রাহুল, স্মৃতিময় মুখ– প্রবীর বিকাশ সরকার

এক এক করে আমাদেরকে ত্যাগ করছেন চিরতরে প্রিয় মানুষরা। বৃহত্তর কুমিল্লার কিংবদন্তি পুরুষ ভাষা সংগ্রামী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্রবধূ সুপরিচিত মুখ প্রতীতি দত্ত ১২ জানুয়ারি, ২০২০, রোববার আমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। কুমিল্লার অনেক ঘটনার তিনি ছিলেন জ্বলন্ত সাক্ষী। তাঁর ছেলে রাহুল আমার বাল্যকালের বন্ধু। তাকে নিয়েই এই নিবন্ধ।

 

আমার জাপান প্রবাসী হওয়ার (১৯৮৪) কয়েক বছর আগেই তিনি ছেলে রাহুলকে নিয়ে মেয়ে—অ্যারোমা গুণের কাছে চলে গিয়েছিলেন। কুমিল্লার বাড়িটি খালিই পড়ে থাকত। একই পাড়া—ধর্মসাগর পশ্চিম পাড়ে বেশ কয়েক বছর ছিলাম। তখন তাঁর ছেলে রাহুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তবে তারও আগে যখন শৈশবে ছোটরা থেকে ধর্মসাগর দিঘির রাস্তা ধরে ফরিদা বিদ্যায়তন স্কুলে যেতাম তখন প্রতিদিনই দেখতাম সে জানালার শিক ধরে একা দাঁড়িয়ে আছে বাইরের দিকে চেয়ে। বালক মনে প্রশ্ন জাগত কেন? কেন সে আমাদের মতো স্কুলে যায় না? আমরা কয়েকজন বালক-বালিকা রাহুলদের বাড়ির সম্মুখে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বিনিময় করতাম। বাড়ির সম্মুখের রাস্তা দিয়ে চলাচল করার সময় হাত বাড়িয়ে ডাকত সে মানুষজনদেরকে এবং আমাদেরকে দেখলেও। মাঝেমাঝে ফটক খুলে বানান্দায় উঠে জানালার কাছে গিয়ে কথা বলতাম। সিনেমার সে ছিল অসম্ভব ভক্ত! মামা স্বনামধান্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক বলে কথা! বাবা বিখ্যাত সাংবাদিক, লেখক ও অভিনেতা সঞ্জীব দত্ত। তাঁদের রক্ত বহমান রাহুলের শরীরে। সিনেমার গল্প বললে খুবই খুশি হত সে। মাঝেমাঝে সিনেমার জনপ্রিয় গান গেয়ে শোনাত আমাদেরকে। আমার বাবা একবার আমাকে বলেছিল, রাহুলকে আবিষ্কার করে পৌর উদ্যানে টুপি মাথায় শুক্রবারে অসহায়ভাবে সে ঘুরছিল বাসা খুঁজে পাচ্ছিল না। বাবাই তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। তখন আমরা রাহুলদের প্রতিবেশী। মাসিমা মনে হয় দুপুরবেলা ঘুমিয়ে ছিলেন অমনি সুযোগ বুঝে সে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। এটা সে মাঝেমাঝে করত। আমরাও তাকে বাসায় পৌঁছে দিতাম, কখনো কখনো মাসিমাই পাড়ায় খুঁজতে বের হতেন। অবশ্য কখনো কখনো তাকে নিয়ে আমরা ধর্মসাগর দিঘি সংলগ্ন উদ্যানে বেড়াতে যেতাম, কখনো কখনো কান্দিরপাড়ে মন্টুদার পত্রিকা বিক্রির দোকানে নিয়ে গেলে “চিত্রালী”, “সিনেমা” ইত্যাদি কাগজ দেখে উন্মাদ হয়ে যেত! এক কপি কিনে দিলে পরে শান্তি এবং শব্দ করে পড়তে পড়তে বাসায় ফিরত।

রাহুল দত্ত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সেই শৈশব থেকেই। তার ওপর ১৯৭১ সালের মার্চে কুমিল্লার বাড়ি থেকে যখন পাকিস্তানি মিলিটারি তার দাদু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কাকা দিলীপ দত্তকে ধরে নিয়ে যায় গাড়িতে উঠিয়ে, দাপাদাপি করে ল-ভ- করে দেয় বাড়িটা তখন সে ভয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। সেই ভয় তার মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছ তা আর না বললেও চলে। এভাবেই অপরিণত মানস নিয়ে সে মায়ের আঁচল ধরে বড় হয়েছে।

