মহিলা সাংবাদিকতার অগ্রদূত শামসুননাহার রাব্বী

 

অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ

ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ

প্রায় ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বেগম শামসুননাহার রাব্বী সাংবাদিক ও লেখিকা হিসাবে এতদঅঞ্চলে নান্দনিকতার ছাপ রেখেছেন। ১৯৪৩ সালের পহেলা নভেম্বর তিনি মোগলটুলীর এক ঐতিহাসিক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সনের ২০ অক্টোবর সাপ্তাহিক আমোদ‘র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর সঙ্গে শামসুননাহার রাব্বীর শুভ পরিণয় হয়। ১৯৫৯ সনে শামসুননাহার রাব্বী সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। তার বংশের চতুর্থ পুরুষ ছিলেন আলা সাহেব, যিনি ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মুসলিম জেলা জজ ছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কৃত খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোবাশ্বের আলী ছিলেন তাঁর মামা। শৈশব থেকেই তিনি মামার খুব কাছাকাছি ছিলেন। তাছাড়া ফজলে রাব্বী সাহেবের সঙ্গে বিয়ের পর তাঁর সাহচর্য্যে লেখালেখিতে অনুপ্রাণিত হন। ১৯৭৩ সনে ইউরোপ সফর করে এসে ফজলে রাব্বীর সঙ্গে যুগ্মভাবে “ইউরোপে ৩৮ দিন” শিরোনামে ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশ করেন। ১৯৭৯ সনে ‘মহামিলনের মহামেলায়’ ব্রত নিয়ে একটি মহাগ্রন্থ রচনা করেন। ‘ব্যবধান’ নামের একটি গল্পগুচ্ছ ১৯৮৪ তে লেখেন। যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসে ১৯৯১ এ “প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্য” ভ্রমণ কাহিনীটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। তাঁর পাঁচ দশকের বিভিন্ন লেখা সামগ্রী “ভালবাসার পাঁচ দশক’ নামীয় একটি গ্রন্থে সংকলিত করেছেন। ১৯৭৪ সালে যমুনা সাহিত্য গোষ্ঠী তাঁকে ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ উপাধি প্রদান করেন। ১৯৯৭ সনে ‘অনন্য শীর্ষ দশ’ সম্মাননা লাভ করেন। সাহিত্যে আমার বিচরণ কম তারপরও যতটুকু জেনেছি ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত তিনি ময়নামতি নামের একটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেছেন। যাটের দশক থেকে নব্বই এর দশক পর্যন্ত তিনিই ছিলেন এতদঅঞ্চলে একমাত্র নারী সাংবাদিক। তাঁর প্রায় সবগুলো লেখাই আমোদসহ দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন ও স্মারকগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।

১৯৫৫ সনের ৫ই মে সাপ্তাহিক সংবাদপত্র আমোদ প্রত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকে আমোদ ছিল ক্রীড়া সাপ্তাহিক। শিক্ষার হার কতছিল জানিনা তবে স্বাক্ষরতার হার ছিল ১৫% ভাগ। সহজেই বুঝা যায় পত্রিকা কজনে পড়তেন তারপর আবার ক্রীড়া সাপ্তাহিক এবং মফস্বল শহর থেকে প্রকাশ। যারজন্য বলি সেই সময়কার সবচে সাহসী পুরুষ ছিলেন জনাব ফজলে রাব্বী। সাথে সাথে এটাও বলতে হয় সবচে সাহসী নারী ছিলেন শামসুননাহার রাব্বী। তা নাহলে কিভাবে আমোদ সম্পাদককে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন। আমোদ পত্রিকাটি বিগত ৬৭ বৎসর যাবত নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ও শামসুননাহার রাব্বীর কঠোর পরিশ্রম এ ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এ সুদীর্ঘ সময়ের মাঝে আয়ুব খানের মার্শাল ‘ল’র কারণে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ২৮ সপ্তাহ এবং ১৯৭৫ এ ১৪ সপ্তাহ সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ ছিল। এক সাক্ষাতকারে শামসুননাহার রাব্বী বলেছিলেন “চল্লিশ বছর ছয় মাস রাব্বী সাহেব পত্রিকাটির প্রকাশনা করে গেছেন। তিনি পত্রিকার সংবাদ লেখা, সম্পাদনা লেখা, বানান ঠিক করা, ছাপানো, ভাঁজ করা সবই করতেন।” ১৯৮৫ সনে রাব্বী সাহেব হলেন প্রধান সম্পাদক তাঁর স্ত্রী শামসুন্নাহার রাব্বী হলেন সম্পাদক। ১৯৯৪ সনের ২৮ নভেম্বর ফজলে রাব্বী সাহেব ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী শামসুননাহার রাব্বী এবং একমাত্র ছেলে বাকীন রাব্বী পত্রিকার হাল ধরেন।

