যে বাঁশির সুরে পরী নামে!

অফিস রিপোর্ট
কে বাঁশি বাজায় রে মন কেন নাচায় রে… কিংবা বাঁশি শুনে আর কাজ নেই সে যে ডাকাতিয়াবাসী। গ্রামটির নাম শ্রীমদ্দি। কুমিল্লা হোমনা উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। পুরো গ্রাম বাঁশির সুরের মোর্ছনায় থাকে আচ্ছন্ন। উঠান কিংবা টীনের ঘরের বারান্দা দিনভর চলছে বাঁশি বানানোর কাজ। নিখুঁত হাতে তৈরী এখানকার বাঁশি দেশ পেড়িয়ে যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকা। কথিত আছে, শ্রীমদ্দির বাঁশির সুরে পরী নামতো পূর্ণিমা রাতে। পরীরা এই বাঁশির সুরে নৃত্য করতো।

কারিগররা কাজের ফাঁকে বাঁশের তৈরি বাঁশিগুলোতে এমন সব গানের সুর তোলেন। দুশো বছর ধরে এ গ্রামে বাঁশ দিয়ে তৈরি বাঁশি বানানো ও বিক্রয় করা হচ্ছে। বছরজুড়ে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাঁশি বানায় গ্রামটির ৪০ পরিবারের সাড়ে ৩শ’ সদস্য।

শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশি তৈরির কারিগর আবুল কাশেম। গত ৪০ বছর ধরে তিনি বাঁশি তৈরি করছেন। আবুল কাশেম বলেন, বংশ পরম্পরায় এই বাঁশি তৈরি ও বিক্রি করে সন্তানদের লালন পালন করেছেন৷ গত ২শ’ বছর ধরে চলে আসছে বাঁশি তৈরি ও বিক্রির কাজ।
আবুল কাশেম বলেন, বৈশাখ এলে আমাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। রাত দিন সমানে চলে বাঁশি তৈরি ও রং করার কাজ৷ পাইকাররা ভোরবেলা বাড়িতে এসে বসে থাকেন অর্ডার করা বাঁশি নেয়ার জন্য।’

বাঁশির কাঁচা মাল বাঁশ সংগ্রহ করা হয় চট্টগ্রাম, মিরসরাই, বান্দরবান থেকে। সংগ্রহ করা বাঁশগুলো প্রথমে রোদে রাখা হয়। তারপর আকার আকৃতি দিয়ে বাঁশগুলো কাটা হয়। তারপর গরম পানিতে সেদ্ধ করা হয় আকৃতি দেয়া বাঁশগুলোকে। বাঁশ সেদ্ধ না করলে ঘুনে ধরে বাঁশি নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে। বাঁশ সেদ্ধ করার পর কেটে বাঁশি বানানো হয়। কয়লার আগুনে লোহার শিক গরম করে ছিদ্র করা হয় বাঁশি। ঘরের বউ ঝিরা বাঁশি তৈরির কাজে সহযোগিতা করে।
শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশির আরেক কারিগর আবদুল করিম। তিনি জানালেন, বিভিন্ন প্রকারের বাঁশি তৈরি হয় শ্রীমদ্দি গ্রামে। মোহন বাঁশি, ভীন বাঁশি, ক্যালেনর বাঁশি, পাখি বাঁশি, নাগিন বাঁশি, আড় বাঁশি, মোহন বাঁশি।
৫ টাকা থেকে শুরু করে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বাঁশি বিক্রি করা হয়।
বাঁশির কারিগর আবুল কাশেম জানান, হোমনার শ্রীমদ্দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছায়ানটের শিল্পীরা আসেন। তারা এসে পছন্দ করে বাঁশি কিনে নিয়ে যান। আবুল কাশেম স্মৃতির ঝাপি খুলে বলেন, আমাদের গ্রাম থেকে বাঁশি কিনে নিয়ে গেছেন শিল্পী বারি সিদ্দিকীসহ আরো বহু গুণী শিল্পীরা।
বাঁশি কিনতে আসা জামালপুর জেলার ব্যবসায়ী আবদুস সাত্তার বলেন, আমরা যেমন বাঁশি চাই ঠিক তেমন বাঁশি পাই শ্রীমদ্দিতে। বাঁশ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বানানো পর্যন্ত সবকিছুতে গুণগত মান অক্ষুন্ন রাখে কারিগররা।
ঢাকার সাভার থেকে বাঁশি কিনতে আসা ব্যবসায়ী লুৎফুর রহমান বলেন, গত ১০ বছর ধরে পহেলা বৈশাখ এলেই আমি চলে আসি শ্রীমদ্দিতে। এখানকার বাঁশি ঠোঁটে নিলেই যেন সুর বের হয়।
শ্রীমদ্দি গ্রামের বাবুল বিশ্বাস বলেন, গত ১৫-২০ বছর যাবত বেশ কয়েকবার এনজিওর মাধ্যমে শ্রীমদ্দির বাঁশি পৌঁছে গেছে সিঙ্গাপুর, লন্ডন, কানাডা, আমেরিকা, জার্মান, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশে। সেখানে বসবারত বাঙ্গালিরা নিজেরা কিনেন। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবেও বাংলাদেশের হোমার বাঁশি বাজানো হয়।
শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশির কারিগর যতীন্দ্র বিশ্বাস ও তার স্ত্রী রিনা বিশ্বাস বলেন, বাঁশি শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের সহযোগিতা লাগবে। সরকার যদি জ্বালানির খরচটা সরবরাহ করতো অথবা সহজ শর্তে ঋণ সরবরাহ করতো তাহলে বাঁশি শিল্পটাকে তারা আরো অনেক দূর নিয়ে যেতে পারতেন।
বাঁশি শিল্পীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমন দে জানান, আমি সরেজমিনে গিয়েছি। তাদের সাথে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন যদি জ্বালানি হিসেবে গ্যাস সরবরাহ করা হয় তাহলে খুব ভালো হয়। আমি বাখরাবাদ গ্যাসের সাথে কথা বলেছি। হোমনায় লাইন আছে। আশা করি খুব শীঘ্রই ফিডব্যাক পাবো।