সন্তানদের পত্রিকা পড়ার মুহূর্ত উপভোগ করি

।। রফিকুল ইসলাম সোহেল।।
আব্বার চাকরির সুত্রে আমরা কক্সবাজার। ১৯৮০ সালে বড় বোনকে চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা “চিত্রালী” পড়তে দেখি। চলচ্চিত্র এবং চলচ্চিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট বিনোদন বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকাটি আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আমি সিনেমা ভক্ত হয়ে পড়ি। সে সময়ে কক্সবাজার টকি সিনেমা হলে এতিম ছবিটি দেখে আমি হলে বসে কেঁদেছি। (বর্তমানে পরিত্যক্ত)।
১৯৮১ আব্বা বদলি হয়ে চলে আসলেন কুমিল্লায়। বড়ভাই চাঁদপুরের মতলবে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। এস এস সি পাস করার পর আব্বা ওনাকে কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি করে দেন। ভাইয়া কলেজ থেকে ফিরার সময় পত্রিকা নিয়ে আসতেন। পরবর্তীতে হকার বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত।
দৈনিক পত্রিকা হিসেবে দৈনিক ইত্তেফাক আমার প্রথম পত্রিকা। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আমি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সমর্থক। রেডিওতে আবাহনী ও মোহামেডানের খেলার ধারাভাষ্যে শুনতাম। সে বছর আবাহনীর তারকা ফুটবলার সালাউদ্দিনের পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়ে (বর্তমান বাফুফে সভাপতি) গোলরক্ষক মহসিন তারকা খ্যাতি লাভ করেন। পরের দিনের ইত্তেফাকের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম খেলাটির বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে। জীবনের শুরুতে এভাবেই পত্রিকার খেলার পাতাটি দিয়ে পত্রিকা পড়া শুরু করতাম।
আমি মাধ্যমিকে পড়া অবস্থায় বড় ভাই এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মিছিল করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হোন। সে সময়ে পত্রিকায় এরশাদ বিরোধী খবরগুলি বেশি মনে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা রাইফুন বাসুনিয়া হত্যাকা-। মিছিলে ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে সেলিম দেলোয়ারের নিহত হওয়া, “গণতন্ত্র মুক্তি পাক খ্যাত”নূর হোসেন হত্যাকা-, তৎকালীন ড্যাব সভাপতি ডাঃ মিলন হত্যাকা-। তাছাড়াও বাংলাদেশের সংবাদ পত্রের ইতিহাসে প্রায় দুই সপ্তাহের অধিক সংবাদপত্র সম্প্রচার বন্ধ থাকা। একজন নিয়মিত পাঠক হিসেবে সে সময়ে পত্রিকা না পড়তে পারাটা ছিল কষ্টের।
সাপ্তাহিক “যায় যায় দিন” এর জন্য প্রতি মঙ্গলবার অপেক্ষায় থাকতাম। সাপ্তাহিকীটি কিশোর বয়সে আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা রাষ্ট্রপতি এরশাদের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সাহসী সাংবাদিকতা এবং ভিন্ন ভিন্ন দিবসে লেখকই পাঠক এবং পাঠকই লেখক এই নতুন ধারণার সাথে পরিচয় হয়েছিল “যায় যায় দিন” পড়ার মাধ্যমে।
সে সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ক্রীড়া জগৎ এই দুটি সাপ্তাহিকের নিয়মিত পাঠক ছিলাম।
দৈনিক ইত্তেফাকের পর, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলাও পড়া হতো। পরবর্তীতে বাজারে আসা নতুন
পত্রিকাগুলোর গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য পড়া হতো।
কিশোর বয়সে আম্মার সাথে পুরাতন চৌধুরী পাড়ায় আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে গিয়ে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকার সাথে পরিচয়। ২০০৮ সালে দেশের বাইরে যাবার পর কুমিল্লার খবর জানার জন্য ইন্টারনেটে নিয়মিত সাপ্তাহিক আমোদ পড়া হত।
সে সময়র আলোড়ন সৃষ্টিকারী আন্তর্জাতিক কিছু খবরের মধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকা-,ভারতের ভূপালে বিষাক্ত গ্যাস লিক হয়ে প্রায় তিন হাজার লোকের মৃত্যু, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে চেরনোবিল তেজস্ক্রিয় বিপর্যয়ে প্রায় তিন লক্ষ লোক বাস্তুুচ্যুত হওয়ার খবর এখনো মনে দাগ কাটে।
৮৯ সালে শহীদ সাংবাদিক নিজামুদ্দিনের কন্যা রিমা হত্যাকা-ে জড়িত খুনি মনির ও খুকুর বিচার কার্য পরিচালনা এবং রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত প্রায় দেশের সকল জাতীয় দৈনিক সক্রিয়ভাবে এই খবরটি প্রচার করছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পাঠক হিসেবে আজও স্মরণ করছি।
বাসার বাইরে বিভিন্ন পাড়া মহল্লার দেয়ালে দৈনিক পত্রিকা পড়েছি। কুমিল্লায় মিন্টুদার দোকানে একটি পত্রিকা কিনে চারটি পত্রিকায় চোখ বুলিয়েছি।
বাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পথে পত্রিকা শেয়ার করে পড়েছি। বাসে পত্রিকায় পড়া অবস্থায় এমন পাঠক পেয়েছি যিনি বললেন “ভাই ভিতরে পাতাটি একটু দিবেন” বিষয়টি আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছিল। আমি তাকে পুরো পত্রিকাটি দিয়ে বললাম আপনি পড়ে আমাকে দিয়েন। ব্যক্তির তৃপ্তির হাসি এখনো আমার চোখে ভাসে। যমুনা ব্রিজ না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়ে পত্রিকা পড়তে হয়েছিল বিকাল বেলা।
আন্তর্জাতিক কিংবা রাষ্ট্রীয় বিশেষ ঘটনায় পত্রিকার চাহিদা বেড়ে গেলে বাসায় পত্রিকায় না দিয়ে হকার বেশি দামে পত্রিকা বিক্রি করে দিত।
ঐদিন বঞ্চিত হতাম পত্রিকা পড়া থেকে।
আমার বর্তমান চিন্তা, চেতনা, সৃজনশীল মন মানসিকতার জন্য সংবাদপত্রের কাছে কাছে আমি ঋণী।
বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে অনলাইনে পত্রিকা পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। হালে কমেছে ছাপা পত্রিকার চাহিদা। কিন্তু ছোটবেলা থেকে ছাপা পত্রিকা পড়ার অভ্যেস এখনো ধরে রেখেছি। হকার নিয়মিত বাসায় পত্রিকা দিয়ে যায়। আমার সন্তানরা নিয়মিত পত্রিকা পড়ে এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছি। ওদের হাতে নিয়ে পত্রিকা পড়ার মুহূর্ত আমি দারুণ ভাবে উপভোগ করি।
দেশের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক আমোদের ৭০ বছর পদার্পণ উপলক্ষ্যে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি সাংবাদিকতার পথিকৃৎ সাপ্তাহিক আমোদ-এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় প্রয়াত ফজলে রাব্বীকে। গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমোদ পরিবারের সকল সদস্যকে উনার রেখে যাওয়া কর্মযঞ্জকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমোদ-এর সাথে যুক্ত
বিগত ও বর্তমান সংবাদ কর্মীদের প্রতি রইল গভীর ভালোবাসা।
লেখক: সংগঠক ও সমাজকর্মী।