১৯৮৫ থেকেই রাব্বী সাহেব মাঝে মধ্যে অসুস্থ থাকতেন এবং বেশ কয়েকবার সিডি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। তখনই মাঝে মধ্যে শামসুননাহার রাব্বীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। অত্যন্ত স্পষ্টভাষী এবং শুদ্ধ বাংলায় ছিল তার উচ্চারণ। আমি খালাম্মা বলেই সম্বোধন করতাম। তিনি যে পর্দা করতেন সেটা অনুসরণীয়। চশমা পড়তেন তবে চোখে মুখে ছিল উজ্জল্য এবং বিনয়ী ভাব যা এ ওজনের এখনকার কারো কাছে আশা করা মুশকিল। শামসুননাহার রাব্বী এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, “সততা ও পরিশ্রম আমাদের একমাত্র পুঁজি, আমোদ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী নিজ হাতে পাঠকের বাসায় পত্রিকা পৌছে দিতেন। নিজে গ্রাহক চাঁদা তুলে আনতেন। পরিবারের সদস্যরা সবাই পত্রিকার বাইন্ডিং থেকে শুরু করে বিলির কাজও করতো। এমনও দিন গেছে আমরা চিড়া মুড়ি খেয়ে দিন কাটিয়েছি। ঈদের সময় গলার হার বন্ধক রেখে কর্মীদের বেতন দিয়েছি। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে কুমিল্লায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল কম। পত্রিকা সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেন না। ঢাকা থেকে বাংলা ও ইংরেজি মিলে তিন-চারশ পত্রিকা আসত। বাসা বাড়িতে তেমন পত্রিকা রাখা হত না। প্রথমে পত্রিকা ভাঁজ, টিকিট লাগনো, ঠিকানা লাগানোর কাজ করতাম। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রুফ দেখা শুরু করলাম। এরপর আস্তে আস্তে পত্রিকার কাজ, সন্তান সামলানো একসাথে চললো। একটু প্রুফ কাটি আবার দৌড়ে গিয়ে চুলার তরকারি দেখি। ১৯৮৫ সনে রাব্বী সাহেব নিজ থেকে সম্পাদকের দায়িত্ব আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে একটু অবসর চাইলেন।” ‘আমোদ’ শুধু একটি পত্রিকা নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠান যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের স্মৃতি। সাংবাদিকদের অনেকে যারা দেশ বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত তাদের অনেকের হাতে খড়ি এ পত্রিকায়। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইহলোক ত্যাগ করলেও বেগম রাব্বী খুব শক্তভাবে হাল ধরেছিলেন এবং ক্রমান্বয়ে বাকীন রাব্বীকে সুযোগ্য করে তুলেছিলেন। শামসুননাহার রাব্বী ছিলেন একাধারে লেখিকা, সংগঠক, সমাজকর্মী, সাংবাদিক এবং সবার উপরে একজন মহীয়সী নারী। তিনি সমাজকে সবসময় কিছু দিতে চিন্তা করতেন। কুমিল্লা ডায়বেটিক হাসপাতাল ও বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল তৈরিতে ডা: যোবায়দা হান্নানকে সার্বিক সহায়তা দান করেছেন বেগম শামসুননাহার রাব্বী।

২৩ শে জুন’২১ বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে তিনটার দিকে শামসুননাহার রাব্বীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি রাজ্যের নেপচুন শহরের জার্জিশের মেডিকেল কলেজ, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৫শে জুন’২১ বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় তিনি ইহকালের মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে যান। বয়স হয়েছিল ৭৯ বৎসর। ২৬শে জুন’২১ বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় জানাজা সম্পন্ন করে নিউজার্সির মার্লবোরো মুসলিম সিমেট্রিতে তাঁকে দাফন করা হয়। শুধু কুমিল্লা নয়, বাংলা ভাষার একটি প্রাচীনতম সংবাদপত্র “সাপ্তাহিক আমোদ”, ইউনেস্কো পুরস্কার প্রাপ্তির গৌরবময় একটি অধ্যায়ও রয়েছে এ পত্রিকাটির। আর এর পেছনে একটা বিশাল অবদান রয়েছে শামসুননাহার খালাম্মার। কুমিল্লার গণমাধ্যমকে একটি গৌরবউজ্জ্বল অবস্থানে নিয়ে যেতে তাঁর অবস্থান ছিল অতীব স্মরণীয়। বাসায় অর্থাৎ পত্রিকা অফিসে গেলে আপ্যায়িত না হয়ে কেউ এসেছে এমন কোন উদাহরণ কেউ কোনদিন দিতে পারবে না। হাজারো সম্মানিত স্মৃতি রেখেই তিনি চলে গেলেন পরপারে। আল্লাহ তাঁকে বেহেশতের উচ্চতম স্থানে অধিষ্ঠিত করুক এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর আদর্শকে উর্ধ্বে ধরে রেখে সংবাদপত্র রক্ষায় ও মানবসেবায় এগিয়ে যাক কুমিল্লাবাসীর পক্ষ থেকে এ আশাবাদই ব্যক্ত করছি।

লেখক:
সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল।