শেখ শফিকুর রহমান; প্রগতির আলোকে বাস্তবতার নিরিখে যে জীবন

 

মোতাহার হোসেন মাহবুব

শেখ শফিকুর রহমান। ছাত্রজীবনে যাকে একজন প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে দেখেছি। যাকে ‘শফিক ভাই’ বলে ডেকেছি। তাঁর সাথে পরিচয় করে দিয়েছিলেন কুমিল্লা অজিতগুহ মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুর রউফ। রউফ ভাইয়ের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে ১৯৬৯ সালে। আমি সবেমাত্র ইউসুফ বহুমুখী কারিগরী উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। রাজনীতি বুঝে ওঠার বয়স তখন হয়ে ওঠেনি। তবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে বাঙালিদের শোষণ করছে তা বুঝতে পারতাম। বিশেষ করে আমাদের দেশে উৎপাদিত কাগজ যখন পশ্চিম পাকিস্তানে ৪ আনা দিস্তা ও আমাদের কিনতে হতো ৬ আনা দিস্তায়। অবশ্য এসব কথাগুলো তখন ছাত্রনেতৃবৃন্দের কাছে থেকেই শুনেছি। ১৯৬৮ সালে আইউব বিরোধী আন্দোলনের পরপরই ৬৯-এ অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। রউফ ভাই রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বক্তৃতা- বিবৃতি দিচ্ছেন। রউফ ভাই আমি পাশাপাশি এলাকার বাসিন্দা। কান্দিরপাড় থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর পিছু পিছু চকবাজার পৌঁছে বিদায় নিয়ে, নূরপুরে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে বাকি পথটুকুর সহযাত্রী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা অধ্যাপক জালাল উদ্দিন। জালাল ভাইয়ের বাড়ি নূরপুর দক্ষিণ পাড়ায় আর আমার উত্তর পাড়ায়। চকবাজার তেরিপট্টিতে বিদায় নেয়াকালে রউফ ভাই হাত নেড়ে বলতেন, ‘কাল আবার দেখা হবে’। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, ইউসুফ হাই স্কুলে ভর্তির ৮-৯ মাস পরই আমি ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত হই। কুমিল্লা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক মো: ওমর ফারুক তখন ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি। জিএস ছিলেন মাসুদুর রহমান মাসুদ। যার বাড়ি কাটাবিল। তিনিও আমার প্রতিবেশী ছিলেন। আমি ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থকÑ রউফ ভাই তা জানতেন। কিন্তু এ নিয়ে আমাকে কখনো প্রশ্ন করেননি। শেখ শফিক ভাইয়ের সাথে আমাকে যখন পরিচয় করে দিয়েছিলেন তখন তিনি মুচকি হেসেছিলেন। রউফ ভাইয়ের সেই হাসির রহস্য পরে বুঝতে পেরেছি। এ নিয়ে এ মুহূর্তে কথা বলছি না। অধ্যক্ষ মোঃ আবদুর রউফ ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ও অধ্যাপক জালাল উদ্দিন ২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। মাসুদ ভাইও আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন।

 

 

দুই.
বলছি, অধ্যাপক শেখ শফিকুর রহমানের কথা। পরিচয়ের পর তাঁর সাথে যখন দেখা হয়েছে তখন কুশলাদির পরিবর্তে সাংগঠনিক বিষয়াদি নিয়েই বেশি কথা হয়েছে। তাঁর কর্মতৎপরতার মুগ্ধ হয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে বলতেন, “কর্মই মানুষের আসল পরিচয়। যারা শ্রমজীবী মানুষকে ‘অশিক্ষিত’ বলে গালি দেয় তাদের আমি ঘৃণা না করলেও এড়িয়ে চলি।” কর্মীদের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা অনস্বীকার্য। পোশাক-পরিচ্ছদে, আচার-আচরণে তিনি সাদামাটা জীবন-যাপন করেছেন।

