সমৃদ্ধ লেখায় ভরপুর সত্তর যাত্রা সংখ্যা

|| রফিকুল ইসলাম সোহেল।।
দেশের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক আমোদ’র ৭০ বছর পদার্পণ উপলক্ষে সাপ্তাহিক আমোদকে কেন্দ্র করে কিছু আবেগঘন , স্মৃতিচারণমূলক ও তথ্যবহুল লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে । সেই সব গুণী লেখকদের লেখা থেকে আমার ভালো লাগা অংশগুলো তুলে ধরলাম।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর আনোয়ারুল হক এখনও ‘আমোদ’ পত্রিকা হাতে নিলে সেই পুরনো গন্ধ পান। সে সময়ে ‘আমোদ পত্রিকাটিকে ঘিরে চোখে লেখক, কবি হবার স্বপ্ন এবং প্রেসের কালির গন্ধ মনে হতো সুগন্ধের মতো। ঐ সময়ের প্রেসের নানাবিধ কাজের সামগ্রীক চিত্রটা লেখকের কাছে ছিল প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো। সাপ্তাহিক আমোদ নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, শৈশবে স্কুলের বিরতিতে মোগলটুলি নানার বাসায় মাটির হাড়িতে নানির হাতের অনাস্বাদিত টমেটোর খাট্টা খেয়ে স্কুলে ফিরার সময় ‘আমোদ প্রেসের ক্রাডেল ছাপা মেশিনের ঘটাং ঘটাং মোহ সৃষ্টি করা সেই আওয়াজকে কেন্দ্র করে সেই কর্মযজ্ঞ ঐ সময়ে ঐ বয়সের বালকটির কাছে এর চেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক ঘটনা আর কিছু ছিলনা। লেখক শিক্ষক না হলে সাংবাদিক হতেন কারণ ‘আমোদ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর মতো মানুষ, সম্পাদকদের দেখেই পেশাজীবনে সাংবাদিকতাকেও একটি স্বাধীন, সৎ,পরিছন্ন এবং আকর্ষণীয় একটি পেশা বলে মনে হয়েছে। শিক্ষাবিদ ও নজরুল গবেষক ড. আলী হোসেন চৌধুরী বলেন, আমার সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি আমোদে। বন্ধু মুকুলের দুর্ঘটনাজনিত অকাল মৃত্যুতে ভীষণভাবে শোকাহত হন তিনি। বড়দের সহযোগিতায় বন্ধুরা মিলে মুকুলের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলেন। পরবর্তীতে ইউসুফ হাই স্কুলে মাধ্যমিকে পড়ার সময়‘মুকুল স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট’ শিরোনামে তার করা সংবাদ আমোদে প্রকাশিত হয়। আমোদ’র সাপ্তাহিক সংবাদপত্র হিসাবে আলোকিত অগ্রযাত্রা ও শৈশবেই আমোদের সাথে যুক্ত হওয়ার স্মৃতি লেখককে আজও আমোদিত করে। সাংবাদিকতার প্রথম গুরুই জনাব ফজলে রাব্বী। তার ভদ্র ব্যবহার উৎসাহ বাক্যসমূহ তাকে প্রাণিত করেছিল। সংবাদ লেখার বিষয়ে তার উপদেশ পরামর্শ সাংবাদিকতার প্রথম প্রণোদনা। লেখক বলেন, আমোদ আমাকে সাংবাদিকতার কলমটা ধরিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে এ কলমটা আমাকে চালিয়ে নিয়ে গেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারের কুমিল্লা প্রতিনিধিসহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করার মধ্যে দিয়ে। তিনি মনে করেন আমোদ ইতিহাসের একটি অধ্যায় যা কালের যাত্রা পথে সময়ের চিত্র ধারণ করে আছে। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট বলেন, আজ কুমিল্লার দুইজন বিরল কিন্তু অভিজাত অমায়িক ভদ্রলোক সম্বন্ধে আলোকপাত করবার জন্য কলম ধরেছি। তাঁরা হলেন কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক ‘আমোদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী আমাদের প্রিয়জন রাব্বী ভাই ও আমার জ্যেঠামশাই সর্বজন শ্রদ্ধেয় বাদুরতলার সিংহ প্রেস-এর স্বত্ত্বাধিকারী এবং দেশের অন্যতম প্রাচীন গ্রুপ থিয়েটার দ্য গ্রেট ভার্ণাল থিয়াটার-এর সভাপতি অরুণ কুমার সিংহ। তিনি ছিলেন দেশের কোন সংবাদপত্রের প্রথম মহিলা সম্পাদক এবং কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত এ অঞ্চলের প্রথম সংবাদপত্র সাপ্তাহিক “ত্রিপুরা হিতৈষী”-কর্ণধার উর্মিলা সিংহের বড় ছেলে। দু’জনই প্রেস মালিক ছিলেন। ষাটের দশকে, কুমিল্লায় নিষিদ্ধ পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি সমর্থিত প্রেস শ্রমিক ইউনিয়ন বেশ শক্তিশালী ছিল। অতি সাধারণ কারণে অকারণে শ্রমিক নেতা সত্যনারায়ণ দাশের নেতৃত্বে অঘোষিত ধর্মঘট ডেকে কুমিল্লার সব ছাপাখানায় কাজ বন্ধ করে দিতো। একবার কুমিল্লার প্রেসগুলো এমনি অঘোষিত ধর্মঘটে পড়ে আশির দশকে। তবে সনটা সঠিক মনে করতে পারছিনা। কিন্তু, কুমিল্লাবাসী হতবাক হয় একটা আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখে। আমোদ প্রেসে কম্পোজ ও প্রিন্ট সবই চলছে। যথারীতি নির্দিষ্ট দিনে সাপ্তাহিক আমোদ প্রকাশিত হয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র পত্রিকাটির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সম্পাদক রাব্বী ভাই, তাঁর সহধর্মিনী, একমাত্র ছেলে এবং তিন কন্যার সব্বাইকেই একটা একটা টাইপ গেঁথে কম্পোজিটিং স্টিকে সাজিয়ে কিভাবে কম্পোজ করতে হয় তা তালিম দিয়েছিলেন বলেই। তিনি তাদের ছাপার জন্য ছোট ট্রেডেল মেশিন কিভাবে চালাতে হয় তাও শিখিয়েছিলেন। তারা সবাই খুঁটিনাটি কাজ করে প্রেসটি সচল রেখেছিলেন আপদকালীন সময়ে। যেটি পারিবারিক সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি অনন্য উদাহরণ। দু’জনের আভিজাত্য, কথাবার্তা, চালচলন, ব্যবহার ও পোষাকপরিচ্ছদে এক অদ্ভূত সামঞ্জস্য বা মিল ছিলো। সব্বাই তাঁদের দু’জনার মধুর, নিরহঙ্কারী ও ভদ্রজনোচিত অমায়িক ব্যবহারে বিমোহিত হয়েছেন। আমি গর্বভরেই বলছি, অনেকজনকেই বলতে শুনেছি, “এমন ভদ্রলোক এ জীবনে আর দেখিনি”। ফজলে রাব্বী ভাই-এর কাছ থেকে যারাই সাংবাদিকতায় ন্যূনতম টিপস্ পেয়েছেন বা প্রশিক্ষণের সুযোগ লাভ করেছেন তারাই পরবর্তীতে নামকরা সাংবাদিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। তেমনি অরুণ কুমার সিংহের সাহচর্যে যারাই এসেছেন তারাই পরর্বর্তীতে সফল সংগঠক বলে গণ্য হয়েছেন । প্রথম আলোর সাবেক নিজস্ব প্রতিবেদক, জনাব নাসির উদ্দিন নেতিবাচক সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উল্লেখ করেন ঢাকায় নিউজ সিন্ডিকেট আছে। কোন এঙ্গেল থেকে কিভাবে ঘটনা দেখানো হবে সেই ফর্মুলা নিয়ে ঐকমত্য তারা। কারণ এই ফরমায়েশে ভায়াগ্রার উত্তেজনা থাকে। কখনো কখনো সর্বোচ্চ কর্তাই উত্তেজক গেলেন। সেই উত্তেজনায় রাষ্ট্রকে জ্ঞান দিতে পলিসি মেকার