সুলতান মাহমুদ মজুমদার: আইনজীবী, লেখক ও নাট্যভিনেতা

।।মোতাহার হোসেন মাহবুব।।

উনিশ শ সাতাত্তুর সাল। ভিক্টোরিয়া কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা করি। রবীন্দ্র নজরুল রচনাবলী পড়ায় মনোযোগী সেই প্রাথমিক শিক্ষাজীবন থেকে। ক্রমেই তা বাড়তে থাকে। চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে নজরুলের ‘চল্ চল্ চল্ …’, শীর্ষক কবিতা আবৃত্তি করে প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করি। এটি অবশ্য দলীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়। আমি দলনেতা ছিলাম। নজরুলের এ কবিতাটি বর্তমানে রণসঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত। এরপর পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতা আবৃত্তি করে শহর কেন্দ্রিক প্রাথমিক স্কুল আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করি। প্রথম প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কাটাবিল পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল মনোহরপুর আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ লেখার আগে অন্য একটি লেখায় এ বিদ্যালয়টিকে গিরিধারী স্কুল বলেছি। এ তথ্যটি ভুল বলে জানিয়েছেন প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ- যিনি গিরিধারী স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেছেন, “গিরিধারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ছিল দেশওয়ালীপট্টি রাধারানী ম্যানুফেকচারিং এর দক্ষিণে রাস্তার পূর্বপাশে’। স্বাধীনতা-উত্তর কালে স্বরচিত কবিতা লিখা ও পাঠ করা হলেও আবৃত্তি বলতে যা বুঝায় তা হয়ে ওঠেনি। তবে আমার লেখালেখি শুরু ছোটগল্প দিয়ে। এরপর প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি, গবেষণা ইত্যাদি।

প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে বিশেষ করে নজরুল বিষয়ক লিখার ক্ষেত্রে যে গ্রন্থটির কথা সর্বপ্রথম উচ্চারণ করা অত্যাবশ্যক তা ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’। এ গ্রন্থের রচয়িতা- লেখক ও নাট্যভিনেতা অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ মজুমদার। যাঁর সাথে কথা বলা ও পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল উনিশ শ সাতাত্তুরের কোনো এক সময়। সে-সময় স্বরচিত ‘কুমিল্লায় নজরুল ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ দৈনিক বাংলা’র সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। তখন দৈনিক বাংলা’র সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন কবি আহসান হাবিব। তাঁর সাথে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এ পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার আগে এডভোকেট সুলতান মাহমুদ মজুমদারের গ্রন্থটি সংগ্রহ করেছি এবং মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছি। উনিশ শ পঁচাত্তর সালে এ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এটি সংগ্রহ করেছিলাম সাংবাদিক নওশাদ কবীরের কাছ থেকে। নওশাদ আমাকে ‘বেয়াই’ বলে সম্বোধন করতেন। সে একদিন বললো, ‘আপনি তো পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, করেন এ বইটি আপনার কাজে লাগবে’। সত্যি বলতে কী নজরুল চর্চার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থটি আকর গ্রন্থ হিসেবেই কুমিল্লায় বিবেচিত। এ গ্রন্থ প্রসঙ্গে এডভোকেট সুলতান মাহমুদ মজুমদারের ভ্রাতুষ্পুত্র অধ্যক্ষ হাসান ইমাম মজুমদার ফটিক বলেছেন, ‘গ্রন্থটি প্রকাশনার পর লেখক ও গবেষকগণ কুমিল্লায় নজরুল বিষয়ক অনেক প্রশ্নের সমাধান খুঁজে পান। যাঁরা এ গ্রন্থ থেকে উপাত্ত নিয়ে নিজের লেখা ও গ্রন্থকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক মোবাশে^র আলী, ড. মনিরুজ্জামান, মোঃ মাহফুজুল্লাহ, অধ্যাপিকা লায়লা নূর, শান্তনু কায়সার, শান্তিরঞ্জন ভৌমিক, তিতাশ চৌধুরী, আবদুল হাই শিকদার, অধ্যাপক আবদুল ওহাব, ড. মোঃ জয়নাল আবেদীন, ড. আলী হোসেন চৌধুরী, ড. আবু হেনা আবদুল আউয়াল, ড. স্বপ্না রায়, ড. আবুল আজাদ, অধ্যাপক আনোয়ারুল হক, জহিরুল হক দুলাল, এডভোকেট মোঃ গোলাম ফারুক, মিসেস শামসুন্নাহার রাব্বী, আবুল হাসানাত বাবুল, নওশাদ কবীর এর নাম উল্লেখ্য।

এখানে একটি কথা না বললেই নয়, অধ্যাপক হাসান ইমাম মজুমদার ফটিক সুলতান মাহমুদ মজুমদারের গ্রন্থ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে কুমিল্লায় নজরুলকে নিয়ে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সবার নাম উল্লেখ করতে পারেন নি। সাহিত্যিক ও গবেষক আহাম্মেদ কবীরের নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। নজরুলকে নিয়ে তাঁর একটি গ্রন্থও রয়েছে। তিনি অনেকগুলো প্রবন্ধ লিখেছেন। বাদ পড়েছে অধ্যাপক শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও পীযূষ ভট্টাচার্যের নামও। সর্বোপরি জনাব ফটিক আবদুল কুদ্দুস ও নজরুলপ্রেমী বুলবুল ইসলামের নাম উল্লেখ না করে বড় ধরনের ভুল করেছেন- এমন কথা বলা যাবে না, হয়তো মনে নেই। বুলবুল ইসলাম শক্ত হাতে কলম না ধরলে নজরুল অধ্যায় থেকে নার্গিস পর্বটি হারিয়ে যেত। একই সাথে কুমিল্লায় নজরুল খ-িত ইতিহাসে পরিণত হতো। তবে একথা স্বীকার করতেই হয়, অধ্যক্ষ হাসান ইমাম মজুমদার ফটিক সুলতান মাহমুদ মজুমদারকে নিয়ে তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক একটি লিখা লিখেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ। এডভোকেট গোলাম ফারুকের নাম কেন লিপিবদ্ধ হয়েছে- তা বোধগম্য হয়নি। সুলতান মাহমুদ মজুমদারের গ্রন্থের তথ্যসূত্র নিয়ে তিনি কোনো প্রবন্ধ লিখেছেন- এমনটি মনে পড়ছে না। তাঁর যে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে- গ্রন্থ দুটি আদৌ গবেষণা গ্রন্থ কিনা? তিনি কোন সময় থেকে লেখালেখি করেন তাও কুমিল্লাবাসী জানে।

বলা বাহুল্য, ১৯৭৭-১৯৮০খ্রি. এ সময়কালে দৈনিক বাংলা’য় শুধু নজরুলকে ঘিরেই স্বরচিত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে ‘নজরুল, প্রমীলা ও নার্গিস’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে বলেছি, ‘বিজয়িনী’ নজরুলের একটি বিখ্যাত কবিতা। বিশেষত এটি ছিল আশালতা সেনগুপ্তার সঙ্গে তাঁর প্রণয় সম্পর্ক স্থাপনের প্রথম প্রকাশ্য ঘোষণা।
এ কবিতাটির উৎস সম্পর্কে নজরুল সুহৃদ সুলতান মাহমুদ মজুমদারের কথা স্মর্তব্য। তিনি বলেন, ‘কবি নজরুল একদিন মার্চ মাসের প্রথমভাগে আমার হোস্টেলে এসে একটা কবিতা লিখতে বসেন। আর কোনোদিন তিনি হোস্টেলে বসে কবিতা লিখেন নি। আমি নিকটে গেলে বললেন, ‘প্রেম-পত্র নয়, কবিতা’। প্রায় আধঘন্টা পর কবি আমাকে ডাকলেন ও কবিতাটি যে কাগজে লিখেছিলেন সে কাগজটি ভাঁজ করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, আমি যেন সেটা তখনই দুলীর হাতে পৌছিয়ে দিয়ে আসি। …
আমি বললাম- কবিতা পড়তে পারি? তিনি বললেন ‘খু-উব পড়তে পার’। আমি মনে মনে কবিতাটি পড়লাম। কবিতাটির নাম ‘বিজয়িনী’।

বলা প্রয়োজন, সুলতান মাহমুদ মজুমদার তখন ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং কলেজ হোস্টেলে থাকতেন। এ কবিতাটি ১৩২৮ পৌষের ‘মোসলেম ভারত’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। রচনাকাল: কান্দিরপাড়, কুমিল্লা। অগ্রহায়ণ, ১৩২৮।

আমার লেখা এ প্রবন্ধের প্রশংসা করেছিলেন কবি আহসান হাবিব। তিনি বলেছেন, তোমার এ প্রবন্ধ পড়ে নজরুল সম্পর্কে নতুন কিছু জানলাম। আগেই বলেছি, নজরুলের সাথে সুলতান মাহমুদ মজুমদারের সসুম্পর্ক ছিল। নজরুলের অনেক গোপন তথ্য তাঁর জানা ছিল। নজরুলকে নিয়ে এ প্রবন্ধ ছাড়াও ‘ফুলের জলসার নীরব কেন কবি’ গ্রন্থের উপর আলোচনা সম্ভবত আমি-ই প্রথম লিখেছি। ওই আলোচনায় বলেছি- লেখক সুলতান মাহমুদ মজুমদার রচিত ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’ গ্রন্থে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে লেখক যতটুকু স্মৃতিচারণ করেছেন, তারচে’ বেশি কথা বলেছেন নিজের সম্পর্কে, লিখেছেন বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুমিল্লায় আগমন ও কুমিল্লার সমসাময়িক সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের কথা। এ আলোচনা পড়ে সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবিব বলেন, ‘এটি বিচারমূলক নয় বরং গঠনমূলক আলোচনা বটে’। এটি উনিশ শ আশি সনের কথা। এর আগে উনিশ শ আটাত্তর সালে একই পত্রিকায় নজরুল বিষয়ক স্বরচিত একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই প্রবন্ধে নজরুলের বোহেমিয়ানতা প্রসঙ্গে সুলতান মাহমুদ মজুমদার ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’ গ্রন্থে যেকথা বলেছেন তা উল্লেখ করেছি। তিনি বলেছেন : নজরুল কোনো সময়েই দীর্ঘকাল এক বাসায় থাকতেন না। আজ হুগলী, কাল কৃষ্ণনগর পরে নওগাঁও অফিসের নিচ তলা,সেখান থেকে পান বাগান লেন, তারপর বেনিয়াটোলা, বিবেকানন্দ রোড, মসজিদ বাড়ি স্ট্রীট, পরে শ্যাম বাজার এইভাবে বাসা বদলাতেন। কবির নিজের কথায়, ‘যাদের নিজের বাসা থাকে, তাদের বাসা বদলাবার কথা ওঠেনা। আমি যে পরের বাসায় ভাড়াটে।… কাজেই কম ভাড়াতে বাসোপযোগী বাসা পেলেই বাসা বদলাই’। তাছাড়া কবি অনেক সময় তাঁর বন্ধুদের হাসতে হাসতে বলতেন, ‘পয়সা থাকলে, নিজেই একটা বাড়ি করতাম : আমি তো কোকিল, নিজের বাসা নেই বলে কাকের বাসা খুঁজে-পেতে ডিম পাড়ি’ ইত্যাদি।

নজরুলের এ উক্তিকে সুলতান মাহমুদ মজুমদার তাঁর গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন কবির প্রতি তাঁর সহমর্মিতা সুদৃঢ় ভাবে প্রকাশের লক্ষ্যে। উনিশ শ আশি সনে যখন গ্রন্থালোচনাটি প্রকাশিত হয় তখন নাট্যশিল্পী সুলতান মাহমুদ মজুমদার ‘শাহজাহান’ নামক একটি নাটকে মূলচরিত্রে অভিনয় করে অভিনয় ক্ষেত্রে রীতিমত আলোচনার শীর্ষে ওঠে আসেন। বিশেষত তাঁর বয়স তখন পঁচাত্তরোর্ধ্ব। সে-সময় শুনেছি, এ নাটকটি এর আগেও মঞ্চেস্থ হয়েছিল। তখন এর মূল চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন কিনা- তা জানতে পারিনি।

 

দুই.
সাপ্তাহিক আমোদ-এ আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় উনিশ শ ছিয়াত্তর সালে। এর আগ থেকেই এ পত্রিকায় নিয়মিত পাঠক বনে যাই। উনিশ শ আশি সালের দশ অক্টোবর বিনয় সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠা করি। সাহিত্যচর্চার সাথে সম্পৃক্ত থাকায় সাপ্তাহিক আমোদ-এ প্রকাশিত সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ‘শাহজাহান’ নাটকে নাট্যশিল্পী সুলতান মাহমুদ মজুমদার সম্পর্কে এ পত্রিকায় সে অভিমত ছাপা হয়েছিল তা ভুলিনি। মনে আছে, দৈনিক বাংলা’য় প্রকাশিত ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’ গ্রন্থের আলোচনা, সংখ্যাটি (সাহিত্য সাময়িকী পাতা) নিউ মার্কেটে কর্ণফুলী প্রেসে যখন সুলতান মাহমুদ মজুমদারের হাতে তুলে দিই তখন তাঁর মুখের উজ্জ্বলতা ছিল হৃদয়স্পর্শী। কর্ণফুলী প্রেসের মালিক আবদুল হালিম ছিলেন পূর্ব পরিচিত। কারণ এ প্রেস থেকে মনজুর হোসেন সম্পাদিত ‘সুহৃদ’ সাহিত্য সংকলন প্রকাশিত হতো। মনজুর হোসেন আমার জেঠাত ভাই। তার সাথে প্রায়শ এ প্রেসে আসা-যাওয়া ছিল। এখানেই একদিন আবদুল হালিম আমাদেরকে সুলতান মাহমুদ মজুমদারের সাথে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি, এটি উনিশ শ সাতাত্তুর সালের কথা।

এডভোকেট সুলতান মাহমুদ মজুমদার লেখাটি পাঠ করে আবদুল হালিমকে দেন। তিনি লেখাটি না পড়েই আমার দিকে তাকিয়ে বলে দিলেন, ‘সে খুব ভালো লিখে। একটি সাহিত্য সংকলন প্রকাশের সাথে জড়িত।’ সুলতান মাহমুদ মজুমদার আমি ও মনজুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশ তো আগামী সংখ্যায় আমার একটি লেখা প্রকাশ করো।’ আমরা উভয়ই মাথা নেড়ে সায় দিই। দুঃখ হয়, এরপর তাঁর সাথে আর যোগাযোগ করা হয়নি। তিনিও হয়তো লেখা দেয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। উনিশ শ একাশি সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আপন’ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ভেবেছিলাম তাঁর কাছ থেকে একটি লেখা সংগ্রহ করবো। তাও হয়ে উঠেনি। উনিশ শ ছিয়াশি সালের বিশ নভেম্বর নিজ বাসভবনে তিনি শেষনিঃশ^াস ত্যাগ করেন।

তিন.
দীর্ঘদিন পর এডভোকেট সুলতান মাহমুদ মজুমদারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান। তিনি প্রস্তাব করেন কুমিল্লা জেলার প্রবীণ প্রয়াত আইনজীবীদের নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনার। পনরজনের এ তালিকায় এডভোকেট সুলতান মাহমুদ মজুমদারের নামও লিপিবদ্ধ হয়। এরই আলোকে তাঁর প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগও মিলে।

বলছি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যধন্য লেখক, নাট্যভিনেতা ও আইনজীবী সুলতান মাহমুদ মজুমদারের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও কৃতিত্বের কথা। নজরুলের সাথে শুধু সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই নয় চেহারার দিক থেকে অনেকটা মিল থাকায় সুলতান মাহমুদ মজুমদারকে সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকে তাঁকে ‘কুমিল্লার নজরুল’ বলে সম্বোধন করতেন।

