সাংবাদিকতায় পরিচয়পত্র পাওয়া
।। মাসুমুর রহমান মাসুদ ।।
সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হয়েছিলাম ২০০৩ সালে। তখন সবেমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। ফল পেয়ে অনার্সে ভর্তির অপেক্ষা। চান্দিনায় বাবার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মাসুম অফসেট প্রেসে প্রায়ই বসতাম, বাবার কাজে কিছুটা সহযোগিতা করার জন্য। পরীক্ষা শেষে কয়েক মাস কুমিল্লায় গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখেছিলাম, নিউ মার্কেটে মুকতুল ভাইয়ের ছাপাখানায়। তাঁরই ছোট ভাই আলেক ভাই ছিল আমার প্রশিক্ষক। বর্তমানে তিনি কুমিল্লার অন্যতম প্রাচীন পত্রিকা দৈনিক রূপসী বাংলায় কাজ করছেন।
তো বাবার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ছাপার কাজের জন্য প্রায়ই আসতেন দেবিদ্বারের সাংবাদিক এটিএম সাইফুল ইসলাম মাসুম ভাই। আমি তখন গ্রাফিক্সের কাজ করতাম। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অনার্সে ভর্তি হলাম। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। কলেজ থেকে ফিরে প্রেসেই সময় দিতাম। এটিএম সাইফুল ইসলাম মাসুম ভাই তখন কুমিল্লার আরও একটি সেরা সাপ্তাহিক নিরীক্ষণের বার্তা সম্পাদক। আজকের আপাদমস্তক রাজনীতিক কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আলমগীর কবির ভাই নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন সে সময়। পত্রিকা নিয়ে তাদের দৌড় ঝাঁপ অন্তহীন।
সপ্তাহে একটি পত্রিকা বের করা ওই সময়ও বেশ ব্যয় বহুল। বিশেষ করে ভালো মেকআপ ম্যান পাওয়া ভার। কম্পিউটারের ব্যবহার তখনও অতটা সচরাচর হয়ে উঠেনি। সব কম্পিউটার দোকানে ট্রেসিং প্রিন্ট করার মতো লেজার প্রিন্টারও ছিলো না। নিউজ কম্পোজ করার লোকজনও তেমন বেশি পাওয়া যেতো না। কারণ সাংবাদিকরা তাদের চাহিদানুযায়ী টাকা দিতে পারতো না। বর্তমানে তো বেশির ভাগ মিডিয়া বড় বড় ব্যবসায়ীদের ঘরে জন্ম নেয়। সেই সময় ব্যবসায়ীদের কাছে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া কমই ছিলো। প্রকৃত সাংবাদিকদের হাতেই পত্রিকা বের হতো। ফলে অতো রঙের বাহার ছিলো না।
লেটার প্রেস থেকে সবেমাত্র অফসেট প্রেসের দিকে ঝুঁকছে পত্রিকাগুলো। সব মিলিয়ে নানা চড়াই উৎড়াই পার করে চার পৃষ্ঠার সাদা কালো পত্রিকা সপ্তাহে একবার আলোর মুখ দেখতো। ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলো এর ব্যতিক্রম। আমি বলছি মূলত জেলা শহরের পত্রিকার কথা। এক্ষেত্রে সম্পাদক অর্থ বিত্তশালী হলে তাদের ক্ষেত্রে আমার এ লেখার মর্মার্থ হয়তো কিছুটা গরমিল হতে পারে।
এটিএম সাইফুল ইসলাম মাসুম ভাই আমার গুরু। তিনিই আমাকে সংবাদ পত্রের সাথে সম্পৃক্ত করেন। নিরীক্ষণ আমার প্রথম পত্রিকা যেখানে প্রথম সংবাদ ছাপা হয়। নিরীক্ষণ প্রতি সপ্তাহে প্রকাশ হতো না। অর্থনৈতিক সঙ্কটসহ বিভিন্ন কারণে এক দুই সপ্তাহ ফাঁক রেখে প্রকাশিত হতো। নিউজ প্রকাশের প্রায় দেড় বছর পর ২০০৫ সালে আলমগীর কবির ভাইয়ের স্বাক্ষর করা প্রথম সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র হাতে আসে। আহা ! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। মাসুম ভাই এবং আলমগীর কবির ভাইয়ের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা ও অটুট সম্মান।
হয়তো তাদের মাধ্যমে না হয়ে অন্য কারো মাধ্যমে এই সম্মানজনক পেশায় প্রবেশ করলে বখে যেতে পারতাম। মানুষের কাছে অসম্মানের পাত্র হয়ে উঠতাম। তাদের মধ্যে নীতি নৈতিকতা থাকায় তার কিছুটা ছিটে-ফোঁটা পেয়ে এখনো কিছু মানুষের ভালোবাসা নিয়ে কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
২০০৫ সালের শেষের দিকে দেবিদ্বার প্রেস ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি এবিএম আতিকুর রহমান বাশার ভাইয়ের সহযোগিতায় দেশের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পত্রিকা ‘দৈনিক সংবাদ’ এ কাজ করতে শুরু করি। প্রয়াত প্রথিতযশা সাংবাদিক বজলুর রহমান ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক। লাকসামের কৃতী সাংবাদিক মজুমদার জুয়েল সে সময় পত্রিকাটির মফস্বল সম্পাদক ছিলেন। ২০০৬ সালে পবিত্র রমজান মাসে দেবিদ্বার প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ্ আল মামুন ভাইয়ের সাথে সংবাদ অফিসে গেলে জুয়েল ভাই আমাকে দেখে মজা করে বললেন- ‘আমি কি এই পুচকা ছেলেটাকে চান্দিনা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়েছি ?’ এটাই ছিলো আমার প্রথম জুয়েল ভাইকে এবং সংবাদ অফিসকে দেখা। সেই দৈনিক সংবাদের পরিচয় পত্র পেয়েছিলাম কাজ শুরুর তিন বছর পর, ২০০৮ সালে। বরিশালের মানুষ সিকান্দার ফয়েজ ভাইয়ের সহযোগিতায় প্রখ্যাত সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ভাই নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন তখন। বুলবুল ভাই তাঁর কক্ষে টেবিলের সামনে মুখোমুখি বসিয়ে আমার সাথে কথা বলে সেই পরিচয় পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক শিরোনাম পত্রিকায় কাজ করছি ২০০৪ সাল থেকে। সম্পাদক জনাব নীতিশ সাহা স্বাক্ষরিত কার্ড হাতে পেয়েছিলাম ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েকদিন আগে।
দেশ বরেণ্য ইমেরিটাস সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খাঁন এর দৈনিক আমাদের কুমিল্লায় কাজ করছি ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ থেকে। বার্তা সম্পাদক বন্ধুবর মহিউদ্দিন মোল্লা স্বাক্ষরিত নিয়োগপত্র পেয়েছি ২০১৪ সালের নির্বাচনের কয়েকদিন আগে। একই সময়ে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক স্বাক্ষরিত পরিচয়পত্র পেয়েছি।
বর্তমান সময়ে কতিপয় ব্যক্তি (অন্যদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি) সংবাদপত্রকে তাদের ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। টাকা রোজগারের পথ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বা কোন প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই টাকার বিনিময়ে সাংবাদিকতার পরিচয় পত্র অপাত্রে তুলে দিচ্ছেন। এই পথ থেকে সবাইকে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। সংবাদপত্র একটি দেশ ও জাতির দর্পণ স্বরূপ। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। বিবেকের উপর নির্ভর করেই জাতি এগিয়ে যাবে। আমাদের বিবেক পরিশুদ্ধ হউক। সাংবাদিকদের মান জগতে উচ্চকিত হোক।
শেষ করবো সাপ্তাহিক আমোদের একটি স্মৃতিচারণ করে। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন সাপ্তাহিক পত্রিকা হলো আমাদের তথা কুমিল্লার গর্ব ‘সাপ্তাহিক আমোদ’। বরেণ্য সাংবাদিক প্রয়াত জনাব মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী এই পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। এই পত্রিকা থেকে বের হয়েছেন বহু জ্ঞানী-গুণী সাংবাদিক। দেশের বিভিন্ন নামকরা পত্রিকায় কাজ করছেন তারা। আমারও ইচ্ছে ছিলো এই স্বনামধন্য পত্রিকাটিতে কাজ করার। সে ইচ্ছে একটি বারের জন্যই পূরণ হয়েছিলো। ২০১৩ সালে শ্রদ্ধেয় বাকীন রাব্বী ভাই মায়া করে আমোদে আমার লেখা ছাপিয়ে ছিলেন। বাউল স¤্রাট ও দার্শনিক লালন শাহ্কে নিয়ে আমার লেখা ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন লালন শাহ্’ কলামটি ছেপে দিয়েছিলেন সাপ্তাহিক আমোদ এ। ধন্যবাদ প্রিয় বাকীন রাব্বী ভাই। পত্রিকাটি এখন অনলাইন ভার্সন, ফেইসবুক, ইউটিউব চ্যানেলসহ সব যোগাযোগ মাধ্যমেই সরব হয়ে পাঠকদের নিকট পৌঁছে যাচ্ছে। ‘সাপ্তাহিক আমোদ’ এর অগ্রযাত্রা অবাঁধ থাকুক অসীম যুগ ধরে।
লেখক
সাংবাদিক ও সহকারী অধ্যাপক
লক্ষ্মীপুর আলিম মাদরাসা, চান্দিনা।