বনে যান। শব্দচয়ণে তাকে ভাঁড় দেখায়। তাকে টেনে নিতে হয় অধীনস্থকে। দেশে এখন ভোতা অস্ত্রের এই কাগুজে দাপট চলছে। এতেই ভাব এবং ভাত দুই-ই মিলে। সমাজপাঠে এজন্য সাংবাদিকতা এখন লজ্জা এবং ঘৃণারও। এই প্রতিবন্ধী ক্রিমিনালের। ভবিষ্যৎ কি? এর দায় কে নেবে? সভ্যতার সাথে অসভ্যতার এই সমান্তরাল বসবাস থামাবে কে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বায়তুল্লাহ্ কাদেরী বলেন, আমোদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী তার বর্তমান মানসগঠন পর্যায়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। লেখক কলেজ জীবনে কবিতার প্রেমে পড়ে লেখাপড়া ছেড়ে শুধু কবিতা লেখা ও সংবাদপত্রে কাজ করার তীব্র আকাঙ্ঘা ব্যক্ত করেন জনাব ফজলে রাব্বীর কাছে । বিনয়ের সাথে লেখক তাকে জানান তিনি আর পড়াশুনা করতে চান না। পত্রিকায় কাজ করতে চান। কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চান। তিনি তার সব কথা শুনলেন। তাকে বোঝালেন, জীবন-জীবিকা এবং লেখালেখির জন্য প্রভূত জ্ঞান প্রয়োজন। তার লেখাপড়া বন্ধ করা ঠিক হবে না। আরো বললেন, বরং তুমি যদি কাগজে সংবাদ পাঠাও আমি মানসম্মত হলে ছাপবো। তবে তোমার পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে নয়। মনে হলো, এমন স্নেহমাখা, অভিভাবকতুল্য পরামর্শ আমাকে আর কেউ দিতে পারতো না। তাঁর পরামর্শ আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। কুমিল্লার শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে লেখককে পরিচিতি পেতে সহায়তা করার জন্য রূপসী বাংলার সম্পাদক কবি ওহাব স্যার ও সাংবাদিক আবুল হাসানাত বাবুলের তিননদী পরিষদকে তার লেখায় স্মরণ করেন। তিনি বলেন, আমোদকে আশ্রয় করে একদা আমার সাহিত্যযাত্রা শুরু হয়েছিল, আজো আমি সেই পথেই আছি। দেশে বিদেশে বহু পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপা হয়েছে। কিন্তু আমোদে কবিতা ছাপার যে শিহরণ আমি আর কখনো পাই না। কুমিল্লা দেবিদ্বারের সিনিয়র সাংবাদিক এবিএম আতিকুর রহমান বাসার বলেন, ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কোর মূল্যায়নে,-দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি আঞ্চলিক পত্রিকার মধ্যে একসময়ের এক আনা মূল্যের চার পৃষ্ঠার এ ‘আমোদ’ পত্রিকাটি সম্মানার অন্তর্ভুক্তিতে স্বীকৃত হয়েছিল। আমোদ স্থান করে নিয়েছে এদেশের প্রথম সারির পত্রিকা সংবাদ, ইত্তেফাক ও অভজারভারের পাশাপাশি। আমোদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ১৯৯৪ সালের ২৮ নভেম্বর মারা যান। তার মৃত্যুর পূর্ব থেকেই অর্থাৎ ১৯৮৫ সাল থেকে আমোদের দায়িত্ব নেন তার সহধর্মিণী শামসুননাহার রাব্বী ও ছেলে বাকীন রাব্বী। পারিবারিক ভিত্তিতে পত্রিকা চালানোর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমোদ। প্রথমদিকে বৃহত্তর নোয়াখালী এবং সিলেটেও আমোদ-এর সার্কুলেশন ছিল। মানুষের ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে জাতীয় জীবনের বিশেষ মুহূর্তেও আমোদ কান্ডারীর ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে ৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাংবাদিক মাসুক আলতাফ চৌধুরী বলেন, জীবন ও জগত জানার তীব্র আকাঙ্খা বা বাসনা থেকেই জন্ম নেয় চিন্তার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার বাহনই হচ্ছে সংবাদ- গণমাধ্যম। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দাবি সর্বজনীন। আর গণমাধ্যমের প্রাণ সাংবাদিক। রাষ্ট্র, গোষ্ঠী, শ্রেণি- ব্যক্তিমানুষ সংবাদ সৃষ্টি করে। সেই সংবাদ একজন সাংবাদিক উপস্থাপন করেন মাত্র। সৃষ্ট সংবাদ নিজেই একটি পক্ষ। প্রকাশিত সংবাদ কারো পক্ষে কিংবা কারো বিপক্ষে যায়। পক্ষে গেলে সাংবাদিক হন সমাদৃত আর বিপক্ষে গেলে সাংবাদিক প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। সাংবাদিকতা হচ্ছে সাংবাদিকের কাজ। ওই কাজই ব্যক্তি সাংবাদিককে প্রতিপক্ষ বানায়। প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিক হচ্ছে সমাজের বন্ধু। সমাজ ও ব্যক্তির যে কোন আপদকালীন সময়ে সকলের পাশে থাকে সাংবাদিক। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে সাংবাদিক যখন আক্রান্ত হন তখন তিনি পাশে কাউকে পান না। কিশোরগঞ্জ সরকারি গুরুদয়াল কলেজের উপাধ্যক্ষ মেহেদী হাসান বাংলা পত্রিকা : ২০০ বছর আগে ও পরে তুলনামূলক আলোচনায় দেখিয়েছেন- শ্রীরামপুরের মিশনারিরা ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে ‘দিকদর্শন’প্রকাশ করেন। প্রথম বাংলা পত্রিকা। পরের মাসেই তাঁরা প্রকাশ করেন ‘সমাচার দর্পণ । এতে ইউরোপীয় নতুন আবিষ্কারের প্রচুর সংবাদ থাকতো। তবে রাজনীতির মতোই হিন্দু-সমাজের অভ্যন্তরীণ বিষয়ও এড়িয়ে চলা হতো বিতর্ক এড়ানোর জন্য। ‘সমাচার দর্পণ’শুরু থেকে ছিলো চার পৃষ্ঠার একটা ট্যাবলয়েড়। মোট ছাপা হতো ২০০০ শব্দের সম-পরিমাণ নানাবিধ লেখা। শুরুতে তিন কলামে ও পরে দুই কলামে ছাপা হতো বিজ্ঞাপন ও সংবাদগুলো। শুরুতে শিরোনাম ও লেখা সবই একই আকারের হরফে ছাপা হতো।‘সমাচার দর্পণ’ সম্পাদনা করতেন মার্শম্যান। তিনি বাংলা জানতেন। তবে সে জানায় সম্পাদনা করার মতো প্রাজ্ঞতা ও দক্ষতা ছিলো না। এ জন্যে তাঁকে নির্ভর করতে হতো সংস্কৃতজানা পন্ডিতদের ওপর। ‘সমাচার দর্পণে প্রকাশিত সংবাদগুলো দেখে এ ধারণা করা চলে ইংল্যান্ড, ভারতের দাক্ষিণাত্য ও কিছু দেশীয় রাজ্যের খবর বেশি থাকতো। সেকালে কলকাতার ধনী জমিদার, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী দেশীয় বাবুরা সন্তানের অন্নপ্রাশন, পূজা আয়োজন, বিবাহ আয়োজনের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করতেন। পত্রিকাগুলোর হেডলাইন হতো সেসব অনুষ্ঠানের সংবাদ দিয়ে। এখন যেমন‘কোনো নায়িকা একদিনে আটটা আম খেয়েছে . বলে খবর বেরোয়! দুটোই পত্রিকার কাটতির জন্যে। সেকালে যেমন একালেও তেমন আরকি! বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিশেষ প্রতিনিধি শিমুল মাহমুদ বলেন, দেশের প্রাচীনতম বাংলা সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকাটির নেতৃত্ব এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে। লেখক কলেজ ছাত্র হিসাবে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকা থেকে সাংবাদিকতায় দীক্ষা পান । সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমোদ থেকেই। তারুণ্যের সেই কাচা সাংবাদিকতার পাকা ফল দেখে তিনি এখন অনেক পরিণত। সে সময়ে লেখকের স্মৃতি বিজড়িত একটি সংবাদ তাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। তার গ্রামের বাড়িটি ছিল বুড়িচং উপজেলার পশ্চিমে, গোমতী নদীর তীর ঘেঁষা। নদী চলে গেছে সোজা, কিন্তু নদীর বাঁধটি ছিল হাঁসুলি বাকের মতো, প্রায় অর্ধ চন্দ্রাকৃতির। নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বিশাল এই বাঁধটি কোনো কাজে লাগতো না। অন্যদিকে বর্ষায় পানি বাড়লে ঝুঁকি বাড়তো পাড়ের মানুষের। এই অংশে একাধিকবার বাঁধ ভেঙে বিস্তুত এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এই বাস্তবতায় তিনি সেই বাঁধটি সোজা করার জন্য একটি রিপোর্ট লিখেন সাপ্তাহিক আমোদ-এর জন্য। রিপোর্টে বলা হয়, গোমতী নদীর ওই অংশের বাধটি নদী বরাবর সোজা করা হলে বিপুল পরিমাণ আবাদী জমি অবমুক্ত হবে। বাঁধের উপর দিয়ে যাতায়াতে সুবিধা পাবে সাধারণ মানুষ। সাপ্তাহিক আমোদে প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় সেই রিপোর্ট। ওই রিপোর্টের সূত্র ধরেই পরে গোমতী নদীর ওই অংশের বাঁধ সোজা করা হয়। সেই বাঁধ সোজা হওয়ার পর অবমুক্ত জমিতে এখন ফসলের অবারিত মাঠ। পত্রিকায় রিপোর্ট লিখে যে ফল পাওয়া যায় তখন সেটি লেখকের কাছে ছিল বড় চমক। সাপ্তাহিক আমোদ এ রিপোর্ট লিখে অতি দ্রুত তার প্রতিকার পাওয়া যেতো। চিকিৎসক ও পরিবেশকর্মী ডা. আবু নাঈম পারিবারিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বরোপ করেন। কারণ আমাদের শিক্ষার যাবতীয় সুতিকাগার হচ্ছে পরিবার। আমোদ দেশের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক। এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অলেখকের লেখবার সুযোগ হয়েছে। লিখতে গিয়ে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাথে ইঙ্গিত করলেন কাগজের গুরুত্ব কমার সময় এখনো আসেনি। যোগ করলেন যারা পত্রিকা পড়ে তারা আসলেই আধুনিক। তুলে ধরলেন গাছের গুরুত্ব। দেশী এবং বিদেশী গাছের পার্থক্য প্রকাশ করতে গিয়ে লিখলেন পাখি ও বাসা বাঁধতে গিয়ে কিংবা বসতে গিয়ে গাছের গুণগত মান যাচাই করে। কারণ নিজস্ব জিওগ্রাফিক এলাকার গাছ পছন্দ। লেখক দেশের পরিবেশ উপযোগী দেশী ও ঔষধী গাছ লাগানোর বিষয়ে গুরুত্বরোপ করেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন গাছ লাগানো যেন লোক দেখানো না হয়। শুধু গাছ লাগালেই হবেনা ব্যক্তিকে পরিবেশ প্রেমী হতে হবে। সংবাকর্মীদের প্রতি লেখক উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন প্রকৃত পরিবেশ প্রেমীদের খুজে বের করে সবার সামনে নিয়ে আসতে। যাতে ভবিষ্যতে আরো ভালো কাজে আগ্রহ বাড়ে। পাশাপাশি যারা পরিবেশের ক্ষতি করছে তাদের খবর গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। কৈশোরে কবিতার প্রেমী সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় পরিবেশ পদকসহ দুইবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত মতিন সৈকত বলেন, কবিতা ভীষণ ভালোবাসি। তার বাবা এবং বড় ভাই পড়তে ভীষণ ভালোবাসতেন। আলমারি ভর্তি বই ছিল। পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকার ষোলআনা পড়তেন। পত্রিকা পড়ার জন্য বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে রায়পুর অথবা ইলিয়টগঞ্জ চলে যেতেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনার সময় গল্প কবিতার চর্চা শুরু। তিনি এসএসসি পরীক্ষার পরে ১২টি কবিতা দিয়ে কবিতা পত্র প্রকাশ করেন। সে সময়ে তিনি কবিতা লেখার জন্য রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন পত্র পান। পরবর্তীতে আশির দশকের মাঝামাঝি এবং নব্বরইর দশকে বাংলা এবং ইংরেজি নববর্ষ, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরে, দুই ঈদে জাতীয় দৈনিকের বিশেষ সংখ্যার জন্য ছুটে যেতেন বাড়ি থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে দাউদকান্দি ফেরিঘাটে পত্রিকা সংগ্রহের জন্য। বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে চান্দিনা থেকেও অনেক দিন পত্রিকা কিনেছেন। লেখকের তরুণ সময়ে জীবনের পরিক্রমায় বিনোদন হিসেবে সাহিত্যচর্চা, পত্রিকা ও পত্রিকা অফিসের সাথে নিজের যোগাযোগ এতই নিবিড় ছিল যে তিনি যখন বাসায় ফিরতেন তখন রাস্তায় তার সাথে রাতের কিছু অতিথিকে ছাড়া আর কাউকে পেতেন না। চান্দিনা লক্ষ্মীপুর আলিম মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক ও সাংবাদিক মাসুমুর রহমান মাসুদ বলেন সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হয়েছিলাম ২০০৩ সালে। তখন তিনি ছাত্র ছিলেন। তিনি মফস্বল সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সপ্তাহে একটি পত্রিকা বের করা ওই সময়ও বেশ ব্যয় বহুল। বিশেষ করে ভালো মেকআপ ম্যান পাওয়া ভার। কম্পিউটারের ব্যবহার তখনও অতটা সচরাচর হয়ে উঠেনি। সব কম্পিউটার দোকানে ট্রেসিং প্রিন্ট করার মতো লেজার প্রিন্টারও ছিলো না। নিউজ কম্পোজ করার লোকজনও তেমন বেশি পাওয়া যেতো না। কারণ সাংবাদিকরা তাদের চাহিদানুযায়ী টাকা দিতে পারতো না। লেটার প্রেস থেকে সবেমাত্র অফসেট প্রেসের দিকে ঝুঁকছে পত্রিকাগুলো। সব মিলিয়ে নানা চড়াই উৎড়াই পার করে চার পৃষ্ঠার সাদা কালো পত্রিকা সপ্তাহে একবার আলোর মুখ দেখতো। লেখক তার লেখায় সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় পত্র ও নিয়োগ পত্র পাওয়ার যে আবেগ তুলে এনেছেন সত্যিই অনন্য। নিউজ প্রকাশের প্রায় দেড় বছর পর ২০০৫ সালে প্রথম সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র হাতে আসে। আহা ! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। দৈনিক সংবাদের পরিচয় পত্র পেয়েছিলেন কাজ শুরুর তিন বছর পর, ২০০৮ সালে। তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক পরিচয় বেড়ে উঠতে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি। তাদের সহযোগিতায় কিভাবে নৈতিক ও সৎ সাংবাদিক হতে হয় তা শিখেছিলেন। সাংবাদিক তৈয়বুর রহমান সোহেল বলেন, আমোদ ইতিহাস তৈরি করছে, এ পত্রিকার একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে কাজ করতে পরে গর্ববোধ করছি। পত্রিকা সাদাকালো থেকে রঙিন হয়েছে। আকারে পরিবর্তন এসেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও ভালো করছে। সাংবাদিক, সম্পাদনা পর্ষদেও কিছুটা রদবদল হয়েছে, কিন্তু পত্রিকার তেজোদ্দীপ্ততা কমেনি। সাপ্তাহিক পত্রিকা, অথচ টাটকা সংবাদে ভরপুর এমন সংবাদপত্র কুমিল্লায় দ্বিতীয়টি নেই। পত্রিকার পাঠক আমোদে হাত দিয়ে ডুবে যান মধুমাসে। সুদূর আমেরিকায় থেকে পত্রিকাটির সম্পাদনা করছেন জনাব বাকীন রাব্বী। তিনি পত্রিকার সব নিউজ, পত্রিকার মেকআপ যেমনি খেয়াল রাখেন তেমনি আমোদ পরিবারের সাথে যুক্ত সব সদস্যের খোঁজখবরও রাখেন নিয়মিত। পত্রিকাটিকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মহিউদ্দিন মোল্লা। তিনি সারা সপ্তাহ পত্রিকা ফেরি করে বেড়ান। পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারাতেই তার আনন্দ। সাপ্তাহিক আমাদের অফিস রিপোর্টার সাইফুল ইসলাম সুমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে সমাজের নানাবিধ সমস্যা তুলে ধরতেন। পরবর্তীতে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নানা পরিক্রমায় লেখক সাপ্তাহিক আমাদ’র সাথে যুক্ত হয়েছেন। একজন নবীন সাংবাদিকের জন্য এটি উদাহরণ। একাগ্রচিত্তে সাংবাদিকতার মানসিকতাকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন বলেই বিকেলবেলা খেলাধুলা বাদ দিয়ে পত্রিকা পড়তেন। দূর থেকে পত্রিকা কিনে আনতেন। নিয়ম করে রেডিওতে খবর শুনতেন। খাতায় এলাকার সমস্যাগুলো লিখে রাখতেন। সাংবাদিকতার নানা বিষয় বুঝতে যারা সাহায্য করেছেন তাদেরকে কৃতজ্ঞতা চিত্রে স্মরণ করেছেন এই লেখায়। তিনি মনে করেন সাংবাদিকতার মাধ্যমে সকলের উপকার করা যায়। সর্বস্তরের মানুষের সাথে মেশা যায়। তিনি সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানুষের সেবা করে অনন্তকাল মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকতে চান।
হুইলচেয়ার সারভাইভর ও আলোকিত বজ্রপুরের সংগঠকের পরিচয়ে এই লেখকেরও একটি লেখা ছাপা হয়। তিনি বলেন, তিনি শৈশব থেকে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। ঠিক তেমনিভাবে তার সন্তানদের মধ্যেও ছেটেবেলা পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। তার সন্তান যখন তার সামনে পত্রিকা পড়ে তিনি ফিরে পান তার শৈশবকে।
সাপ্তাহিক আমোদ’র ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গুণী লেখকদের লেখা পড়ে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। সেই সুযোগ কওে দেয়ার জন্য আমোদ পরিবারের প্রতি রইল গভীর ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।

লেখক: হুইলচেয়ার সারভাইভর ও সংগঠক, আলোকিত বজ্রপুর।