবিতাটি উপহার স্বরূপ ডাকযোগে পাঠান।

স্নেহাস্পদেষু
মতিন সৈকত
তোমার সাথে আমার কখনো দেখা হয়েছে কিনা, জানিনা। দেখা না হলেও আপন হতে বাধা নেই। তোমার চিঠি পড়ে আনন্দিত হয়েছি। তোমার সাথে ভবিষ্যতে দেখা হতে পারে। তখন তোমার জীবন সাথীকে নিয়ে আসবে, তোমাদের দু’জনকে বরণ করে নেব সেদিন। তোমার এ নতুন অভিযাত্রায় দু’টি কথা ছন্দে লিখে পাঠালাম, যদিও আমি কবি নই। পরম সুখের হোক, তোমাদের জীবন। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। তাই হুশিয়ারী। সাবধানে নৌকা বেয়ে তোমাদের তরী পারে ভেড়াতে হবে।
তোমাদের উভয়ের জন্য দোয়া।

—- ইতি
— শাহেদ আলী

 

তোমাদের অনির্দেশ যাত্রা পথে
—————————–শাহেদ আলী

বাইরে আঁধার ঘোর, তবু খোলো ঝাপ 
মেঘে ডাকা আসমান, তবু দাও লাফ। 
হয়ত তারার আলো পথ দেখাবে 
হয়ত সাপের মণি -আলো ছড়াবে। 
দুইজনে মিলে পেলে পথের ঠিকানা 
ক্ষণিকের উৎসবে হবে চেনা জানা। 
হিম্মতে তরী বাও, দূরে নয় সৈকত 
ওয়েসিস হোক তব দুরন্ত মরু পথ। 

 

আমি তখন গল্প, কবিতা, ফিচার লেখার পাশাপাশি সাহিত্য সংগঠক হিসাবে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি বাংলা সাহিত্যের রাজধানী ঢাকায়। অধ্যাপক, ভাষা সৈনিক শাহেদ আলী স্যারের এ উপহার সারাজীবন কৃতজ্ঞতা সহকারে মনে রাখবো। স্যারের জন্ম ১৯২৫ মৃত্যু ২০০১।
২০০৮ সালে সৃষ্টি সাহিত্য সাংস্কৃতিক মানব কল্যাণ সংগঠন গৌরীপুর, দাউদকান্দির আমন্ত্রণে প্রধান বক্তা হয়ে আসেন প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক, ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা আবদুল মতিন। যিনি ভাষা মতিন নামে বিখ্যাত। তাঁর চমৎকার সুন্দর মনোমুগ্ধকর বক্তব্য সকলকে ১৯৫২ সালে নিয়ে যায়। সৌভাগ্যের বিষয় সে দিন যে স্বল্প কয়েকজনকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা জানানো হয়। আমি তাদের একজন। প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এম তাফাজ্জাল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন ভাষা সৈনিক আন্তর্জাতিক পরমাণু বিজ্ঞানী, ড জসিম উদ্দিন আহমেদ, ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড আনোয়ার হোসেন।

প্রথম অধিবেশন শেষে সাংস্কৃতিক উৎসব। অতিথিরা মঞ্চ ছেড়ে সামনের সোফায় বসেন। আমিও তাদের সাথে। ভাষা মতিন স্যারের সামনে অটোগ্রাফের জন্য হাত পেতে দিয়ে আবদার করলাম হাতের তালুতে অটোগ্রাফ দিতে। তিনি বললেন খাতা কলম ছাড়া কি অটোগ্রাফ দেয়া যায়? হাতের লেখাতো উঠে যাবে। আমি বললাম স্যার আপনি ভাষা মতিন আমি কৃষক মতিন। হাতের লেখা উঠে গেলেও মনের মধ্যে থেকে যাবে। সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তিনি আমার হাতের তালুতে শুভেচ্ছা শুভাশিস লিখে দিলেন। সাংবাদিক মোঃ হানিফ খান আমার ঐতিহাসিক ছবিটি তুলে দিলেন। ২০১১ সালে জাতীয় যাদুঘর মিলনায়তনে ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন স্যার আমার গলায় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা-দৌলা স্বর্ণপদক তুলে দেন। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনের জন্ম ১৯২৬ মৃত্যু ২০১৪।

