কুমিল্লা বিভাগ : সময়ের ন্যায়সঙ্গত দাবি

 

মনোয়ার হোসেন রতন।।

বাংলাদেশ—এই রক্তে রাঙানো ভূখণ্ড, যার প্রতিটি জেলা একেকটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের গৌরবময় প্রতীক। ঠিক তেমনি এক জনপদের নাম কুমিল্লা। প্রাচীন ঐতিহ্য, শহীদদের আত্মত্যাগ, সাংস্কৃতিক মহিমা, প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও অর্থনৈতিক অবদান—সব দিক থেকেই কুমিল্লা আজ আরেকটি দাবির কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। এই দাবি হলো, “কুমিল্লা বিভাগ চাই”—একটি সময়ের, যুক্তির, ইতিহাসের এবং উন্নয়নের পক্ষের ন্যায়সঙ্গত দাবি।

যারা কুমিল্লাকে চেনেন, তারা জানেন—এটি একটি অনুভবের নাম, একটি অঞ্চল নয় শুধু, এটি আত্মপরিচয়ের দাবি তুলে ধরা এক গর্বিত ভূখণ্ড। আর তাই, কুমিল্লাকে বিভাগ ঘোষণার দাবি যেন জাতির বিবেকের সামনে এক পরীক্ষা, রাষ্ট্রচিন্তার সামনে এক বাস্তব প্রশ্ন।

ঐতিহাসিক পরিচয়: অতীতের শক্ত ভিত্তি

কুমিল্লা নামটি এসেছে প্রাচীন “কমলাঙ্ক” বা “কামালানগর” থেকে, যা গৌড়-বঙ্গের অংশ হিসেবে বহু শাসকের হাত ঘুরে এক সমৃদ্ধ সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। ময়নামতি, শালবন বিহার, রুপবান মুরা—এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো শুধু বাংলাদেশের গর্ব নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশের একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরগুলোর অন্যতম “ময়নামতি যাদুঘর” এখানেই অবস্থিত, যা বোঝায়—এখানে অতীতের গৌরব কতটা দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চল শুধু স্থাপত্যের ঐতিহ্যে নয়, বরং চিন্তা, শিক্ষা ও ধর্মীয় সহনশীলতার ক্ষেত্রেও ছিল এক আদর্শ কেন্দ্র।

মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের স্মৃতি

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা ছিল পূর্বাঞ্চলের অন্যতম সংগঠিত যুদ্ধঘাঁটি। মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং শহীদদের আত্মত্যাগের অসংখ্য দলিল এখনও এখানে বয়ে চলেছে। কুমিল্লা শুধু স্বাধীনতা অর্জনে অবদান রাখেনি—এই স্বাধীন দেশের কাঠামোতে তার যথাযথ স্থান চেয়েছে, এখনো চায়।

অর্থনীতি, জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক যুক্তি

আজকের কুমিল্লা শুধু একটি প্রশাসনিক জেলা নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক হাব। এখানে রয়েছে কুমিল্লা ইপিজেড, বিস্তীর্ণ কৃষি উৎপাদন, কারিগরি ও হস্তশিল্প শিল্প এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান।

কুমিল্লাকে কেন্দ্র করে যে ছয়টি জেলা নিয়ে একটি বিভাগ গঠিত হতে পারে তা হলো:

  • কুমিল্লা
  • চাঁদপুর
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়া
  • নোয়াখালী
  • ফেনী
  • লক্ষ্মীপুর

এই ছয় জেলার সম্মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি, যা দেশের বিদ্যমান অনেক বিভাগকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই অঞ্চলের জনগণ প্রতিনিয়ত চট্টগ্রাম বা ঢাকায় সরকারি সেবা নিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কুমিল্লা বিভাগ হলে, প্রশাসনিক সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে, উন্নয়ন হবে ত্বরান্বিত, আর জনগণের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে।  

সাংস্কৃতিক গৌরব ও আত্মপরিচয়

কুমিল্লা কেবল রাজনীতি বা প্রশাসনের নয়, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাট্য ও লোকজ সংস্কৃতির আধার। এখানেই নজরুল গবেষণা কেন্দ্র, জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি, শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠের পরশ। “কুমিল্লার রসমালাই”, “পাঁপড়”, “খাজা”—এইসব শুধু খাদ্য নয়, এটি এক একটি সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি।

কুমিল্লার গান, কবিতা, নাটক ও সাহিত্যচর্চা আজও মফস্বলের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে স্থান করে নিচ্ছে। এই আত্মপরিচয়কে প্রশাসনিক মর্যাদায় সম্মান জানানোই হবে জাতিগত সংস্কৃতির প্রতি ন্যায়বিচার।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত: ব্রাজিলের বিকেন্দ্রীকরণ দর্শন

আমরা যদি দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্র ব্রাজিল-এর দিকে তাকাই, দেখি ২৬টি রাজ্য ও ১টি ফেডারেল জেলা নিয়ে গঠিত একটি ফেডারেল কাঠামো, যেখানে প্রতিটি অঞ্চল তাদের ইতিহাস, অর্থনীতি ও ভৌগোলিক গুরুত্ব অনুযায়ী স্বতন্ত্র রাজ্য মর্যাদা পেয়েছে। ব্রাজিল সরকার উপলব্ধি করেছে, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ নয়, বিকেন্দ্রীকরণই উন্নয়নের চাবিকাঠি। বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে?

কুমিল্লা বিভাগ গঠনও তেমনি এক নৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ সিদ্ধান্ত, যেখানে জনগণ প্রশাসনের কাছে যাবে না, প্রশাসনই জনগণের কাছে যাবে।

কুমিল্লা বিভাগ একটি রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োজন

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা আর পিছনে ফিরে তাকাতে পারি না। আমরা দেখতে পাই—চুয়াডাঙ্গা, নেত্রকোনা, মেহেরপুর, বান্দরবান—এমন অনেক ছোট জেলা জেলা হিসেবেই সম্মান পাচ্ছে। অথচ শতাব্দীর প্রাচীন কুমিল্লা এখনো বিভাগের স্বীকৃতি পায়নি? এটি কেবল একটি অবিচার নয়, এটি রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দায় থেকে সরে যাওয়া।

“কুমিল্লা বিভাগ” এখন আর দাবির বিষয় নয়, এটি সময়, যৌক্তিকতা ও ন্যায়বিচারের অপরিহার্য বাস্তবতা। এটি জনগণের ন্যায্য অধিকার, ইতিহাসের স্বীকৃতি এবং উন্নয়নের গন্তব্য।

হে রাষ্ট্রনায়কগণ, হে নীতিনির্ধারকগণ!

একটি প্রাচীন জনপদ আজ তার আত্মমর্যাদা চায়, তার নামকরণে এক নতুন বিভাগ চায়। এ দাবি পূরণ করো, কারণ—

“কুমিল্লা বিভাগ”—এটি কেবল অঞ্চলভিত্তিক আহ্বান নয়, এটি এক জাতির বিবেকের প্রশ্ন।

inside post
আরো পড়ুন