কুমিল্লায় প্রগতিশীল আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরি হয়েও বাস্তবতার নিরিখে জীবন ও জীবিকার টানে কিছুটা পিছু হটেছেন অধ্যাপক শেখ শফিকুর রহমান। তবে দমে যাননি। মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে মুঠোফোনে কথা বলার সময় বলেছিলেন, ‘আমরা যা পারিনি তা আপনাদের সম্পন্ন করতে হবে।’ বলা বাহুল্য, জীবনের শেষ ক’টা দিন তিনি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নিজেকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ধর্মান্ধ ছিলেন না। এ কারণে কেউ কেউ তাঁর সমালোচনা করলেও আমি জানি, অজিতগুহ মাহবিদ্যালয়ের বর্তমানে ভাষাসৈনিক অজিতগুহ মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শেখ শফিকুর রহমান তথা গ্রগতিশীল এ মানুষটির অন্তর্বিপ্লবের কথা। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি এ মানুষটি একদিন একটি বেসরকারি কলেজের একজন অধ্যক্ষ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘মাহবুব, খেয়াল করেছেন কিছু সংখ্যক কলেজ শিক্ষক সব সরকারের আমলেই চামচাগিরির জোরে রাজনীতি ও সংস্কৃতি অঙ্গনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কুমিল্লায় সরকারি বেসরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। লেখাপড়া জানা সত্বেও তাদের মতো এমন বেলেল্লাপনা মানুষ কম দেখেছি।’ শফিক ভাইয়ের একথা শুনে বলেছিলাম, লেখাপড়া জানা থাকলেই শিক্ষিত মানুষ হওয়া যায় না। প্রয়োজন মানবিকতার উৎকর্ষতা। আরও বলেছিলাম, প্রমথ চৌধুরীর অনেক আপ্তবাক্যের মধ্যে একটি হলো: ‘সুশিক্ষিত মানুষ মাত্রেই স্বশিক্ষিত।’ যা ওই শিক্ষকরা জানেন না। শফিক ভাই বেশ কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। ১০ বছর আগে অচিনপুরে পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ওই কথাটি আজও মনে আছে। হায়রে মানুষ। নেতৃত্বের লোভে তোমরা কতটা নিচে নামতে পারো। নেতৃত্বের মোহে শফিক ভাই প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন নি। তিনি বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়ন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তবে কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত।

 

তিন.
বিশ্বখ্যাত দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল তাঁর প্রণীত ‘দি কনকোয়েষ্ট অব হ্যাপিনেস’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই অকারণ ভীরুতা অনাবশ্যকভাবে ঝঞ্ঝাট বাড়িয়ে তোলে। জনমতকে যারা ভয় করে, জনমত তাদের পীড়ন করে বেশি। যারা ভয় করে না, উদাসীন থাকে তাদের সে বিশেষ কিছু করতে পারে না। যারা কুকুর দেখে ভয় পায়, কুকুর তাদের দেখে বেশি ডাকে এবং তাদের দংশনে তৎপর হয়। কিন্তু যারা তাচ্ছিল্য করে তাদের সে বিশেষ কিছু করে না। মানুষের চরিত্রেও অনেকটা এই বৈশিষ্ট্য আছে।’

বরেণ্য ছাত্রনেতা শেখ শফিকুর রহমান বলতেন, ‘আমাদের দেশে প্রগতিশীলতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং বর্তমানে যে দ্বিদলীয় আধিপত্য ভিত্তিক জনমত তা দূরীভূত করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। আমরা তা-ই বলি, আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক।’

 

নীতিবান রাজনীতিবিদ শফিক ভাই আপনি জীবৎকালে যেসব কথা একান্তে বলেছেন তা আজও আমাদের অনুরণিত করে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে আপনি যেমন খানিকটা অসহায়ত্ববোধ করেছেন তেমনি আমরাও- যারা প্রগতিশীলতাকে ধারণ-লালন করি। বিশ্বাস করি, একদিন জয় আমাদের হবেই।

 

২০১২ সালের ১৩ এপ্রিল অধ্যাপক শেখ শফিকুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘদিন পরে তাঁর স্মরণে একটি স্মারকলিপি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে তাঁর ভাই কমরেড শেখ আবদুল মান্নান ও স্মরণ পর্ষদের সদস্য মেহের ডিগ্রি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক রাহুল তারুণ পিন্টুকে সাধুবাদ জানাই। জয়তু প্রগতি।

 

 

লেখক: কবি, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।