সীমান্ত হত্যা থামছেই না

 

inside post

।। মাসুক আলতাফ চৌধুরী ।।

সীমান্তে হত্যা থামছেই না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ- ভারত বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এ বন্ধুত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলমান। তারপরও বলা হচ্ছে বিশ্বের ঝুঁকিপূ্র্ণ সীমান্তের মধ্যে বাংলাদেশ- ভারত অন্যতম। দুর্ভাগ্যক্রমে সীমান্ত হত্যা একটি বাস্তবতা। ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার বার সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার কথা বলা হয়। কিন্তু তা মানা হয় নি কখনও। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ভারতীয় নাগরিকও অনেক সময় হত্যার শিকার হয়, তবে সংখ্যা সামান্য। যখন সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ থাকে তখন যে কাউকে দেখামাত্র গুলি ছোড়ে বিএসএফ। এমন আচরণ বাংলাদেশ- ভারত দীর্ঘ বন্ধুত্বের সম্পর্কের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গত দুই দশক ধরে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। হত্যা ও বিচারবিহীন একপাক্ষিক কার্যক্রম বন্ধুত্বের মধুর সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। এমন নির্যাতনের ঘটনা ভারতের আইনের শাসনের প্রতি দায়বদ্ধতাও প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিনাবিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বরং তা আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লংঘন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত সম্পর্কে বিরূপ ধারণা বেড়ে যায়।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার জামতলা উত্তর পাড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। রোববার ৯ জুন সকাল আটটার দিকে ওই ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কাসেম গণমাধ্যমকে বলেন, ভারত থেকে চিনি আনতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে উপজেলার মীরপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৪৫) মারা যান। শংকুচাইল ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যদের নিয়ে তিনি কাঁটাতারের কাছে গিয়ে মরদেহ দেখতে পান। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, আনোয়ার সীমান্তে কাঁটাতারের বাংলাদেশ অংশেই ছিলেন। দূর থেকে বিএসএফ সদস্যরা তাকে ডাক দেন। বিএসএফের এক সদস্য প্রথমে আনোয়ারের পায়ে গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ আনোয়ার হামাগুড়ি দিয়ে পালাতে চেষ্টা করেন। তখন তিন- চারজন বিএসএফ সদস্য আনোয়ারকে টেনে কাঁটাতারের ওপারে নিয়ে যান। তার স্ত্রী ও চার সন্তান রয়েছে। এই ঘটনা নিষ্ঠুর সীমান্ত হত্যার আলোচনা আবার সামনে এনে দিয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জোয়ানসহ নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক হত্যা নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা এমনিতেই জোরেশোরেই চলছিল।

এই ঘটনায় বিএসএফ এক লিখিত বিবৃতিতে জানিয়েছে, চোরাকারবারিরা সীমান্তের দুই দিকেই ছিল। আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে বিএসএফ প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্রের একটি গুলি ছোড়ে। এরপরও তারা বিএসএফ জোয়ানদের ঘিরে ধরে ও অস্ত্র কেড়ে নিতে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। তখন বিএসএফ প্রাণঘাতী অস্ত্রের একটি গুলি করলে ভারতীয় অংশে বাংলাদেশি ওই চিনি চোরাকারবারির মৃত্যু হয়। তিনি সাধারণ চোরাচালান পণ্য বহনকারী ছিলেন।

বক্তব্যের এমন ধরণই বলে দেয় চিরায়ত- স্রেফ সাফাই গাওয়া। বিবেচনা প্রসূত নয়। ২২ জানুয়ারিতে যশোর সীমান্তে বিজিবির জোয়ান হত্যার পর গরু পাচারকারী ভেবে গুলি করার কথা বলেছিল বিএসএফ। পরে অবশ্য বলেছে এটা টার্গেট কিলিং ছিল না। সাম্প্রতিক এসব হত্যা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সম্পাদক কিরীটি রায়ের গণমাধ্যমে ভাষ্য, সীমান্ত হত্যা নিয়ে যে গল্প ফাঁদা হয় তা হলো গরু চোরাচালান নিয়ে। তাঁর মতে, যখনই ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মনোমালিন্য হয় তখনই গুলি চলে। চোরাচালান দু’পক্ষের যোগসাজশেই ঘটে। কিন্তু হত্যার শিকার হয় বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশে গরু আসে। গরু চোরাচালান ভারতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

অন্য একটি সূত্র বলছে ২ জুনের দিকে কুমিল্লা বুড়িচং সীমান্তের জামতলা কালীকৃষ্ণ নগর সীমান্তে বিএসএফ সদস্যের ওপর চড়াও হয়ে অস্ত্র রেখে দিয়েছিল বাংলাদেশের চোরাকারবারিরা। ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে ঘটনার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়। একই সীমান্তের এমন ঘটনার শক্ত জবাব দিতেই হয়তো আনোয়ারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এলাকায় এমন জল্পনা রয়েছে।

চলতি বছরের প্রথম ৫ মাস ১০ দিনে (১০ জুন পর্যন্ত) ১৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গত ৫ বছরে গুলিতে প্রাণহানি হয়েছে দু’শোর বেশি। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ। প্রতিমাসেই বিএসএফের হাতে প্রাণ হারাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। পাশাপাশি নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। গুলিতে হত্যা ছাড়াও নির্যাতনে হত্যার ঘটনাও রয়েছে। রয়েছে অপহরণ ও আহত হওয়ার ঘটনাও। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ। ওই বছর ৪৮ জন প্রাণ হারান। ৪২ জন গুলিতে, ৬ জন শারীরিক নির্যাতনে। গত সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বাংলাদেশির মৃত্যু হয় ২০১৮ সালে ১৪ জনের। ১৯৭২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এসব বেসরকারি হিসাব, সরকারও হিসাব রাখেন। হত্যার শিকার বড় অংশ গরু চোরাকারবারি এবং সীমান্তবর্তী জমির কৃষক। গুলিবর্ষণের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি বিএসএফ সন্দেহভাজনদের আক্রমণাত্মক ভীতি প্রদর্শন, নির্দয় প্রহার এবং নির্যাতন করে আসছে।

বিএসএফ এই ধরনের মৃত্যুকে টার্গেট কিলিং-হত্যা নয়, অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু বলে আখ্যায়িত করছে। দাবী করা হয় দুর্বৃত্তরা হামলা চালালে বিএসএফ সদস্যরা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেন। সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার ব্যাপারে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ- ভারত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়। এসব হত্যা প্রমাণ করে এ চুক্তির স্পটতই লংঘন করা হয়েছে।

নীতিমালা অনুযায়ী দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সীমান্তপাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই নীতিমালা জানেও না, বোঝেও না। দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। আত্মীয়- স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া, হাট-বাজারে বেঁচা- কেনা করা, জরুরি চিকিৎসা সেবায় এবং কাজ খোঁজাসহ নানা প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ নিয়মিত সীমান্ত পারাপার করে। এছাড়াও সীমান্তের শূন্য রেখার কাছে জমিতে কৃষিকাজ বা নদীতে মাছ ধরতে সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়। আবার এদের অনেকে বিভিন্ন ছোট- খাটো এবং গুরুতর আন্তঃসীমান্ত অপরাধে জড়িত। তাদের অনেকে গবাদিপশু ও পণ্য পাচারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক ক্ষেত্রে চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে বিএসএফ, যাদের অনেকেই হত্যার শিকার হয়। পণ্য পাচারে শিশুদেরও ব্যবহার করা হয়। কারণ তাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে তারাও সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। অনেক নারীরাও চোরাচালান পণ্য বহনকারী। যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তাদের অনেকেই নিরস্ত্র অসহায় স্থানীয় বাসিন্দা।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি বিএসএফ আত্মরক্ষায় গুলি চালায়। বেশ ক’ বছর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিও) এর এক প্রতিবেদনে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন, বিএসএফ তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা না করে বা সর্তক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। বিভিন্ন মানবাধিকার ও অধিকার ভিত্তিক সংগঠন এবং সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, অপরাধী হিসেবে সীমান্ত হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হয় নিরস্ত্র থাকে বা বড়জোর কাস্তে, লাঠি বা ছুরি থাকে। এমন ব্যক্তিদের মোকাবিলায় বিএসএফ অতিরিক্ত বল বা শক্তি প্রয়োগ করে। এইচআরডাব্লিও’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে ভুক্তভোগীদের পালিয়ে যেতে বলে পিঠে গুলি করে দেয়া হয়েছিল। তদন্ত করা মামলার কোনটিতেই বিএসএফ প্রমাণ করতে পারে নি হত্যার শিকার ব্যক্তির কাছ থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, যার দ্বারা তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। প্রতিবেদনটিতে মন্তব্য করা হয়, বিএসএফের মেরে ফেলার জন্য গুলি চালনোর দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের জীবনের অধিকার লংঘন করে। যা ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

সীমান্তের দু’ পাশের সাধারণ মানুষের প্রয়োজন ও চলাফেরায় অহরহ সীমান্ত পাড়ি দেয়াকে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ – প্রয়োজনীয়তা – আইন- নিয়মের পরিপন্থি হলেও বৈধ বিবেচিত সুবিধা হিসেবেই দেখা হয়। একইসাথে সীমান্তে অবৈধ- নিষিদ্ধ কার্যক্রম মোকাবিলায় অধিক কঠোরতা- ‘জিরো টলারেন্স’ -শূন্য সহিষ্ণু নীতি বাধ্যতামূলক করা হয়, বিশেষ করে মাদক চোরাচালান, যৌনকাজে মানব পাচার, জালটাকা ও বিস্ফোরক পরিবহনে। সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে বিএসএফ ‘শ্যুট অন সাইট’ – দেখামাত্র গুলির নীতি অনুসরণ করে আসছে, বহাল আছে। সীমান্তে বিভিন্ন সময় কঠোরতা আরোপসহ এইসব কারণে বিএসএফ কারণে- অকারণে বাংলাদেশি নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করার সুযোগ পায়। তাই বিচার হয় না, খুব হৈচৈ পড়ে গেলে তদন্ত হয় শেষে বিচারেও মুক্তি মিলে যায়। ভারতের ১৮ টি মানবাধিকার সংগঠন সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে অনেকদিন ধরে। তারা বলছে, বিএসএফের কাজ সীমান্ত পাহাড়া দেয়া। সীমান্তে নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা নয়।

সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের অভিমত, গুলি করা আইন বিরোধী। আর বিএসএফের সাজা দেয়ার অধিকার নেই। সীমান্তে চলাচলকারীদের সাথে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আচরণ করা উচিত। অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি আইনের বাইরে রাখা হয়। এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিএসএফের কাউকে হত্যাকাণ্ডের জন্যে অভিযুক্ত পর্যন্ত করা হয়নি, ব্যাপক আলোচিত দু’-একটি ঘটনা ছাড়া। এমন কি বিজিবি জোয়ান হত্যার পরও যৌথ নয় তারাই তদন্ত করে, ফলে যা হবার তাই হয়। বেশি চোরাচালান প্রবণ সীমান্তে যৌথ টহলের সিদ্ধান্ত থাকলেও এতে উৎসাহ নেই বিএসএফের।

ভারতীয় পক্ষের দাবি, সীমান্ত এলাকায় সব গুলির ঘটনাই রাতে ঘটে এবং যে সব হতাহতের ঘটনা ঘটে তারা সবাই অপরাধী। হয় গরু বা পণ্য চোরাকারবারি। বাংলাদেশ- ভারত ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার (২৫৪৬ মাইল) বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম ভূমি সীমানা রয়েছে। অধিকাংশই কাঁটাতারের বেড়ায় সীমানা সংরক্ষিত। বিশ্বের আর কোন সীমান্তে এত দীর্ঘ কাঁটাতারের বেড়া নেই। কুমিল্লা বিজিবির অধীন ১০৬ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। এ সীমান্ত পথেও ভারতীয় ত্রিপুরা রাজ্যের গরু পাচার হয়। তবে তা ব্যাপক নয়।

বিজিবি- বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিটি সম্মেলন বা বৈঠকেই সীমান্ত হত্যা কমিয়ে আনা বা বন্ধ করা নিয়েও আলোচনা এবং ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে উভয়পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে দাবী করে আসছে। চলতি বছরের ৫-৯ জানুয়ারি মহাপরিচালক পর্যায়ে ঢাকায় ৫৪ তম সম্মেলন হয়ে গেল। সেখানেও বলা হলো পোশাকধারী ও সাধারণ নাগরিক কারও যেন প্রাণহানি না ঘটে, দু’পক্ষেরই সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা রয়েছে। প্রাণ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তারপরও এক্ষেত্রে তেমন সফলতা আসে নি।

 

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা অনন্তপুর সীমান্তে ১৫ বছরের ফেলানী খাতুনের বিভৎস হত্যার ১৩ বছর পার হলো এই ৭ জানুয়ারিতে। নয়াদিল্লিতে গৃহকর্মীর কাজ করা ফেলানী সেদিন তার বাবার সাথে বাংলাদেশে ফিরছিল। অবৈধ ভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় ফেলানীর পোশাক কাঁটাতারের বেড়ায় জড়িয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে সে চিৎকার শুরু করে। বিএসএফ সেই চিৎকারের জবাব দেয় তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে। তার প্রাণহীন দেহটি প্রায় পাঁচ ঘন্টা উল্টো ভাবে কাঁটাতারে ঝুলে ছিল। হয়তো শাস্তি, ভয় দেখাতে। কিন্তু পুরো বিশ্বকে এ নির্মম ঘটনা নাড়া দেয়। বিচারের দাবি ওঠে।

 

বিএসএফের নিজস্ব আদালতে বিচারে অপরাধীরা নির্দোষ প্রমাণিত হয়। রায় পুনর্বিবেচনায়ও আদালত ওই সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিলেও আমলে নেয়া হয়নি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ডঃ মিজানুর রহমানের গণমাধ্যমের ভাষ্য, এটা হলো ভারতের বিগ ব্রাদারলি মনোভাব। এসব হত্যাকাণ্ড বিচারের দায়িত্ব ভারতের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদের গণমাধ্যমে ভাষ্য, আমরা চাই সীমান্তে এ ধরনের কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে। সরকারের পক্ষ থেকে বিজিবির মাধ্যমে এসব বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়। ভারতের সাথে অনেক দিন ধরে আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে। সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার জন্যেও বলা হয়েছে।

যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের অনেকে চোরাচালানি হলেও তারা সশস্ত্র আক্রমণকারী এ কথা কোন বিচারেই গ্রহণযোগ্য নয়। সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবার নিয়ে উভয়পাড়েই রয়েছে অসাধু বাণিজ্যের বিস্তার। বিজিবি – বিএসএফের অনেকে এর সুবিধাভোগী। দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা ও চুক্তি অনুযায়ী যদি কোন দেশের নাগরিক অবৈধ সীমান্ত অতিক্রম করে, তবে তা অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কথা। সে মোতাবেক ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের নিয়ম রয়েছে। যেখানে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, মানুষ পাচার এবং চোরাচালান বন্ধে যৌথ উদ্যোগ ও দু’দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও আস্থা বাড়ানোর লক্ষ্যে দুই দেশ কাজ করছে, সেখানে সীমান্তে গুলি- হত্যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। সীমান্তে যেকোন অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিদ্যমান আইনে বিচার হবে এবং এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। অন্যথায় পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

আরো পড়ুন