আমোদ যেন লেখক তৈরির কারখানা

 

।। আবদুল আজিজ মাসুদ ।।

বলা যায় আমোদ আমাদের প্রতিবেশী। আমোদ পুরাতন চৌধুরীপাড়ায় আমরা শাহ্সুজা মসজিদ সড়কে। সে সুবাদে আমোদকে চিনি শৈশব থেকে। সত্তরের দশকে পুরাতন চৌধুরী পাড়া রেয়াজ উদ্দিন ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে অধ্যায়ন কালে আমোদ কার্যালয়ের পাশ দিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা হতো প্রতিদিন। কখনো কখনো দেখতাম লম্বা এক হারা গড়নের মাথায় খাটো করে কাটা চুল আর্মির মতো মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক হাতা ওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন আমোদ কার্যালয়ের দরজা বরাবর। কখনো দেখতাম সামনের সবুজ ঘাসে ভরা চত্বরে নিজ কন্যাকে সাইকেল চালানোর কৌশল রপ্ত করাচ্ছেন চত্বরে ফেলে রাখা কাগজের টুকরোর ফাঁকে ফাঁকে। কখনো দেখেছি ট্রলি ঠেলে আমোদ-এর বান্ডিল নিয়ে যাচ্ছেন পোষ্ট অফিসে ডাক ধরাতে। প্রতি শুক্রবারে দেখা হতো শাহ্সুজা মসজিদে জুমা নামাজের সময়। সালাম দিতাম কথা হতো না। আসলে তাঁর প্রতিটি কার্যক্রমই ছিল আমার চোখে একটু ব্যতিক্রম আভিজাত্যের ছাপে ভরা, হয়তো এ জন্যই শৈশবের স্মৃতিগুলো আজো মুছে যায়নি মন থেকে। পরে শৈশব পেরিয়ে কৈশরে পা রেখে আমোদ কার্যালয়ের ড্রামসিটের সীমানা বেড়ায় সাটানো আমোদ পড়ে পড়ে বুঝতে পারলাম এই “ভদ্রলোকটিই হচ্ছেন আমোদ সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী সাহেব। আরো জানলাম তিনি শুধু সাংবাদিকই-নন তিনি একজন ভালো স্টাইলিস্ট বেডমিন্টন খেলোয়াড়ও।

কৈশোরে কুমিল্লা হাইস্কুলে অধ্যায়নকালে আমোদ পড়ি, ঢাকার দৈনিকের ছোটদের পাতা, মাসিক নবারুণ এ চোখ রাখি নিয়মিত। এক সময় মনে ইচ্ছে জাগে আমিও লিখবো। কিন্তু আমার লেখা কি ছাপা হবে? কে ছাপাবে আমার লেখা? নানাহ্ প্রশ্ন মনে, শেষে সাহস করে ছড়া লিখে পাঠালাম আমাদ-এ। কিছুদিন পর দেখি আমার লেখা কালো হরফে আমোদ-এর পাতায়, আমি দেখেতো অবাক! বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ এখনো স্মৃতিতে জ¦ল জ¦ল করছে। তখন আমোদ-এর দাম ছিল পঞ্চাশ পয়সা। পঞ্চাশ পয়সা জোগাড় করে আমোদ কার্যালয়ে গেলাম আমোদ আনতে। সরাসরি রাব্বী সাহেবের কাছে আমোদ চাইলাম। যখন বল্লাম আমার লেখা ছড়া আমোদে ছাপা হয়েছে এ কথা শুনে রাব্বী সাহেব পঞ্চাশ পয়সা ফেরৎ দিয়ে দিলেন। সে আর এক আনন্দ। লেখা ছাপা হলে পত্রিকা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। লেখালেখির উৎসাহ আরো বেড়ে গেলো, কিছু গল্প কবিতা ছাপাও হলো আমোদসহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকার ছোটদের পাতায়। শেষে এ উৎসাহ আর ধরে রাখতে পারিনি, মনোযোগ দিলাম সখের সাংবাদিকতায়। তবে এভাবেই রাব্বী সাহেব ও তাঁর পরিবার নতুন লেখকদের লেখা আমোদ-এ ছেপে উৎসাহ দিয়ে বহু বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক লেখক সৃষ্টি করেছেন। আমোদ যেন লেখক সৃষ্টির কারখানা। কারিগর হলেন রাব্বী সাহেব।
আশির দশকে কুমিল্লা প্রেস ক্লাব নিয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দিলেও আমোদ পরিবার ছিল এসবের উর্ধ্বে। এক পর্যায়ে এ মতদ্বৈধতা মিটে যায়। তখন আমোদে যেতাম ভোট চাইতে। মনে পড়ে ৯৪ সনে ঐক্য প্রেস ক্লাবের নির্বাচনের দিন (তখন প্রেস ক্লাব রাজগঞ্জস্থ আফতাব ব্রাদার্সের উপরে ছিল) বয়ঃবৃদ্ধ রাব্বী সাহেব ভোট দিতে এসেছেন শুনে সম্পাদক প্রার্থী বন্ধু নজরুল ইসলাম বাবুল ও রেজাউল করিম শামীম ভাই দু’জনেই রুদ্ধ শ^াসে ছুটে গেলেন নিচে। কে আগে ধরে রাব্বী সাহেবকে উপরে উঠাবেন, পরে রাব্বী সাহেব দু’জনেরই সহযোগিতায় খাড়া সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠলেন।

একবার বার্ডে সাংবাদিকতা বিষয়ক এক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে গেলাম। কর্মশালায় রাব্বী সাহেব স্বস্ত্রীক আমন্ত্রিত। অংশগ্রহণকারী অথবা রিসোর্স পারসন হিসেবে। কর্মশালার শুরুতেই পরিচয় পর্ব। পরিচয় পর্বটা ছিল একটু অন্যরকম হাস্যরসে ভরা। অর্থাৎ প্রত্যেককে তার পাশেরজনকে পরিচয় করিয়ে দেবেন ছবি একে। পরিচিতি কাগজটি জমা দিতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই রাব্বী সাহেব ছবি একে পরিচয় করিয়ে দেবেন তাঁর সহধর্মিণী সামছুন্নাহার রাব্বীকে। কর্মশালার চা বিরতিতে হলরুম থেকে বেরিয়েই দেখি অংশগ্রহণকারীদের কার্টুন আকৃতি ছবি সম্বলিত পরিচিতি কাগজটি বোর্ডে শোভা পাচ্ছে। অনেকে ছবি আঁকেননি। রাব্বী সাহেব তাঁর সহধর্মিণীর ছবি যে ভাবে এঁকেছেন তা দেখেতো হলময় হাসির রোল। এ আনন্দ ঘন পরিচিতি অনুষ্ঠানটির কথা আজো মনে পড়ে।

সর্বজন শ্রদ্ধেয় আমোদ সম্পাদক রাব্বী সাহেব ১৯৫৫ইং মনে “আমোদ” নামে যে কাগজের নৌকা চালু করেছিলেন তা আজো ৬৮ বৎসর ধরে চলছে। রাব্বী সাহেব চলে গেলে হাল ধরলেন তাঁর সহধর্মিণী সামসুন্নাহার রাব্বী, তিনিও চলে গেলে হাল ধরলেন পুত্র বাকীন রাব্বী। তিনি পারিবারিক প্রয়োজনে আমেরিকা প্রবাসী হলেও হাল ছাড়েননি। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মহিউদ্দিন মোল্লাসহ অন্যান্যের সহযোগিতায় এখনো নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে আমোদ। এখনও সকালে হকার আমোদ বাসায় দিয়ে গেলে ক্যালেন্ডার না দেখে বুঝে নিই আজ বৃহস্পতিবার।

প্রাচীন সাপ্তাহিক সিলেটের “যুগভেরী” ব্রাহ্মণবাড়িয়ার “মা” এখন হয়তো আর প্রকাশ হয় না। প্রাচীন আমোদ ৬৮ বৎসর ধরে আজো আছে হয়তো যুগের চাহিদার কারণে গেটআপ চেঞ্জ হয়েছে। সাদা কালো থেকে রঙিন হয়েছে কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ সুষম সংবাদ পরিবেশনায় আমোদ এখনো আপোষহীন। যুগ যুগ ধরে আমোদের প্রকাশনা অব্যাহত থাকুক। এই কামনা করি।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট। মোবাইল: ০১৭১১-৪৬৪২১৩।