সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম পথিকৃৎ শামসুননাহার রাব্বী — মোতাহার হোসেন মাহবুব

 

এক.
দেশের এবং বাংলা ভাষার অন্যতম প্রাচীন সংবাদপত্র- সাপ্তাহিক আমোদ। এর উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন কুমিল্লার সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম পথিকৃৎ শামসুন নাহার রাব্বী। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর মৃত্যুর পর তিনি সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। সাহিত্যপ্রেমী একজন বিদুষী লেখিকা হিসেবেও শামসুননাহার রাব্বীর স্বতন্ত্র পরিচয় রয়েছে। সাংবাদিকতা জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত প্রসঙ্গে তিনি ‘মহিলা সাংবাদিক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা: সংগ্রাম ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন:

মহিলা সাংবাদিক হিসেবে আমার যদি শুধু সংগ্রাম, যন্ত্রণা ও গঞ্জনাই থাকতো তাহলে গত ৪৫টা বছর ধরে কীভাবে সাংবাদিকতা করে এলাম। আমাকে আমার অভিজ্ঞতা, সম্মান ও প্রাপ্তিকে আগে তুলে ধরতে হবে এবং এটাই আমার মূল সফলতা। আর কাজ করতে গেলে তো যন্ত্রণা, সংগ্রাম, গঞ্জনা আসবেই। সেটাকে বাদ দিয়েতো জীবন হয় না। তাই বলে সেটাই মূল বক্তব্য হতে পারে না। আসল উদ্দেশ্য ও সফলতা বাদ দিয়ে গৌণটাকেই মুখ্য হিসেবে ধরে নিলে জীবনের কোনো মূল্যায়ন করা যাবে না। (দৈনিক শিরোনাম, ২৭ জুন ২০১১)।

এ নিবন্ধে তিনি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধ ধারণ বিশেষ করে মানুষের সেবা করার মনোবৃত্তিকে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। যদিও তাঁর এ নিবন্ধে ব্যক্তিক ও সাংসারিক জীবনের নানান ঘটনা ও সাপ্তাহিক আমোদ এর পথচলা বিষয়াদি প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি এ লিখাটিতে লিখেছিলেন দৈনিক শিরোনাম এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায়। আমোদময় পৃথিবী থেকে শামসুন নাহার রাব্বীর বিদায় উপলক্ষে তাঁর মৃত্যুসংবাদের পাশাপাশি তাঁর আলোচ্য লেখাটি পুনর্মুদ্রণ করা হয়। যা পড়ে আমি অনেকটা অভিভূত হয়েছি। নীতিদীর্ঘ লেখা নয় কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সংসার চালানোর পাশাপাশি সাংবাদিকতাসহ পত্রিকার আনুষাঙ্গিক সকল কাজ তিনি সুচারুরূপে পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। তাঁর ব্যক্তিত্ব-আভিজাত্য নিখুঁতভাবে ফুটেছে এ লেখায়। অবশ্য এর আগে অনেক লেখাতেই তাঁর সিদ্ধহস্তের ছাপ পরিলক্ষিত হয়েছে। তাঁর লেখা সম্পদকীয় ও গ্রন্থগুলোতে এর ছাপ বিদ্যমান। জীবন ও জগৎকে তিনি অবলোকন করেছেন প্রগতিশীলতার আলোকে অথচ মাথার উপর থেকে ঘোমটা এক মুহূর্তের জন্যও সরে যায় নি। ধর্মীয় অনুশাসন তিনি পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। ১৯৯৭ সালে হজ পালন নিয়ে তিনি লেখেন মহামিলনের মহামেলায় শীর্ষক গ্রন্থ।

 

দুই.
শামসুন নাহার রাব্বীর সাথে আমার পরিচয় ১৯৮০ সালের কোনো একসময়। সাপ্তাহিক আমোদ-এ একটি গল্প ছাপানোকে কেন্দ্র করে। যদিও এর আগে আমোদ কার্যালয়ে তাঁকে বহুবার দেখেছি। কিন্তু কথা বলার সুযোগ হয়নি। গল্পের নাম ছিল ‘ঘরনি’। ওই গল্পের এক জায়গায় ‘যৌতুক’ এর স্থলে ‘কৌতুক’ ছাপা হয়। ফলে গল্পের মূল বক্তব্য নিয়ে পাঠক মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। বিষয়টি মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী- যাকে আমি ‘খালু’ বলে ডাকতাম- তাঁকে জানালে তিনি শামসুননাহার রাব্বীকে ডাকেন। তিনি সম্ভবত রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। একটু পর আসেন। আমোদ এর যে সংখ্যায় গল্পটি ছাপা হয়েছিল, তা আমার হাতেই ছিল। খালু আমার কাছে থেকে পত্রিকাটি খালাম্মার (শামসুননাহার রাব্বী) হাতে দিয়ে বলেন, ‘বানান দেখার ব্যাপারে তোমাকে আরও সতর্ক হতে হবে।’ এ অবস্থায় আমিও খানিকটা বিব্রত অবস্থায় পড়ি। কিন্তু খালাম্মা এমনভাবে উত্তর দিলেন- তাঁর উত্তর শুনে আমার শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল। এরপর আমোদ কার্যালয়ে যখনই লেখা দিতে গিয়েছি খালিমুখে আসিনি। চা অথবা হালকা নাস্তা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সাপ্তাহিক আমোদ কার্যালয়েই পরিচয় হয় সাংবাদিক আবুল হাসানাত বাবুলের সাথে। তিনি আমার অগ্রজ প্রতিম। লেখালেখির শুরুটা আমোদ-এ হলেও সাংবাদিকতার হাতেখড়ি সাপ্তাহিক অভিবাদন-এ। এ নিয়ে এ মুহূর্তে কথা বলছি না।

শামসুন নাহার রাব্বী বলেছেন, ‘আমার লেখা প্রথম সংবাদ ছিল একটা সিনেমা হলের উপর। ৬৪-৬৫ সালের কথা। তখন আমরা স্বামী-স্ত্রী সিনেমা হলে গিয়ে খুব সিনেমা দেখতাম। বিশেষ করে রাতের শো’তে (৯-১২টা) বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে শাশুড়ির কাছে রেখে চলে যেতাম। ফেরার সময় ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করতো, যদি বাচ্চারা উঠে গিয়ে কান্নাকাটি করে শাশুড়িকে বিরক্ত করে, তাহলে তো আরেকদিন সিনেমা দেখার চান্স পাব না। আসলে সাপ্তাহিক আমোদ-এর জন্ম হয়েছিল ক্রীড়া ও বিনোদনকে কেন্দ্র করে। পরবর্তী সময়ে রাজনীতিসহ প্রসঙ্গিক বিষয়াদি সংযুক্ত হয়। ১৯৫৭ সালের ২০ অক্টোবর সাপ্তাহিক আমোদ-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর সাথে শামসুন নাহার রাব্বীর বিয়ে হয়। ১৯৫৯ সালে শামসুন নাহার রাব্বী সাংবাদিকতা শুরু করেন- এমন কথা বলা হলেও তিনি মূলত ওই সময় থেকে পত্রিকা ভাঁজ করা ও প্রুফ দেখা, এসব কাজ করেছেন। সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে, যা তাঁর স্বীকারোক্তিতে বিধৃত।

 

তিন.
আমোদ প্রতিষ্ঠাকালীন কুমিল্লার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট না বললেই নয়। সাপ্তাহিক আমোদ এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে। সে-বছর কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হয় আন্তঃকলেজ সাংস্কৃতিক সম্মেলন। বলা যায়, এ সম্মেলন ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে, ১৯৫২ সালে কুমিল্লায়, ১৯৫৪-তে ঢাকায় এবং ১৯৫৭- তে যে সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এরই ধারাবাহিকতার প্রতিধ্বনি। গবেষক মামুন সিদ্দিকী বলেছেন:

সংস্কৃতির এ ধারায় একুশ হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রতীক। কিন্তু তা-ও নানা বাধায় কণ্টকিত ছিল। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম অধিবেশনে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি লাভ করলেও সেই ষড়যন্ত্র ছিল অব্যাহত। এজন্য সাপ্তাহিক আমোদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে (২৭ মার্চ ১৯৫৮)। (বাঙালির সংস্কৃতি চর্চা, পৃ. ১২৩)

বলতেই হয়, সাপ্তাহিক আমোদ-এ ক্রীড়া ও বিনোদন বিষয়ক সংবাদ প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাধান্য দিলেও পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের সংবাদ প্রকাশ করেছে নির্দ্ধিধায়। শত প্রতিকূলতার মাঝেও আমোদ প্রকাশিত হয়েছে নিয়মিত।

 

শামসুন নাহার রাব্বী বলেছেন:
‘সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। একমাত্র আমোদ ছাড়া আমাদের জীবন ধারণের আর কোন উপায় ছিল না। দেশের বাড়ি বলতে কিছু নেই। পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত কোন জমি বা ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। ‘আমোদ’ একমাত্র ‘আমোদ’-ই ছিল আমাদের জীবন ধারণের একমাত্র মাধ্যম। এই ‘আমোদ’ দিয়েই ‘আমোদ’ও চালাই এবং আমরাও চলি। … অফিস-আদালত, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ। মানুষের সেই সময়কার করুণ কাহিনী বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। সেই সময় আমাদের প্রেসও বন্ধ ছিল। কম্পোজিটর নেই, মেশিনম্যান নেই, বিদ্যুৎ নেই, সর্বোপরি পত্রিকা ছাপানোর মত পরিবেশ নেই। … আমার স্বামী নিজেই প্রেসের দরজা জানালা খুলে ঘর ঝাড়ু দেন। ঘরের দরজায় চেয়ার নিয়ে বসে থাকেন। কুমিল্লা শহরের সব প্রেস মালিকরাই তাই করেছেন। নিজেরাই দরজা জানালা খুলে সারাদিন প্রেস পাহারা দিয়েছেন। কোন প্রেস বন্ধ থাকলে পাকসেনারা সীজ করে দিয়েছেন। এর মধ্যে একদিন আমাদের উপর আদেশ এলো- পত্রিকা প্রকাশ করতে হবে। তখন সাপ্তাহিক আমোদ-ই ছিল অত্রাঞ্চলের একমাত্র পত্রিকা/ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ কালীন ৩/৪টা সংখ্যা আমোদ প্রকাশ করেছি।’
স্বাধীনতা-উত্তর কালে আমোদ প্রকাশে আরও একবার বিঘ্নতা ঘটে। ১৯৭৪ সালে ৬ জুন তৎকালিন সরকার দেশের মাত্র ৪টি পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। তিনমাস বার সপ্তাহ আমোদ বন্ধ ছিল। তবে সারাদেশের মতো ‘আমোদ’ই প্রথম পুনঃপ্রকাশের অনুমতি পায়। কেউ কেউ বলেন, বন্ধ না করা ৪টি পত্রিকার মধ্যে ‘আমোদ’ ও ছিল। এটি সঠিক নয়। পত্রিকা বন্ধ থাকার বিষয়টি শামসুন নাহার রাব্বী তাঁর একটি লেখাতে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন:

পত্রিকাবিহীন, রোজগার বিহীন ওই তিনমাস যে আমাদের কিভাবে কেটেছে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। ‘আমোদ’ পুনঃপ্রকাশের আনন্দে সেদিন কতজনের কাছ থেকে যে অভিনন্দন পেয়েছি তার হিসেব নেই।

 

চার.
শামসুননাহার রাব্বীর কথা বলতে এসে সাপ্তাহিক আমোদ সম্পর্কে বেশ কিছু কথা বলে ফেলেছি। আসলে সাপ্তাহিক আমোদ, মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ও শামসুননাহার রাব্বী একে অপরের পরিপূরক। শামসুননাহার রাব্বীর সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কতভাবে যে তিনি আমাকে সহযোগিতা করেছেন, তা বলা বাহল্য। এর মধ্যে দুএকটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। ১৯৯৬ সালে সাতজনের গল্প সংবলিত একটি গল্প সংকলন বের হয় মামুন সিদ্দিকীর সম্পাদনায়। যদিও এ সংকলনে সম্পাদক হিসেবে এককভাবে তার নাম দেয়া হয়নি কিংবা তিনি দিতে চান নি। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, একজন সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন যিনি এ দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সংকলনে যারা গল্প লিখেছেন তারা হলেন- মামুন সিদ্দিকী, আফরোজ জামান চঞ্চু, সাইয়িদ মাহমুদ পারভেজ, নেছার আহামেদ রাজু, নার্গিস আক্তার নীরু, জলিল সরকার- এর পাশাপাশি আমারও একটি গল্প ‘ক্রন্দসী মাতা’ শিরোনামে ছাপা হয়। সংকলনটি হাতে আসার পর মামুন সিদ্দিকী বলেন, মাহবুব ভাই, শামসুননাহার রাব্বী আপনার পূর্ব পরিচিত। তাঁকে এ সংকলনের প্রকাশনা উৎসবে অতিথি হিসেবে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। এ প্রসঙ্গে মামুন সিদ্দিকী আরও বলেন, শামসুননাহার রাব্বী আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও গ্রন্থ উৎসবে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। কারণ তিনি এর কয়েকদিন আগে হজ পালন করে এসেছেন। হজের পরে ৪০ দিন তিনি ঘরের বাহিরে বের হবেন না- এমন ভাবনা থেকে তিনি গ্রন্থ উৎসবে না এলেও সংকলনটির উপর একটি গঠনমূলক আলোচনা লিখেছিলেন, যা গ্রন্থ প্রকাশনা উৎসবে তাঁর পক্ষে সাংবাদিক জসীম উদ্দিন অসীম পাঠ করেন। পঠিত এ আলোচনা দৈনিক রূপসী বাংলা’য় ১৯৯৬ সালের ৮ জুন ছাপা হয়। শামসুননাহার রাব্বী প্রতিটি গল্পের উপর তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। একই সাথে দিক নির্দেশনাও দিয়েছেন। আমার লেখা গল্প ‘ক্রন্দসী মাতা’ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “মোতাহার হোসেন মাহবুবের ‘ক্রন্দসী মাতা’ গল্পটিও বেশী হৃদয় বিদারক। আমাদের সমাজে বিষয় সম্পত্তি জমি-জামা নিয়ে ওয়ারিশদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মোকাদ্দমা, মারামারি স্বাভাবিক ব্যাপার। এ সমাজে ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’। রক্ষক হয়ে যদি ভক্ষকদের ভূমিকা পালন করে তখন সাধারণ অসহায় মানুষ একমাত্র বিধাতার কাছে ফরিয়াদ করেন, তেমনি এক অসহায় বিধবা মায়ের জীবনের করুণ কাহিনী এ গল্পে তুলে ধরা হয়েছে।”

 

প্রকৃত অর্থে এ গল্পের মূল চরিত্র আমার মাকে ঘিরে। বাবার মৃত্যুর পর মা অত্যন্ত অসহায় হয়ে যায়। নিকট আত্মীয়রা জায়গা-জমি নিয়ে ঝামেলায় ফেলে দেয়। একে তো অর্থাভাবে সংসার চালানো দায়, অন্যদিকে জায়গাজমি নিয়ে বাড়তি ঝামেলা- এসব প্রেক্ষাপট নিয়ে গল্পের অববর। শামসুন নাহার রাব্বীর লেখা আলোচনাটি পত্রিকা ছাপানোর পর একদিন আমোদ কার্যালয়ে গেলে তিনি বলেন, ‘তোমার গল্পের মূল চরিত্রটি অত্যন্ত দুঃখে ভরা। আবেগে ভরপুর।’ বলি, ওটা আমার মায়ের জীবন কাহিনীর একাংশ। তিনি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘তুমি বসো, আমি চা নিয়ে আসছি।’ সেদিনের তাঁর মায়াভরা চোখ আজও ভুলিনি।
শামসুননাহার রাব্বী সাহিত্যিক না হলেও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। আগেই বলেছি, লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি সিদ্ধহস্তের ছাপা রেখেছেন। ১৯৭৩ সালে ইউরোপ সফর করে দেশে এসে ইউরোপে ৩৮ দিন শীর্ষক ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশ করেন। ১৯৮৪ সালে ব্যবধান নামে একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফর করে প্রাচ্য থেকে প্রতীচী নামে ভ্রমণ কাহিনী গ্রন্থ প্রকাশ করেন। পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকাশ করেন ভালবাসার পাঁচ দশক শীর্ষক আরেকটি গ্রন্থ। তাঁর লেখা সর্বশেষ গ্রন্থ সময়ের প্রতিচ্ছবি, যা ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়। মহামিলনের মহামেলায় ও ভালোবাসার পাঁচ দশক গ্রন্থ দুটি তিনি আমাকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। অন্য গ্রন্থগুলো সংগ্রহ করতে পারি নি।

১৯৯৯ সালের ৩০ অক্টোবর বিনয় সাহিত্য সংসদের উদ্যেগে কুমিল্লা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় মামুন সিদ্দিকী রচিত গল্পগ্রন্থ ‘দস্তখত দিয়েছি’র প্রকাশনা উৎসব। এ উৎসবে অতিথি ছিলেন তৎকালীন বাংলা একাডেমির পরিচালক বিশিষ্ট কথাশিল্পী সুব্রত বড়ুয়া ও বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক বিশিষ্ট কবি আসাদ চৌধুরী। গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করেন কবি ও প্রাবন্ধিক তিতাশ চৌধুরী। আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট লেখক শান্তনু কায়সার ও ড. মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন। প্রাণবন্ত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাপ্তাহিক আমোদ সম্পাদক শামসুননাহার রাব্বী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কবি ফখরুল হুদা হেলাল। ওই অনুষ্ঠানটি কুমিল্লার কবি-সাহিত্যিক-লেখক-সাংবাদিকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। অতিথি ও আলোচকদের গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনায় মুখরিত ওই উৎসবের ভাবগাম্ভীর্যতা বৃদ্ধি পেয়েছিল সাপ্তাহিক আমোদ এর সম্পাদক শামসুননাহার রাব্বীর সভাপতিত্বে¡র কারণে। সেদিন তাঁর বক্তব্য ছিল অনুপ্রেরণামূলক। আসলে ভালো বংশের মানুষগুলোর আচার আচরণও ভদ্রতার সাক্ষর বহন করে। শামসুননাহার রাব্বী কুমিল্লা নগরীর মোগলটুলীতে এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৩ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা গোলাম মহিউদ্দিন হায়দার ও মাতা মমতাজ বেগম। তাঁর বংশের চতুর্থ পুরুষ ছিলেন আলা সাহেব। যিনি ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মুসলিম জেলা জজ ছিলেন।

 

পাঁচ.
শামসুন নাহার রাব্বী ১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক আমোদ এর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৬৫-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত দুবছর মাসিক ময়নামতি নামে একটি সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করেন। মামা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মোবাশ্বের আলীর স্নেহধন্য শামসুননাহার রাব্বী কুমিল্লার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। সাপ্তাহিক আমোদ-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী তথা তাঁর স্বামীর অনুপ্রেরণাতেই মূলত তিনি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। এরই অলোকে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালে যমুনা সাহিত্য গোষ্ঠী তাঁকে ‘বিদ্যা বিনোদনী’ খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৯৭ সালে তিনি অনন্যা শীর্ষ দশ সম্মাননা পদকে ভূষিত হন।

 

লেখালেখি প্রসঙ্গে শামসুননাহার রাব্বী বলেছেন:
‘সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সাহিত্যের ক্ষেত্রেও কিছুটা কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। রাজধানীর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, বিশেষ করে সাপ্তাহিক বেগম-এ অনেক লিখেছি। বিভিন্ন দেশ সফর করে তার অভিজ্ঞতা কাহিনী বর্ণনা করেছি। পবিত্র হজ পালন করে এসে ‘আমোদ’ ছাড়াও অন্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ভ্রমণ কাহিনী ছাপা হয়েছে।

শামসুননাহার রাব্বী ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ড সফর করেন। ১৯৭৯ ও ১৯৯৬ সালে সৌদি আরবে হজ পালন করেন। ১৯৯১ সন থেকে ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় ১৪ বার যুক্তিরাষ্ট্র সফর করেন। তিনি শেষ নিঃশ্বাসও ত্যাগ করেন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২১ সালের ২৫ জুন শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় তিনি জার্জি শোর ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অচিনপুরে পাড়ি দেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। মৃত্যু-উত্তরকালে মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী সংসদ ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনে মুক্তিযুদ্ধ কর্ণারে শোকসভার আয়োজন করে। ওই শোকসভায় সংক্ষিপ্তভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার সুযোগ থাকলেও এ লেখায় খনিকটা ব্যাপ্তি ঘটেছে। আসলে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। কুমিল্লা সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম পথিকৃৎ শামসুননাহার রাব্বী আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকবেন- এটা আমার একান্ত বিশ্বাস।

লেখক: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।