বাবা সঞ্জীব দত্ত তো অনেক আগেই কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। দেশে থাকলে তাঁকে মেরে ফেলার সম্ভাবনা ছিল রাজনৈতিক কারণে বলে আমরা সেই কৈশোরেই জেনেছিলাম। বাড়িতে থাকতেন প্রতীতি দত্ত দুই ছেলেমেয়ে, দেবর ও শ্বশুরকে নিয়ে। মার্চ মাসের ২৯ তারিখ রাতে যখন পাকসেনারা ধীরেন দত্ত ও তাঁর ছেলে দিলীপ দত্তকে ধরে নিয়ে যায়, তখন প্রতিবেশীদের পরামর্শে বাড়ি ছেড়ে দু-একদিন পালিয়ে থাকেন। তারপর আরোমা দত্ত অসীম সাহসের সঙ্গে মা ও ভাইকে নিয়ে গোমতী নদী পেরিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যেতে সক্ষম হন। সেখান থেকে যান কলকাতায় যতখানি জানি।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের দিকে আমার বাবা ছোটরা কলোনী ছেড়ে ধর্ম সাগর পাড়ে চলে আসে। বন্ধু, সহকর্মী আইনজীবী গোলাম মর্তুজা চৌধুরীর দ্বিতল বাড়ি “নূর মহলে”র নিচতলা ভাড়া নেয়। সেই থেকে রাহুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা। মাঝেমাঝে তাদের বাসায় গিয়ে কথা বলতাম, সঙ্গ দিতাম। আবার মাঝেমাঝে মাসিমাকে বলে ধর্মসাগরের পাড় সংলগ্ন উদ্যানে নিয়ে যেতাম বিকেলবেলা। চানাচুর, বাদাম এটা সেটা খেতাম। সে গান গেয়ে শোনাত আমাদেরকে হাস্কি স্বরে। তার একা বাইরে যাওয়া ছিল সম্পূর্ণ নিষেধ। তবুও মাঝেমাঝে মাকে ফাঁকি দিয়ে কান্দিরপাড় চলে যেত খবরের কাগজ বিক্রির স্টলে না হয় সিনেমা হলে। সাপ্তাহিক চিত্রালী, সিনেমা তার ছিল খুব প্রিয় পত্রিকা। আর দীপিকা অথবা লিবার্টি সিনেমা হলে গিয়ে শোকেসের ভেতরে লাগানো সিনেমার স্টিল ছবি দেখত দাঁড়িয়ে দাাঁড়িয়ে। চোখে পড়লে তাকে ধরে নিয়ে আসতাম বা পরিচিত কেউ বাসায় পৌঁছে দিত।

সত্তর দশকের শেষদিকে যখন মাসিমা চলে গেলেন ঢাকায় তখন খালি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আমিসহ একই পাড়ার প্রতিবেশী স্বপন সেনগুপ্ত, তাপস পাল, শদতল রায় সরকার ও বিষ্ণু সাহা মন খারাপ করে রাহুলের কথা বলাবলি করতাম। মাসিমা মাঝে মাঝে এলেও দিন কয়েক থেকে আবার চলে যেতেন। যখনই আসতেন জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে কুমিল্লার বিখ্যাত মানুষরা এসে সাক্ষাৎ করতেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর জীবিতকালে কত বিখ্যাত ব্যক্তিরা এই বাড়িতে পা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এসেছিলেন। ১৯৮৪ সালে জাপানে চলে এলে পরে আর দেখা হয়নি মাসিমা ও রাহুলের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা ছিল স্বপনদের। পাশাপাশি বসবাস বহু বছর ধরে। স্বপনের সঙ্গে দারুণ অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব রাহুলের। মাসিমা প্রায়শ রাহুলকে নিয়ে স্বপনদের বাসায় যেতেন, গল্প করতেন স্বপনের মায়ের সঙ্গে। তাপসদাদের বাসায়ও যেতেন। তাপসদারা ছিলেন রাহুলদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী।

জাপানে আমি যখন “মানচিত্র” কাগজ প্রকাশ করি নব্বইয়ে তখন প্রতীতি দত্ত তথা মাসিমার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মঞ্জুরুল আজিম পলাশ। সেটা প্রকাশ করেছিলাম আমি। সম্ভবত, এরকম সাক্ষাৎকার মাসিমা আর কোনো কাগজে কখনো দিয়েছেন বলে আমার অন্ততপক্ষে জানা নেই। বাদুরতলাস্থ পলাশদের বাড়ির পেছনেই রাহুলদের বাড়ি। বারান্দাওলা এরকম টিনের বাড়ি এই শহরে খুব একটা চোখে পড়েনি আমার। শূন্য দশকের প্রথম দিকে ২০০৬ সালে মাত্র দিন কয়েকের জন্য কুমিল্লায় গিয়েছিলাম। তখন দেখতে পেলাম বাড়িটি ভেঙে পড়ছে। কেউ দেখার নেই! দারুণ মনোকষ্ট চেপে জাপানে ফিরে এসেছি। এরপর মাঝেমাঝে কুমিল্লায় গেলে দেখতাম বাড়িটি ক্রমশই ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে। কোনো প্রকার যতœআত্তি নেই, সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নেই। তারপর ভাঙতে ভাঙতে এখন একেবারে বস্তির ঘরের চেয়ে নিদারুণ জরাজীর্ণ চেহারা নিয়েছে! ভাবা যায় অতবড় একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তির বাড়িটি অযতœ, অবহেলায় আজ বস্তিতে পরিণত হয়েছে! অথচ হওয়ার কথা ছিল একটি স্মৃতি জাদুঘর। হয়নি আজও। জানি না এর জন্য কে দায়ী? কিছু মূল্যবান স্মৃতি তো আমারও আছে এই বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে।

