রবীন্দ্রভক্ত শিবুসাওয়া এইইচির মূল্যায়ন– প্রবীর বিকাশ সরকার

প্রবীর বিকাশ সরকার: 

Promoting Public Interest without Pursuing Private Interest: Eiichi Shibusawa

জাপানের আধুনিক পুঁজিবাদের জনক বলে কথিত শিবুসাওয়া এইইচি ছিলেন মেইজি মহাসংস্কারের যুগে আধুনিক জাপান গড়ার অন্যতম প্রধান অগ্রদ‚ত। তার জীবনেতিহাস পাঠ করলে জানা যায় জীবদ্দশায় তিনি ৫০০ ছোট-বড় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা এবং উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শিল্পপতি হিসেবে নিজেও একাধিক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের ছিলেন কর্ণধার।

পরিকল্পিত দশ হাজার ইয়েন নোটে শিবুসাওয়ার ছবি

জাপানের প্রথম জাতীয় ব্যাংক দাইইচি কোকুরিৎসু গিনকোও যা বর্তমানে অন্যতম প্রধান ব্যাংক মিজুহো ব্যাংক নামে সুপরিচিত তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রায় দেড়শ বছর আগে। আজকের টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ, নিহোন কেইজাই দাইগাকু (জাপান ইকোনোমিক ইউনিভার্সিটি); জাপানের প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় (নিহোন জোশি দাইগাকু), ইম্পেরিয়াল হোটেল, জাপান রেড ক্রস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা-পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন। তাছাড়া আরও যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো বর্তমান সেসব হল:

Mizuho Financial Group, The 77 Bank, Tokio Marine & Nichido Fire Insurance Co., Imperial Hotel, Tokyo Stock Exchange, Tokyo Gas, Toyobo, Keihan Electric Railway, Taiheiyo Cement, Oji Paper Company, Sapporo Breweries, NYK Line, and the Gyeongin Railway and the Gyeongbu Railway in Korea তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠালাভ করে।

জাপান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিও তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হাসপাতাল, স্কুল, কলেজসহ নানা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়ে তিনি ছিলেন সবসময় আগ্রহী ও সাহায্যকারী।

তিনি যৌবনে চীনা কনফুসিয়ান মতবাদ ও জাপানের ইতিহাস শিক্ষালাভ করেন। মেইজি সরকারের প্রতিনিধি হয়ে আমেরিকা ও য়োরোপ ভ্রমণ করে প্রভ‚ত উদ্বুদ্ধ হন এবং ফিরে এসে আধুনিক জাপান নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। কিছুদিন তিনি সরকারের আমলা হিসাবেও নিয়োজিত ছিলেন। শিল্পপতি হিসেবে তিনি ‘জাইবাৎসু’ বা ÔIndustrial and financial business conglomerates  প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন অনায়াসেই, কিন্তু আগ্রহী ছিলেন না, তাঁর নীতি ছিল: নিজের স্বার্থ নয়, সাধারণ মানুষের উন্নতি। এই আপ্তবাক্যই ছিল তাঁর সময়কার অন্যান্য প্রভাবশালী জাইবাৎসু যেমন মিৎসুবিশি, মিৎসুই, ইয়াসুদা, ফুরুকাওয়া, ওকুরা, আসানো, সুমিতোমো প্রভৃতি থেকে আলাদাভাবে তাঁকে চেনার বৈশিষ্ট্য।

আধুনিক নগর উন্নয়নে তাঁর ছিল প্রখর দ‚রদৃষ্টি। ১৯২৩ সালে ভয়াবহ মহাভ‚মিকম্পে টোকিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তিনি এক বছরের মধ্যে নতুন টোকিও গড়ে তোলার স্বার্থক রূপকার ছিলেন। ১৯২৪ সালে তৃতীয়বার জাপান ভ্রমণে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোথাও কোনো ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাননি বলে রবীন্দ্রগবেষক প্রয়াত কাজুও আজুমা একবার আমাকে বলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গই যখন এলো, বলতে হয় তাঁদের মধ্যে গভীর জানাশোনা ছিল। নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ছিল গভীর। তিনিই কবিকে প্রথম জাপান ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান তৎকালীন সরকারের নির্দেশে বলে কথিত আছে। তখন শিবুসাওয়া ‘জাপান-ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন’ এর তৃতীয় প্রেসিডেন্ট। ১৯১৬ সালে কবিগুরু জাপানে আসেন এবং বিপুল সংবর্ধনা গ্রহণ করেন শিবুসাওয়ার আসুকায়ামা (টোকিওর ওওজি রেলস্টেশন সংলগ্ন) বাগানবাড়িতে। এরপর ১৯২৪ এবং ১৯২৯ সালেও কবিকে তাঁর বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান তিনি। দুজনে মিলিত হন এবং মতবিনিময় করেন।

‘ভিসকাউন্ট’, ‘ব্যারন’ ইত্যাদি উপাধিপ্রাপ্ত শিবুসাওয়া এইইচি শুধু একজন সফল পুঁজিপতি বা ব্যবসায়ীই ছিলেন না, শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ, নারীশিক্ষার প্রতি আত্মিক তাগিদ এবং আধ্যাত্মিক শান্তিবাদের কারণেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এরকম ঘটনা জাপান বা এশিয়া কেন, সারাবিশ্বেই বিরল বলে প্রতীয়মান হয়।

এই বছর ২০২০ এর মে মাসে জাপানের নতুন সম্রাটরূপে যুবরাজ আকিহিতো অভিষিক্ত হয়েছেন। নতুন যুগের নাম হয়েছে ‘রেইওয়া’ÑÑযার অর্থ ‘বিউটিফুল হার্মোনি’ বাংলায় ‘মধুর ঐক্যতান’, সেইসঙ্গে আগামীতে বদল হতে যাচ্ছে জাতীয় কাগুজে মুদ্রায় মুদ্রিত প্রতিচ্ছবি। এইবার সর্বোচ্চ মূল্যমান ১০০০০ ইয়েনের নোটে আলোচ্যমান শিবুসাওয়া এইইচির ছবি মুদ্রিত হবে।

দ্বিতীয় বৃহৎ মুদ্রা ৫০০০ ইয়েনের নোটে মেইজি যুগের বিশিষ্ট নারী শিক্ষাবিদ, শিল্পপতি ও আমলা ৎসুদা উমেকো (১৮৬৪-১৯২৯) এবং ১০০০ ইয়েনের নোটে একই যুগের বিখ্যাত চিকিৎসা গবেষক ও ব্যাকট্রিওলোজিস্ট কিতাসাতোও শিবাসাবুরোও (১৮৫৩-১৯৩১) এর ছবি মুদ্রিত হবে। উল্লেখ্য যে, ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য কিতাসাতোও’র নাম প্রস্তাবিত হয়েছিল।

আরও উল্লেখ্য যে, আধুনিক জাপানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, পুঁজিবাদের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা এবং বিশ্বখ্যাত কেইওগিজুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ফুকুজাওয়া ইউকিচি (১৮৩৫-১৯০১) ১৯৮৪ সাল থেকে ১০০০০ ইয়েনের নোটে বিদ্যমান। ৪০ বছর পর তাঁর স্থলে শিবুসাওয়া এইইচি আত্মপ্রকাশ করবেন। আশা করা যাচ্ছে ২০২৪ সালে নতুন মুদ্রা বাজারে চালু হবে।

ভাবতে ভালো লাগছে যে, এই মহান মানুষটির সঙ্গে বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর বন্ধুত্ব ছিল যা বৃহত্তর বাঙালি জানেই না। আমার সৌভাগ্য যে, তাঁদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে একাধিকবার নিবন্ধ লিখতে পেরেছি।

 

লেখক:  শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক