সবার আগে কর্মসংস্থানের রোডম্যাপ চাই

মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশে যখনই নির্বাচনের বাতাস বইতে শুরু করে, তখন সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যন্ত গমগম করতে থাকে একটি শব্দ— “নির্বাচনের রোডম্যাপ চাই!” রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করে, সংলাপের প্রস্তাব আসে, বিদেশি কূটনীতিকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়—সব মিলিয়ে পুরো জাতি নির্বাচন এবং ক্ষমতার হিসাব-নিকাশে মগ্ন হয়ে পড়ে।
কিন্তু এই আলোচনার মধ্যে একটি বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীর কণ্ঠ নিস্পৃহ—তারা কোনো দলের পক্ষ বা বিপক্ষে নয়, তারা ভোটের মাঠে লড়াই করে না, বরং তারা যুদ্ধ করে জীবনের সঙ্গে। তারা জীবিকার রোডম্যাপ খোঁজে, নির্বাচন নয়। এরা হল— দেশের কোটি তরুণ বেকার, যারা একটি সম্মানজনক কাজের আশায় দিন গুনছে।
নির্বাচন নয়, জীবনের রোডম্যাপ দরকার
নির্বাচনের রোডম্যাপ মূলত রাজনৈতিক শক্তিসমূহের জন্য—এটি গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় অপরিহার্য। কিন্তু যারা ভোট দেয়, সেই সাধারণ মানুষ—বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জীবনের জন্য রোডম্যাপ কোথায়? একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, অন্যদিকে বাস্তব জীবনে কাজের সুযোগ নেই। একজন কৃষকের মেধাবী সন্তান যখন ঢাকা বা চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে, তার সামনে থাকে না কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। একজন কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন যুবক অথবা তরুণ উদ্যোক্তা—তাদের জন্য কি রাষ্ট্র কোনো সমন্বিত কর্মসংস্থানের রোডম্যাপ তৈরি করেছে?
জাতি গঠনের প্রথম শর্ত—চাকরি ও জীবিকার নিশ্চয়তা
বিশ্বের যেসব রাষ্ট্র দ্রুত উন্নয়ন করেছে, তারা প্রথমে সমন্বিত মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়—তারা রাজনৈতিক মতভেদকে পেছনে ফেলে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান, দক্ষতা উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের রোডম্যাপ তৈরি করেছে। আজ তাদের বেকারত্বের হার নগণ্য। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে—এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কোন স্বপ্নে এগোচ্ছি?
নির্বাচন যেমন জরুরি, তেমনি মানবিক উন্নয়ন আরও জরুরি। যে যুবক তিন বছর ধরে চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে, তার কাছে নির্বাচনের স্লোগানগুলো অর্থহীন। ভোটের অধিকার তখনই অর্থবহ হয়, যখন পেটে ভাত থাকে, পকেটে কিছু আয় থাকে, এবং মাথার ওপর নিরাপদ ছাদ থাকে।
চাই জাতীয় বেকারত্বমুক্তকরণ রোডম্যাপ
আমরা কেবল দাবি নয়, বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ চাই—যেখানে দেশের প্রতিটি মানুষ অন্তর্ভুক্ত হবে। তাই আমাদের প্রয়োজন:
জাতীয় কর্মসংস্থান কমিশন: একটি স্বতন্ত্র কমিশন, যা দেশের কর্মসংস্থানের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করে অঞ্চলভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবে।
প্রতিটি জেলায় ‘কর্মসংস্থান হাব’ গড়ে তোলা: যেখানে তথ্য, প্রশিক্ষণ, ফান্ড এবং সুযোগ একসাথে পাওয়া যাবে।
কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষার আধুনিকীকরণ: সিলেবাস হবে শিল্পক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী, যাতে ডিগ্রি মানেই চাকরির প্রস্তুতি হয়।
উদ্যোক্তা উন্নয়ন ফান্ড ও স্টার্টআপ প্রণোদনা: ব্যাংক, এনজিও এবং রাষ্ট্রীয় সহায়তায় তরুণদের উদ্যোগ গড়ে তুলতে উৎসাহ দিতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি সবখাতে কর্মসংস্থান পরিকল্পনা বাধ্যতামূলক: প্রতি বছরে কতজনকে চাকরি দেওয়া হবে—তা বাজেটের অংশ হতে হবে।
রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব
রাষ্ট্র যদি তার যুব সমাজকে অবহেলা করে, তাদের দক্ষতা ও স্বপ্নকে মূল্য না দেয়, তবে এই যুবকরাই একদিন রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। তখন আর কেবল ভোট নয়, সমাজ কাঠামোই ঝুঁকিতে পড়বে।
নির্বাচনের রোডম্যাপ দরকার, তবে তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন জীবনের রোডম্যাপ। যেখানে একজন যুবক তার মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে দেশের জন্য কিছু করতে পারে, নিজের পরিবারকে বাঁচাতে পারে। আমাদের দাবি—এখন সময় রাজনীতি নয়, কর্মসংস্থানের রাজনীতি করার। এখন সময় মাইক নয়, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিনিয়োগ বাড়ানোর। এখন সময় মিছিল নয়, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ উদ্যোক্তা তৈরির।
কারণ ভোট দিয়ে মানুষ নেতা বেছে নেয়, আর কর্মসংস্থান দিয়ে মানুষ বাঁচে।
inside post
আরো পড়ুন