আন্তর্জাতিক পরমাণু বিজ্ঞানী, লেখক, কবি, একুশে পদক প্রাপ্ত ভাষা সৈনিক ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ স্যারকে প্রথম দেখি ২০০৮ সালে গৌরীপুরের অনুষ্ঠানে। সে থেকে স্যারের সাথে পরম মমতায় জড়িয়ে যাই। আমার স্নেহের এস এম মিজান বাংলাদেশ ফেন্ড্রশিপ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। আমি তার প্রধান উপদেষ্টা। পরবর্তীতে আমরা ড. জসিম স্যারকে প্রধান উপদেষ্টা এবং পৃষ্ঠপোষকের মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করি।

ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ স্যার যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি ফেন্ডশিপ ফাউন্ডেশনর প্রধান অতিথি ছিলেন এবং আমি কয়েকটি অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলাম। স্যারের সাথে আমাদের আত্মীয়ের মত সম্পর্ক ছিলো। আমি আর মিজান এক সাথে হলে মিজান প্রায়ই স্যারকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিতো। সে সময়ে আমরা একসাথে কথা বলতাম। জসিম স্যার মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ফোনে বলছিলেন ‘মতিন দি বুড়ো হয়ে গেছে। চুল দাড়ি সব পেকে গেছে’। বলতেন মতিনের পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, পাখির কি খবর। জসিম স্যারের বাসায় গিয়েছি। ভাত খেয়েছি। স্যার লিফট থেকে এগিয়ে নিতেন আবার ফেরার সময় লিফটে তুলে দিতেন। তাঁর লেখা অসংখ্য বই পত্র, পুরস্কার, ক্রেস্ট, পদক ঘুরে দেখিয়ে বর্ণনা দিতেন। আমি যেনো জাতীয় পরিবেশ পদক পাই এ জন্য তিনি দুইবার সরকারের কাছে মনোনয়ন প্রস্তাব পাঠান। স্যার নব্বই বছর বয়সেও তারুণ্যে উদ্দীপিত ছিলেন। মঞ্চে উঠার সময় বা সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠার সময় হাত ধরে সহযোগিতা করতে চাইলে বলত না ধরতে হবেনা। আমি উঠতে পারব। প্রায় স্যারের সাথে ফোনে কথা হত। নিজের থেকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিতেন। স্যার প্রাণ খুলে হাসতেন। বিশেষ দিনে ম্যাসেজ পাঠাতেন। মাঝে মধ্যে আমাকে টেলিভিশনে দেখলে এবং জাতীয় দৈনিকে আমার উপর কোন ফিচার বা নিউজ প্রকাশিত হলে অভিনন্দন জানাতেন।

 

Matin Saikot Thank you, Just now I have read it Wonderful job, Congratulation, Wish you more and more Innovations With Success

  1. Jashim Ahmed

ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ স্যার তার লেখা অনেক বই আমাকেসহ বিভিন্ন সংগঠন ও পাঠাগারের জন্য মুক্ত হস্তে দান করেন।

ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ স্যারের জন্ম ১৯৩৩ সালে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গলিয়ারচর গ্রামে। মৃত্যু ২০২২ সালে।

সরাসরি দেখা করে কথা বলেছি সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, বহু গ্রণেতা,
ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর স্যারের সাথে। কুমিল্লার ভাষা সৈনিক আলী তাহের মজুমদার স্যারের হাত থেকে ও পুরস্কার নিয়েছি। এছাড়াও কালে ভদ্রে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষা সৈনিকদের সাথে কম বেশি দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। জীবিত এবং মৃত সকল ভাষা সৈনিকদের জন্য দোয়া রইলো।

 

লেখক: জাতীয় পরিবেশ পদক এবং দুইবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত।