‘মিরাস বণ্টন’: যেখানে চাচা-মামারাই ভিলেন

হুমায়ুন কবির।।
ইসলামে উত্তরাধিকার বন্টন, যাকে ফারায়েজ বা মিরাস বলা হয়, একটি সুসংহত এবং সুবিন্যস্ত ব্যবস্থা। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জীবনের নানান ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য আরোপিত একটি বিধান। কুরআন ও হাদিস উভয়েই উত্তরাধিকার বন্টনের স্পষ্ট বিধান প্রদান করেছেন, যা পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
‘মিরাস বণ্টনে’ কুরআনের নির্দেশনা
কুরআনে উত্তরাধিকার বন্টনের বিধান মূলত সূরা আন-নিসা (৪র্থ সূরা) এ বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
১. আল- কোরআনের ‘সূরাহ আন-নিসা’ ১১ নং আয়াতে -এ বলা হয়েছে, “পুরুষ এবং নারীর জন্য নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারিত হয়েছে; আপনি যদি কিছু অপ্রাকৃত সম্পদ পান, তবে তা আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী ভাগ করুন।তা(সম্পত্তি) কম হোক আর বেশি হোক; একটা নির্ধারিত অংশ”। (সূরাহ আন-নিসা- ৭) এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, প্রত্যেক উত্তরাধিকারীকে আল্লাহর নির্ধারিত অংশ প্রদান করা বাধ্যতামূলক।
২. পবিত্র ‘আল- কোরআনে’ বলা হয়েছে ‘সূরাহ আন-নিসা’ ১১ নং আয়াতে- নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে- “আল্লাহ্ তোমাদের সন্তানদের মধ্যে(সম্পত্তি বণ্টন সম্বন্ধে) বিধান দিচ্ছেন। এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার সমান। কিন্তু যদি তারা(সবাই) কন্যা হয়, দুই বা তার অধিক, তাহলে তাদের জন্য তিন ভাগের দুই ভাগ যা সে (মৃত ব্যক্তি) রেখে গেছে। আর যদি সে (কন্যা) একজন হয় তবে তার জন্য অর্থেক। আর তার(মৃতের) সন্তান থাকলে তার পিতা ও মাতা প্রত্যেকের জন্য রেখে যাওয়া সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ। আর সে(মৃত ব্যক্তি) নিঃসন্তান হলে এবং একমাত্র পিতা-মাতাই তার উত্তারিকারী হলে তার মাতার জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ। (এ সবই)কৃত ওসিয়াত পূরণ এবং ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও সন্তানের মাঝে উপকারের দিক থেকে কে তোমাদের নিকটতর তা তোমরা অবগত নও। (এই বণ্টন) আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অবশ্য পালনীয়(বিধান)। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন ব্যক্তির একজন মেয়ে এবং একজন ছেলে থাকে, তবে ছেলের অংশ দুগুণ হবার বিধান দিয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অর্থাৎ সম্পত্তির মোট তিন ভাগ হবে। ছেলে দুই ভাগ এবং মেয়ে এক ভাগ পাবে। এটাই আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সাব্যস্ত।
৩. ‘সূরাহ আন-নিসা’ ১২ নং আয়াতে ‘আর তোমাদের স্ত্রীরা যদি নিঃসন্তান হয় তাহলে তাদের রেখে যাওয়া সম্পদের অর্ধেক তোমরা পাবে। কিন্তু যদি তাদের সন্তান থাকে তাহলে তোমরা তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ পাবে। (এ সবই) তাদের ওসিয়াত এবং ঋণ পরিশোধের পর। যদি তোমরা নিঃসন্তান হও তাহলে তোমাদের রেখে যাওয়া সম্পদের চার ভাগের এক ভাগ তোমাদের স্ত্রীরা পাবে। কিন্তু যদি তোমাদের সন্তান থাকে তাহলে তোমাদের রেখে যাওয়া সম্পদের আট ভাগের এক ভাগ(তোমাদের) স্ত্রীরা পাবে, (এ সবই হবে) তোমাদের ওসিয়াত ও ঋণ পরিশোধের পর। কোনো পুরুষ বা নারী যদি পিতা-মাতা বা সন্তান উত্তরাধিকারী হিসাবে না রেখে যায় এবং তার এক ভাই অথবা এক বোন থাকে তাহলে তাদের দুজনের প্রত্যেকের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ। কিন্তু যদি তারা একের অধিক হয় তাহলে তাদের কোনো প্রকার ক্ষতি না করে ওসিয়াত পূরণ ও ঋণ পরিশোধের পর তাদের সবাই তিন ভাগের এক ভাগে অংশীদার হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ। এই বিধানটি পরিবারের মহিলাদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে, যাতে তাদের জীবিকার নিশ্চয়তা বজায় থাকে।
৪. আল–কোরআনে ‘সূরাহ আন-নিসা’ ১৪ নং আয়াতে- আর যে ব্যক্তি( মিরাস বন্টনের ব্যপারে) আল্লাহ্ ও তার রসুলের অবাধ্য হবে এবং তার নির্ধারিত করবে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন, সেখানে সে চিরকাল থাকবে। তার জন্য রয়েছে আপমানকর শাস্তি।
৫. ‘সূরাহ আন-নিসা’ ১৭৬ নং আয়াতে ‘তারা তোমার কাছে ফতওয়া(বিধান) জানতে চায়। বলো- আল্লাহ্ তোমাদের কালালাহ(পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি নেই এমন ব্যক্তি) সম্পর্কে বিধান দিচ্ছেন। কোনো পুরুষ মারা গেলে তার যদি কোনো সন্তান না থাকে এবং তার এক বোন থাকে তবে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক সে পাবে। আর সে (মৃত নারী) যদি সন্তানহীনা হয় তবে তার ভাই তার উত্তরাধিকারী হবে। আর দুই বোন থাকলে তাদের জন্য তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ। আর যদি বোন ভাই উভয়ই থাকে তবে পুরুষের অংশ দুইজন নারীর অংশের সমান। আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে( উত্তরাধিকারীদের মাঝে সম্পদ বণ্টনের নীতিমালা) বর্ণনা করেছেন যাতে তোমরা বিভ্রান্ত না হও। আর আল্লাহ্ সকল বিষয়ে ভালো জানেন। এ উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে জটিল পারিবারিক পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট নিয়মাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এমন পরিস্থিতিতে যখন উত্তরাধিকারী সংখ্যা ও সম্পর্কের জটিলতা বেশি, তখন আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট অংশ প্রদান করাই শ্রেয়। আফসোস! আমরা কি আল্লাহ্র চেয়ে বেশি বুঝি ? আস্তাগফিরুল্লাহ!
‘মিরাস বণ্টন’ হাদিসের নির্দেশনা
ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পদ পেত সন্তান আর পিতা-মাতার জন্য ছিল অসিয়ত। অতঃপর আল্লাহ্ তাঁর পছন্দ মত এ বিধান রহিত করে ছেলের অংশ মেয়ের দ্বিগুণ, পিতামাতা প্রত্যেকের জন্য এক ষষ্ঠাংশ, স্ত্রীর জন্য এক অষ্টমাংশ, এক চতুর্থাংশ, স্বামীর জন্য অর্ধেক, এক চতুর্থাংশ নির্ধারণ করেন।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৭৪৭, হাদিসের মান: সহিহ হাদিস। সা‘দ ইব্নু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, বিদায় হাজ্জে একটি কঠিন রোগে আমি আক্রান্ত হলে, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার খোঁজ খবর নেয়ার জন্য আসতেন। একদা আমি তাঁর কাছে নিবেদন করলাম, আমার রোগ চরমে পৌঁছেছে আর আমি সম্পদশালী। একমাত্র কন্যা ছাড়া কেউ আমার উত্তরাধিকারী নেই। তবে আমি কি আমার সম্পদের দু’ তৃতীয়াংশ সদকা করতে পারি? তিনি বললেন, না। আমি আবার নিবেদন করলাম, তাহলে অর্ধেক। তিনি বললেন, না। অতঃপর তিনি বললেন, এক তৃতীয়াংশ আর এক তৃতীয়াংশও বিরাট পরিমাণ অথবা অধিক। তোমরা ওয়ারিসদের অভাবমুক্ত রেখে যাওয়া, তাদের খালি হাতে পরমুখাপেক্ষী অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম। [১] আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তুমি যে কোন ব্যয় করো না কেন, তোমাকে তার বিনিময়ে প্রদান করা হবে। এমনকি যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিবে (তারও প্রতিদান পাবে)। আমি নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রসূল! (আফসোস) আমি আমার সাথীদের হতে পিছনে থেকে যাব? তিনি বললেন, তুমি যদি পিছনে থেকে নেক ‘আমল করতে থাক, তাহলে তাতে তোমার মর্যাদা ও উন্নতি বৃদ্ধিই পেতে থাকবে। তাছাড়া, সম্ভবত, তুমি পিছনে (থেকে যাবে)। যার ফলে তোমার দ্বারা অনেক কওম উপকার লাভ করবে। আর অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হে আল্লাহ্! আমার সাহাবীগণের হিজরত বলবৎ রাখুন। পশ্চাতে ফিরিয়ে দিবেন না। কিন্তু আফসোস! সা‘দ ইব্নু খাওলার জন্য (এ বলে) আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করছিলেন, যেহেতু মক্কায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
উল্লেখ্য: [১] বর্তমান সমাজে কিছু অতি পরহেজগার লোক দেখা যায় যারা নিজেদের ওয়ারিসদের বঞ্চিত করে মালের সিংহভাগ দান করে থাকেন, কেউ বা মেয়েদের বঞ্চিত করেন আবার কেউ বা সমাবেশ করে লিখে দিয়ে যান তাদেরকে এ হাদীস থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১২৯৫, হাদিসের মান: সহিহ হাদিস।
নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর হাদিসগুলোও উত্তরাধিকার বন্টনের গুরুত্ব ও বিধানকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে। বহু হাদিসে তিনি বলেন, “উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, তবে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট বিধান।” এর অর্থ, উত্তরাধিকার বন্টন কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছাশক্তি বা সামাজিক চাহিদার ভিত্তিতে নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক এবং ন্যায়বিচার সংক্রান্ত বিধান যা আল্লাহর হুকুম মেনে চলা আবশ্যক।
উত্তরাধিকার বন্টনের মৌলিক নীতি
ইসলামী উত্তরাধিকার বন্টনের প্রধান নীতিগুলো হলো:
 নির্দিষ্টতা: আল্লাহ তাআলা নিজেই কুরআনের মাধ্যমে উত্তরাধিকারীদের নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারণ করেছেন। এতে ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা সামাজিক চাহিদার উপর ভিত্তি করে কোনো পরিবর্তন আনার সুযোগ নেই।
 ন্যায়বিচার: উত্তরাধিকার বন্টনের মাধ্যমে পরিবারে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। পুরুষ ও নারী উভয়েরই অধিকার সুরক্ষিত করা হয়, তবে তাদের আর্থিক দায়িত্ব ও সমাজে অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ভাগের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
 সমাজের স্থিতিশীলতা: উত্তরাধিকার বন্টনের সঠিক রীতি বজায় রাখলে পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, যা সমাজের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে নির্দিষ্ট কোনো ঋণ বা দায়বদ্ধতা থেকে থাকে, তবে তা পূর্বেই নিষ্পত্তি করার পরেই উত্তরাধিকার বন্টন করা হয়। এভাবে, উত্তরাধিকার বন্টন কেবলমাত্র ধন-সম্পত্তির ভাগ নয়, বরং পরিবারের সম্মান, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
এভাবেই, ইসলামে “মিরাস বন্টন” কেবলমাত্র একটি আর্থিক লেনদেনের বিষয় নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক ব্যবস্থা, যা মুসলিম সমাজকে একত্রিত ও সুসংহত করে। আশা করা যায়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রজন্মও এই আল্লাহর হুকুম মান্য করে, সামাজিক ন্যায়, সমতা ও মানবিক মূল্যবোধকে আরো সুদৃঢ় করবে।
লেখক:উদ্যোক্তা,টাট্কা এগ্রোফার্ম,মিথিলাপুর,বুড়িচং।

inside post
আরো পড়ুন