  • ২০১১ থেকে ২০১৪ এর মাঝে বেশ কিছুদিন কুমিল্লায় ছিলাম আমি তখন পুরনো পাড়ায় বেড়াতে গেলে বিধ্বস্ত বাড়িটি দেখে কী যে বেদনাহত হতাম তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। কত স্মৃতি যে মনের মধ্যে ভিড় করত! বড় বড় দুটি চোখ, লম্বাটে মুখবিশিষ্ট রাহুলকে মনে পড়ত খুব গভীরভাবে।

একদিন আমার মনে হল রাহুলকে তো কেউ চেনে না, অথচ বিখ্যাত একজন মানুষের পৌত্র সে! আমার উচিত তাকে নিয়ে কিছু একটা করা! কেননা উপমহাদেশখ্যাত “ঘটক” পরিবারের সে একজন বংশধর! রাহুলের মা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন! রাহুলের দাদু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তও তো বিস্মৃতপ্রায় একজন মানুষ! তার বাবা তুখোড় সাংবাদিক সঞ্জীব দত্ত তো আরও আগে থেকেই দেশবিবাগী। রাহুলের বাবা ও দাদুকে কয়েকবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার শৈশবে ও কৈশোরে। শৈশবে রাহুলকে দেখা সেই মর্মস্পর্শী দৃশ্যটা আজও আমি ভুলতে পারিনি! যখন ছোটরা থেকে আমরা কয়েকটি ছেলেমেয়ে দল বেঁধে ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়স্থ উদ্যানের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফরিদা বিদ্যায়তন ও মডার্ন স্কুলে যেতাম, তখন দেখতে পেতাম রাহুল জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তখন সে আমাদের মতো বয়সী। পেছনে তার মা দাঁড়িয়ে আমাদেরকে দেখতেন। রাহুল তো স্কুলে যেত না। আমাদেরকে দেখে কখনো চিকন কণ্ঠে, কখনোবা হাস্কি কণ্ঠে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত। সেই দৃশ্যটি আমার মনে গেঁথে রইল চিরকালের জন্য। রাহুল মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে স্কুলে যেত! হৈ চৈ করত, খুনসুটি করত, দৌড়াদৌড়ি করত মাঠে, পার্কে, স্কুলের প্রাঙ্গণে। মাসিমা কি সেই স্বপ্ন দেখেননি, নিশ্চয়ই দেখেছিলেন। সব মায়েরাই তা দেখে থাকেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করেনি কোনোদিন।

২০০৭-৮ সালের দিকেই হঠাৎ করে একদিন মনে হয়েছিল, রাহুলকে পরিচয় করিয়ে দেয়া জরুরি তরুণ প্রজন্মের কাছে। বাবাকে, দাদুকে, মামাদেরকে তো কিছু না কিছু মানুষ চেনে, জানে কিন্তু তাকে তো কেউ চেনে না, জানে না! রাহুলের মধ্যে যে বেঁচে আছেন ভাষা সংগ্রামী অকুতোভয় এক বীর বাঙালি—শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত! বেঁচে আছেন মুক্তিযুদ্ধের উষালগ্নের একজন শহীদ তার কাকা দীলিপ দত্ত। রাহুলকে নিয়ে কি একটি উপন্যাস লিখতে পারি না যাতে তার সঙ্গে স্মরিত হবেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত! কিন্তু নানা কাজের চাপে সেটা লেখার সময় পাইনি। একসময় ভুলেও গেলাম যেন ব্যস্ততার কারণে।

২০১৪ সালে যখন জাপানে হঠাৎ করেই ফিরে আসতে হল, তখন একদিন সন্ধেবেলা রাহুলদের পরিত্যক্ত বিধ¦স্ত ভুতুড়ে বাড়িটির কাছে গেলাম। মনে হচ্ছিল কে যেন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। অন্ধকারে আবছায়া বাড়িটির দিকে তাকিয়ে আমার দুচোখ ভিজে এলো সহসা। বুকের ভেতরে অবহ একটা পাথরের অস্তিত্ব যেন টের পেলাম। সেভাবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে এলাম বাসায়। তারপর জাপানে।

জাপানে ফিরে এসে কিছুতেই সুস্থির থাকতে পারছিলাম না। একটা উপন্যাসের পটভূমি ঘুরপাক খেতে লাগল মনের মধ্যে। ব্যস্ততার মধ্যেই লিখতে বসলাম এবং একসময় লিখে শেষ করলাম, নাম দিলাম ‘রাহুল’। সেটা ২০১৫ সালে ঈদের আগে দৈনিক জনকণ্ঠের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক স্বনামধন্য সাংবাদিক ও লেখক স্বদেশ রায় দাদাকে খুলে বললাম, তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, পাঠিয়ে দিন। সে বছর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হল। বুকের ভেতরে থাকা অস্বস্তিকর পাথরটি নেমে গেল। তারপর ১৯১৬ সালে সুনামগঞ্জের উদীয়মান প্রকাশনা সংস্থা “চৈতন্য প্রকাশন” প্রকাশ করল গ্রন্থাকারে উপন্যাসটি। কিন্তু কেন যে ঐ সালে বইটি বইমেলায় প্রকাশক আনল না, বা প্রচারও করল না সে রহস্য হয়েই রইল আমার কাছে! অনেকেই গ্রন্থটি খুঁজছেন কিন্তু কোথাও পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করে চলেছেন এখনো আমাকে।
“রাহুল” উপন্যাসটি রাহুলকেই দেয়া হয়নি আজও। মাসিমাও দেখে যেতে পারলেন না। অনেক বছর পর দেখা হলেও মাসিমা আমাকে চিনতে পারতেন বলে মনে হয় না। রাহুলও কি আমাকে স্মরণে রেখেছে? আমার চেহারায় কত পরিবর্তন এসেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না!
অসামান্য প্রতিভাধর ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন প্রতীতি দত্ত তিনি নিজেও স্বগুণে গুণান্বিতা ছিলেন। সবসময় শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন। বেশবাসেও ছিলেন সাধাসিধে। কুমিল্লার রাজনীতি ও সংস্কৃতির কিংবদন্তি-পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে তিনিও কিংবদন্তিতুল্য প্রতীতি দেবী। সমাজসেবী আরোমা দত্তের গর্বিত জননী। খ্যাতিমান উপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবীর পিসি। প্রতীতি দত্ত যমজ ভাই ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে লিখেছেন স্মৃতিকথা “ঋত্বিককে শেষ ভালোবাসা”, একটি অসামান্য দলিল। সংসারে মাসিমা তথা প্রতীতি দত্তই ছিলেন অকৃতদার রাহুলের একমাত্র নির্ভরশীল জায়গা ও ছায়া। সেই রাহুলও এখন আমার মতোই বার্ধক্যে উপনীত। প্রাণপ্রিয় মাকে ছেড়ে সে কীভাবে দিন কাটাচ্ছে ভাবতে গিয়ে বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠছে আমার!

উপন্যাসের শেষ দৃশ্যটি এই মুহূর্তে সামনে এসে জ্জ্বলজ্বল করছে:
“স্বর্ণ আমার ডান হাতটি শক্ত করে ধরে কলোনীর কম্পাউন্ডে ঢুকল। রাহুলদের বাসার দিকে হেঁটে যেতে যেতে বলল, রাহুলের কথা ভেবে আমাকে ভুল বোঝো না। রাহুল একটা চিরশিশু। আমার তোমার মাঝখানে সে একটি সেতু হয়ে থাকুক আমি চাই। রাহুলকে ভুলে গেলে আমরা ঠাকুরদা তথা বাংলাদেশের প্রথম ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকেও ভুলে যাব। জাতি মনে না রাখুক, এই মানুষটি যেন আমাদের মধ্যে, আমাদের বংশধরদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকতে পারেন। তাঁর আলোকে যেন আমাদের সন্তানদেরকে সত্যিকার বাঙালি করে গড়ে তুলতে পারি। সেখান থেকে শুরু হোক আমাদের সংগ্রাম।…..আর আমাদের ছেলে হলে তার নাম রাখব রাহুল। তুমি কিন্তু না বলতে পারবে না। কারণ রাহুল আমাকে মুক্তি দিয়েছে। সে আমার মুক্তিদাতা। রাহুল না থাকলে তোমাকে পেতাম না। পেতাম বলো? তাহলে ওকে কেন ভুলে যাব? তারও তো অধিকার আছে আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকার। রাহুল চিরকাল জড়িয়ে থাকুক আমাদের ভালোবাসায়…….

স্বর্ণকে কিছু বলার আগেই দেখলাম বারান্দায় লোহার জালির ওপাশে শিউলি ঝাড়ের আড়ালে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘদেহী একটি মানুষ।
সে রাহুল। আমাদেরকেই দেখছে।”

 

শিশুসাহিত্যিক কথাসাহিত্যিক ও গবেষক