বাজার থেকে দার্শনিক হয়ে ফেরা!

মনোয়ার হোসেন রতন।।
পৃথিবীর ইতিহাসে একেকজন মনীষী এসেছেন, ভেবেছেন, বলেছেন—আবার নিঃশব্দে চলে গেছেন। আর আমরা, যারা এখনো বেঁচে আছি, প্রতিদিন বাজারে যাই—দামে হাহাকার করি, ব্যাগ ভরাই পণ্যে, আবার ফাঁকা হই চিন্তায়। ভাবুন তো একবার—যদি সক্রেটিস আজ নিউমার্কেটে হাঁটতেন, প্লেটো যদি বসুন্ধরার সুপারশপে গিয়ে দামের ট্যাগ দেখতেন, কিংবা অ্যারিস্টোটেল যদি রাস্তায় রাস্তায় ‘ফ্ল্যাশ সেল’ খুঁজে বেড়াতেন—তাহলে দৃশ্যপটটা কেমন হতো?
সেই বিখ্যাত সক্রেটিসের গল্প নতুন করে শুরু হোক।
একদিন সক্রেটিস বাজারে গেলেন। কিছু কিনবেন না—এই ছিল সংকল্প। বাজারে ঢুকেই থমকে গেলেন। পণ্যের পাহাড়, রঙের বাহার, অফারের বন্যা! একটি দোকানে ঝলমলে লেখায় লেখা—’Buy One, Get One Free!’ সক্রেটিস মৃদু হেসে বললেন, ‘যা প্রয়োজন, তা কিনছি না—আর যা দরকার নয়, তা ফ্রি! জীবন তো যেন ছাড়ের নামে দিশাহীন।’
হাঁটতে হাঁটতে ঢুকলেন এক কাপড়ের দোকানে। বিক্রেতা বলল, ‘স্যার, এটা লাস্ট পিস! আজ না নিলে আজীবন আফসোস করবেন।”
সক্রেটিস জবাব দিলেন, ‘ভালো কথা! আমি যদি এই কাপড় না নিই, তাহলে কি জীবন থেমে যাবে? যে জীবনের স্থায়িত্ব মৃত্যুর থেকেও কম নিশ্চিত, তার জন্য ‘লাস্ট পিসে’ এত উত্তেজনা কেন?’
অবশেষে কিছুই না কিনে বাড়ি ফিরলেন।
বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী কিনলে?”
সক্রেটিস হেসে উত্তর দিলেন, ‘আমি শিখে এলাম—এই পৃথিবীর অধিকাংশ জিনিস ছাড়াও জীবন চলে।’
প্লেটো বললেন, ‘শিক্ষক, আপনি তো বাজার থেকে দর্শনের নতুন অধ্যায় নিয়ে ফিরেছেন!’
অ্যারিস্টোটেল কড়া যুক্তি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘এ তো প্রকৃত ‘অভিজ্ঞতাবাদ’, শিক্ষক!”
এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতা আজও অটুট।
আমরা বাজারে যাই প্রয়োজনে নয়, চাহিদার চাপে। একটা টুথব্রাশ কিনতে গিয়ে ফিরি এক ঝুড়ি শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, ফেসপ্যাক আর গরুর দামে উচ্চরক্তচাপ! জিনিস কিনি একটা, ব্যাগ ভরে দশটা। কারণ—’লিমিটেড স্টক’! জীবনের স্টক নেই, অথচ জুতার স্টকের জন্য ভোরবেলা লাইনে দাঁড়াই।
‘ফ্ল্যাশ সেল’—এ যেন এক মনস্তাত্ত্বিক বিস্ফোরক—শুনলেই আমরা হুঁশ হারাই।
আসলে আমাদের আধুনিক সমাজ পণ্যের ভিড়ে হৃদয়শূন্য হয়ে পড়ছে। মোবাইলের ক্যামেরা ২০০ মেগাপিক্সেল, তবু তাতে মানুষকে দেখা যায় না। ফ্রিজে ফলের জায়গা নেই, ঠাসা কোল্ড ড্রিংকসে।
আর বারান্দায় শাকসবজির বদলে ঝুলছে ‘ফেয়ারি লাইট’। ঘর আলোয় ঝলমল, কিন্তু মন অন্ধকার।
মাইকেল এঞ্জেলোর সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে—’Every block of stone has a statue inside it. আজ যদি তিনি শপিং মলে যেতেন, হয়তো বলতেন—’Every shopping cart has a burden inside it.’ কারণ আমরা শুধু পণ্য কিনি না—কিনে ফেলি ভবিষ্যতের কিস্তি আর বর্তমানের হাহাকার।
প্রকৃতপক্ষে, জীবনের প্রয়োজন খুব সামান্য।
সক্রেটিসের সেই বাজার যাত্রা ছিল আত্মজিজ্ঞাসার অনুশীলন—যেখানে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ‘ত্যাগই শ্রেষ্ঠ ভোগ।’
আর আমরা আজ যা করছি—তা যেন ‘ভোগে ত্যাগ’।
এই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আজ আমি এক আধুনিক সক্রেটিস হতে বাজারে গিয়েছিলাম— যে কিনা বাজারে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘এই চটকদার লোভের মধ্যেও আমি সংযমের ঘ্রাণ খুঁজেছি। আমরা যদি বুঝতে পারি—বাড়িতে দশ জোড়া জুতা না থাকলেও চলে, তিনটা শ্যাম্পু ছাড়াও মাথা ধোয়া যায়, নতুন ফোন না হলেও সম্পর্ক টিকে থাকে—তবেই হয়তো সত্যিকারের মুক্তি সম্ভব। এরপর গিয়েছিলাম কোরবানির গরু কিনতে। ভাবলাম, ভালো একটা গরু কিনে স্বস্তিতে ফিরব। কিন্তু হাটে ঢুকেই মনে হলো—এটা কি গরুর হাট, না সামাজিক প্রতিযোগিতার মঞ্চ?
কার গরু বড়, কার দাম বেশি, কার সাজসজ্জা চোখধাঁধানো—সব যেন এক জীবন্ত নাটক! একটা গরুর গায়ে হাত রাখতেই শুনি, ‘এটা মিডিয়াম রেঞ্জ, আরও ভালো দেখতে পারেন।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো মানে কী?’
উত্তর এলো, ‘যার ছবি তুলে ফেসবুকে দিলে ভাইরাল হয়!”
মনে মনে ভাবলাম—সক্রেটিস যদি আজ এই হাটে থাকতেন, নিশ্চয় বলতেন-‘কোরবানি আত্মত্যাগের নাম, আত্মপ্রদর্শনের নয়।’
অবশেষে গরু না কিনেই ফিরলাম।
বাসায় এসে বললাম—’এই হাটে গরু ছিল, দাম ছিল, প্রতিযোগিতা ছিল—কিন্তু ছিল না ত্যাগের সুবাস।’ সেদিন সক্রেটিসের সাথে দেখা না হলেও, তাঁর দর্শন যেন ছুঁয়ে দিয়ে গেল।
সবশেষে বলি—সাধারণ মানুষ বাজার থেকে পণ্য নিয়ে ফেরে, সক্রেটিস ফিরেছিলেন সত্য, শিক্ষা আর শান্তি নিয়ে। আজকের বাজারে পণ্য আছে, অফার আছে, চমক আছে—কিন্তু নেই শান্তি। কারণ, আমরা প্রাচীন মনীষীদের মতো চিন্তা না করে, আধুনিক বিলবোর্ডের মতো ভাবি।
তাই বলি—চলো, সক্রেটিসের মতো একদিন বাজারে যাই, কিছু না কিনে ফিরে আসি—
ভরে আনি আত্মার ঝাঁপি। পণ্য ছাড়াও জীবন চলে, কিন্তু ভাবনা ছাড়া জীবন চলে না।
