সাংবাদিকতার অন্তরালে অযাচিত কারবার

।। এইচ.এম. সিরাজ ।।

‘ডিম আগে নাকি মুরগি আগে’ এই বিতর্কের খুব একটা সমাধান নেই। তেমনিভাবেই কোন্ পেশা সবচেয়ে ভালো, কোন্ পেশাটি ভালো নয়- এমন আলোচনাও অনেকটাই অর্থহীন। কেননা, কোনো কাজই ছোট নয়। বাল্যকালে প্রায়শই একটা কথা খুব শুনতে পেতাম- ‘নবীর শিক্ষা করিওনা ভিক্ষা, কর্ম কর সবে।’ একসময় কথাটি সূঁচিকর্মের মাধ্যমে রুমালে লিখে বাঁধাই করে ঘরের দেয়ালে সেঁটে রাখা হতো শিল্প মানসের বিকাশে তথা মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। জ্ঞানালয় কিংবা এজাতীয় প্রতিষ্ঠানের দেয়ালেও শোভা পেতো বড় বড় হরফে। আজও হয়তোবা দেখা মিলবে কোথাও, একবোরে বিলীন হয়ে যাবার কথা নয়। এতেই প্রতীয়মান যে, সমাজে কাজের মূল্য কতোখানি। কাজ কিংবা পেশার মূল্য সর্বজনবিদিত। এর বিপরীত যারা ভাবেন, তারাই বরং হীনমন্যের অধিকারী। ‘জুতা সেলাই থেকে চ-িপাঠ’, সবকিছুই মানব জীবনে অত্যাবশ্যক। কাজহীন মানুষকে বলা হয় অলস। আর ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডাখানা’ বা ‘আইডেল ব্রেইন ইজ এ্যা ডেভিল ওয়ার্কসপ’ তুমুল জনপ্রিয় এই ইংরেজি প্রবাদটি আমাদের প্রায় সবারই জানা।

একদা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই সমাজের শিক্ষিত-সচতেন মানুষেরা ‘সাংবাদিকতা’ করতেন। বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক, আইনজীবী, মৌলভী শ্রেণীর লোকেরা মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্রের কল্যাণে করতেন সাংবাদিকতা। মূলত তারা বিবেক বা বোধের দায় থেকেই কাজটি করতেন। তজ্জন্যই তাদেরকে সমাজসেবীও বলা হতো। সমাজ হিতৈষী এসব ব্যক্তিরাই হতেন রাজনীতি মনস্ক,তন্মধ্যে কেউ আবার রাজনীতির সাথে গাঁটছড়াটা বাঁধতেন বেশ প্রত্যক্ষভাবেই। ইতিহাস তো এমনটাই বলে। শুধু ইতিহাসই-বা বলছি কেন? আজকের দুনিয়াতেও এমন ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি নেই কোথায়? ভারতবর্ষের ইতিহাস, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পাঠ করে কিংবা পর্যালোচনায় আমরা কি জানতে পারি? মোদ্দা কথা, ‘সাংবাদিকরা লিখে খান’। লেখা, পড়া, গবেষণা এসবই তাদের কাছে মূখ্য। তাদের থাকে তৃতীয় নয়ন, হয়ে থাকেন প্রচ- রকমের ধি শক্তিরও অধিকারী। সমাজের সকল অসঙ্গতিকে নির্মোহ বিশ্লেষণে তুলে ধরেন জাতির অক্ষিগোচরে। তাদের লেখনি শক্তির বদৌলতে সমাজে বিদ্যমান অনিয়ম-নিয়মের ফারাকটুকুন প্রতিভাত হয়ে ওঠে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবেই।

সময়ের আবর্তে কিংবা প্রয়োজনে সাংবাদিকতা পেশায় এসেছে পেশাদারিত্ব। পার্টটাইমের বদলে এখন হয়েছে ফুলটাইম। ইদানিংকালে ‘কর্পোরেট’ ব্যবস্থার বদৌলতে সাংবাদিকের জীবনমানেরও যথেষ্টই শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে বলাটাও অত্যুক্তি নয়। পেশাদারিত্বের প্রয়োজনানুরূপ অর্থনৈতিক সুবিধে সৃষ্টি হওয়ায় একসময়ের ‘না খেয়ে মরার’ তকমা আজকের বাস্তবতায় একেবারেই অনুপস্থিত। তথাপিও শিক্ষা-সংস্কৃতির সাথে পেশাটির ওৎপ্রোত সম্পর্ক থেকে যায়, আর থাকাটাও অতীব জরুরত বটে। কারণ যারা শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ধারণ করেন এমনকি লালন করেন একনষ্ঠিভাবে, তিনারাই নিজের নামটি লেখান সাংবাদিকতা পেশায়। কেননা, তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক বেশিই। তারা জাতির জাগ্রত বিবেক। একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম। যেটি ছাড়া কোনো কল্যাণ রাষ্ট্র কদ্যপিও সগৌরবে টিকে থাকতে কিংবা গড়ে ওঠতেও পারে না। অতএব, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের নিয়ামক সাংবাদিককে কতো বিচক্ষণ হওয়া আবশ্যক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ডাক বিভাগ, টিএন্ডটি’র টরেটক্কা টেলিফোন, কুরিয়ার সার্ভিস, টেলিফোন, ফ্যাক্স, মোবাইল, ই-মেইল ইত্যাদি ছাপিয়ে স্মার্টফোনের বদৌলতে সাংবাদিকতা এখন হাতের মুঠোয়। উন্নত প্রযুক্তি যেমনিভাবে আমাদের জন্য আশির্বাদ, আবার এর বিপরীতে অভিশাপও বয়ে এনেছে বৈ কি। প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় আজকালকার দিনে সাংবাদিকতায় আসছেন কারা? সমাজের ‘তারকাঁটা’ পর্যায়ের লোকও আজকাল সাংবাদিক বনে যাচ্ছেন দিব্যি অনায়াসেই। আর এজন্য ‘কইরা খাও’ পর্যায়ের একটা ধান্ধাবাজ শ্রেণী সবচে’ অধিক পরিমাণে দায়ী। তাদের আস্কারাতে ধরিবাজ শ্রেণীর মানুষেরাই প্রচণ্ড রকম আগ্রহে আকৃষ্ট হচ্ছেন সাংবাদিকতায়। যেনতেনভাবে একটা ডান্ডি কার্ড (আইডি কার্ড) গলায় ঝুলাতে পারলেই কেল্লাফতে। তাকে আর ঠেকায় কে? অনেকে আবার নিজেই ‘ডটকম’ সাংবাদিক !

আজকাল আমরা এসব কি দেখছি? সাংবাদিকতা কি ক্রমশই ব্যবসার নামান্তর হচ্ছে? নাকি সাংবাদিকতার অন্তরালে নানান কিছিমের অযাচিত ব্যবসা-বাণিজ্যিক কায়-কারবার চলছে? ব্যবসাকে আমি খারাপ বলবো কোন্ দু:খে? এটি তো পবিত্র পেশা। উপরন্তু এই পবিত্র পেশাটিকেও অপবিত্র বা কলুষিত করছেন সাংবাদিক নামধারী একদল বকধার্মিক মানুষ। সাংবাদিক পরিচয়ে প্রভাব খাটানোর কাজটি তানা সারছেন অত্যন্ত নিপূণতায়। বিষয়টি ক্রমশই জনসমক্ষে কেবল আলোচিত হওয়াই নয়, ব্যাপকতর সমালোচনারও উদ্রেক ঘটাচ্ছে। কারণ, খারাপ কিছু দ্রুতই ছড়ায়। সাংবাদিক কাম ঠিকাদার, সাংবাদিকতার তকমা লাগিয়ে হাসপাতালের ব্যবসা, অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা, পরিবহনের ব্যবসা, ডিশ লাইনের ব্যবসা, কোম্পানির প্রতিনিধি, মাদক ব্যবসা, গ্যারেজের ব্যবসা, সিএনজি এমনকি রিকশার ব্যবসাতেও যিনারা মত্ত হচ্ছেন, তিনারা পেশাটিকে কতোটা নিম্নগামিতায় নামাচ্ছেন ? একটিবারের জন্যও কি তারা বিষয়টি ভেবে দেখছেন? এসব কিসের আলামত ?

লেখক: কবি, সাংবাদকি ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকটে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।