রত্নগর্ভা জোহরা আনিস: যিনি নিজেও রত্ন

।। মোতাহার হোসেন মাহবুব ।।

কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, রত্নগর্ভা মা ও বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত কুমিল্লার শিক্ষা-সাংস্কৃতিক-সামাজিক অঙ্গনের সুপরিচিত নারীনেত্রী প্রফেসর জোহরা আনিস গত বছর তথা ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদটি কিছুটা বিলম্বে পেয়েছি। আজকাল কেন যে আপনজনদের মৃত্যু সংবাদ খানিকটা বিলম্বে পাই। এমনও হতে পারে- তাৎক্ষণিকভাবে পেলে হয়তো সহ্য করার ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। আসলে বেলায় বেলায় বেলা তো কম হলো না। এখন পড়ন্ত বিকেল। কখন যে নিজের ডাক এসে যায়- জানি না। বিশ্বাস করি, একমাত্র বিধাতা ছাড়া ওখানে কারো হাত দেয়ার ক্ষমতা নেই।
বলছি, প্রফেসর জোহরা আনিসের কথা। এককথায় তিনি আপনজন ছিলেন; কতটা আপন বলে বুঝানো যাবে না। তিনি আমাকে ‘মাহবুব’ বলেই ডাকতেন এবং এ নামে ডাকার পরপরই বলতেন, ‘তোমাকে আমি ছোট ভাই মনে করেই তোমার নামের আগে পিছে কিছু বলি না’। তাঁর সম্বোধন ভঙ্গি এতটাই মাধুর্যপূর্ণ ছিল- যা আমাকে মুগ্ধচিত্তে তাঁর কথাগুলো শুনতে বাধ্য করতো। সেই জোহরা আপা অচিনপুরে পাড়ি দিলেন অনেকটা নিরবে-নিভৃতে।
মনে আছে, জোহরা আপা যে বছর ‘রত্নগর্ভা মা’ সম্মাননায় ভূষিত হলেন সে-বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১৬ মার্চ দৈনিক শিরোনাম-এ তাঁকে ঘিরে স্বরচিত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম ছিল “রত্নগর্ভা মা’ সম্মাননা ভূষিত কুমিল্লার কৃতী নারী জোহরা আনিস। যিনি নিজেও একজন রত্ন’। এরপর যখন বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত হন তখনও একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম। (পত্রিকার কপি সংগ্রহ করতে পারিনি)। ২০১৯ সালে তিনি বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত হন। জোহরা আপা প্রায়শ ফোন করতেন। খবরা-খবর নিতেন। জানাতেন, সন্তানদের কৃতিত্বের কথা। বলার সময় তিনি গর্ববোধ করতেন- বলার ভঙ্গি দেখে বুঝা যেত। মৃত্যুর মাসখানেক আগে এক অনুষ্ঠানে বললেন, ‘মাহবুব, পাশে বসো, ছবি তুলবো। কখন সে চলে যাই- ঠিক নেই’। ঠিকই চলে গেলেন।

দুই.
মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত- একথা যেমন সত্য তেমনি একটি শিশুকে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তুলতে মায়ের ভূমিকাও অপরিসীম। সুশিক্ষিত সন্তান গঠনে একজন সচেতন মা-ই হচ্ছেন মূল চালিকাশক্তি। এক্ষেত্রে একজন মমতাময়ী মায়ের দর্পন প্রফেসর জোহরা আনিস। দীর্ঘদিনের শ্রম ও মেধা বিশেষত সন্তান লালনে তাঁর পরিপূর্ণ মায়ের ভূমিকা তাঁকে এনে দিয়েছে অসামান্য কৃতিত্বের পুরস্কার- রতœগর্ভা মা। তাঁর এ কৃতিত্বে তথা সম্মাননা প্রাপ্তিতে তিনি যেমন গর্বিত হয়েছেন তেমনি কুমিল্লাবাসীর মুখও হয়েছে উজ্জ্বল। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ২০১৯ সালে বেগম রোকেয়া পদক প্রাপ্তি এ উজ্জ্বলতাকে প্রোজ্জ্বলতায় উন্নতি করে। ‘রত্নগর্ভা মা’ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে অ্যাওয়ার্ড রতœগর্ভা মা’র আয়োজক, আজাদ গ্রুপ অব কোম্পানীর চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ তার স্বাগত বক্তব্যে বলেছেন, ‘প্রতি বছর বিশ্ব নারী ও মা দিবস উপলক্ষ্যে এ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। এ বছর (২০০৭) সারা দেশ থেকে ২৭ জন মাকে এ সম্মাননা পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তন্মধ্যে দুজনকে বিশেষ বিবেচনায় পুরস্কার দেয়া হয়েছে। কুমিল্লা থেকে দুজন মাকে রতœগর্ভা মা সম্মাননা পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তাঁদের একজন জোহরা আনিস, অন্যজন জাহানারা বেগম।’ ঢাকায় গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে অনুষ্ঠিত বর্ণাঢ্য এ আয়োজনে প্রধান অতিথি শিল্প, পাট, বস্ত্র, মহিলা শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী কুমিল্লা কৃতী নারী প্রফেসর জোহরা আনিসকে ‘রতœগর্ভা মা’ এর সম্মাননা পদক প্রদান করেন।

তিন.
খাদ্য বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এডভোকেট মো: আনিসুল হক খানের সহধর্মিণী অধ্যক্ষ প্রফেসর জোহরা আনিস কুমিল্লায় শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সামাজিক অঙ্গনে যেমন একজন সুপরিচিত নারী ছিলেন তেমনি তিনি একজন সচেতন মা হিসেবে তাঁর তিন সন্তানকেও ¯স্নেহ-শাসনের ছায়ায় রেখে মানুষের মতো মানুষ করেছেন। কৃতী এ মায়ের তিন সন্তানই আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং এক একটি রত্ন।
তাঁর প্রথম সন্তান জোবেদা কনক খান এমএসসিতে প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে ৫ম স্থান অর্জন করেছেন। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনে তিনি ছিলেন সুপরিচিত মুখ। বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। তাঁর স্বামীও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। দ্বিতীয় সন্তান ডা: মো: আরিফ মোর্শেদ খান ১৯৯০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯৯২ সালে একই বোর্ড থেকে এইচএসসিতেও চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। একই বছর কৃতী ছাত্র হিসেবে তিনি কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণ পদক লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন এবং বিসিএস (স্বাস্থ্য) সহকারী সার্জন পদে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নাক, কান, গলা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক। তাঁর স্ত্রী ডা: আনিশা রাব্বী জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনী)।
তৃতীয় সন্তান রাশেদা রওনক খান। তিনি জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে বিএসএস ওএমএসএস-এ প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তিনি রেকর্ড মার্কস পেয়েছিলেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। এছাড়াও তিনি একজন দর্শকপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা ও সফল উপস্থাপক।

চার.
ত্রিরতœ হিসেবে চিহ্নিত উপরিউক্ত সন্তানদের জননী প্রফেসর জোহরা আনিস শুধু একজন রতœগর্ভা মা-ই নন, তিনি নিজেও স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল একজন মহীয়সী নারী ছিলেন। বলা যায়, তিনি নিজেও একজন রত্ন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। ষাট ও সত্তর দশকের উত্তাল দিনগুলোতে দেশপ্রেমী হিসেবে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। নারী শিক্ষা, উন্নয়ন, সমাজসেবা ও জনকল্যাণে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।
ছাত্রনেত্রী জোহরা আনিস কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের (১৯৬৭-১৯৬৮) মহিলা মিলনায়তন সম্পাদিকা ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি এ কলেজের বাংলা বিভাগের সাহিত্যপত্র- উন্মেষ এরও সম্পাদিকা ও কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ শিক্ষক পরিষদের যুগ্ম সম্পাদিকা ছিলেন। তিনি কুমিল্লা জেলা মহিলা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পরবর্তী সময়ে (১৯৮৪ সনের ২৩ অক্টোবর গঠিত জাতীয় মহিলা সংস্থা কুমিল্লা জেলা কার্যনির্বাহী কমিটি) এর সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ফাতেমা-কুদ্দুস ফাউন্ডেশন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর সভাপতি, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের সহ-সভাপতি ও ইউনাইটেড কমার্স ক্লাব কুমিল্লার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
এছাড়াও তিনি কুমিল্লা পূর্বাশা ও মধুমিতা কচিকাঁচার মেলা, নারী প্রগতি, এডলপসহ বিভিন্ন সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি জাতীয় মহিলা সংস্থা, বাংলাদেশ লেখক সমিতি, ওল্ড ভিক্টোরিয়ান্স, সাহিত্য পরিষদ, জেলা জনসংখ্যা নিয়ণÍ্রণ পরিষদ, পূরবী সমাজ কল্যাণ সংস্থা, কুমিল্লা অন্ধকল্যাণ সমিতিসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি জুলিও ক্যুরি বঙ্গবন্ধু শান্তি সংসদ, কেন্দ্রীয় কমিটি (২০১৭-২০২০) এর সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর অর্থাৎ মৃত্যুর পরদিন শুক্রবার প্রফেসর জোহরা আনিসের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় কুমিল্লা টাউন হল মাঠে। দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয় মরহুমার স্বামীর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরে। ওখানেই তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়।
কুমিল্লার কৃতী নারী প্রফেসর জোহরা আনিসের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন, ত্রিরত্ন গর্ভা জননী হিসেবে ‘রতœগর্ভা মা’ সম্মাননা পুরস্কার ও উষসী পদক-২০১৫ প্রাপ্তি সর্বোপরি বেগম রোকেয়া পদক অর্জন কুমিল্লার শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যেমন আনন্দের তেমনি কুমিল্লার প্রতিটি দেশপ্রেমী সন্তানদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। ব্যক্তিক দিক থেকে জোহরা আপার অচিনপুরে পাড়ি দেয়া বেদনাদায়ক। অমায়িক ব্যবহার- মাথায় হাত রেখে আদর করার সেই আপাকে ভোলা যাবে না। তিনি আদর্শের প্রতীক ‘রত্ন’ হিসেবেই অন্তরে বেঁচে থাকবেন।

লেখক: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।