সুলতান মাহমুদ মজুমদার উনিশ শ পাঁচ সালের এক জানুয়ারি কোতয়ালী থানা এলাকাধীন বামুইল গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। আদি নিবাস ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী কুলুবাড়ি। তাঁর পিতা আবুল হোসেন মজুমদার একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। সুলতান মাহমুদ মজুমদার কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। তিনি কলিকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ভারতীয় ভাষাতত্ত্বে এমএ ও পরবর্তী সময়ে বিএল ও লন্ডন থেকে এফ আর ইকন এস ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ত্রিপুরার আগরতলায় তিনিই প্রথম মুসলিম ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। উনিশ শ সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর তিনি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে কুমিল্লায় আইন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি পরপর দুবার কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। উনিশ শ সাতাত্তুর সাল থেকে আমৃত্যু তিনি কুমিল্লা ল-ইয়ার্স রিক্রিয়েশান ক্লাবের সভাপতি ছিলেন।

কুমিল্লায় স্থায়ীভাবে বসবাসের লক্ষ্যে নানুয়াদিঘির দক্ষিণ পাড়ে জমি ক্রয় করে দ্বিতল বাড়ি নির্মাণ করেন এবং স্ত্রীর নামানুসারে বাড়ির নামকরণ করেন ‘শাহানা মঞ্জিল’। তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। কন্যার বিয়ের পর তাঁর স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। বিপতœীক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন জীবন যাপন করেন।

সুলতান মাহমুদ মজুমদার রুচিশীল, সৃজনশীল ও মার্জিত ব্যবহারের অধিকারী ছিলেন- যদিও তিনি এক সময় ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজ নিয়োগপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ছিলেন আড্ডারু। নিউ মার্কেটে কর্ণফুলী প্রেসে ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁকে আড্ডা দিতে দেখেছি। তবে চলনে-বলনে ছিল আভিজাত্যের ছাপ। হাতে ছড়ির ব্যবহার এর স্বাক্ষরতা বহন করতো। বাচিক শিল্পী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশংসিত হয়েছেন। কুমিল্লা জিলা স্কুলে অধ্যয়নকালে উনিশ শ ষোল সালে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকে অমল নামক চরিত্রে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে তাঁর অভিনয় জগতে প্রবেশ। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে তাঁর অভিনীত নাটকগুলো হলো: ‘অচলায়তন’ (১৯২১), বঙ্গেবর্গী (১৯২১), ‘রাজা ও রাণী’ (১৯২৩) ও ‘সিংহল বিজয়’ (১৯২৪)। সুদীর্ঘ সময়ে কুমিল্লা ও কলিকাতাসহ বিভিন্ন এলাকায় মঞ্চস্থ প্রায় শতাধিক নাটকের নাম ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত দর্শকনন্দিত নাটকগুলার মধ্যে রয়েছে ‘শাহজাহান’, ‘নন্দকুমার’, ‘সিরাজ-উদ-দৌলা’, ‘টিপু সুলতান’, ‘কুয়াশা কান্না’, ‘ইরানের রাণী’, ‘মিশর কুমারী’, ‘সীতা’, ‘পান্ডের গৌরব’, ‘আত্মদর্শন’, ‘মেবার পতন’ ইত্যাদি।

সুলতান মাহমুদ মজুমদার ছিলেন দি গ্রেট ভার্ণাল থিয়েটারের অন্যতম সংগঠক ও অভিনেতা। তিনি মাঝে মাঝে কবিতা ও নাটক লিখতেন। মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত তাঁর একটি কবিতা প্রশংসিত হয়েছিল। তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করতেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং নাটক লিখতে উৎসাহ প্রদান করতেন। এ উৎসাহে উদ্বুদ্ধ হয়ে লিখলেন ‘রক্ত-পতাকা’ শীর্ষক নাটক। নাটকটি পাঠ করে কবির অনুরোধে শিশির ভাদুরী ভূমিকায় লিখেছেন, ‘এ নাটকটি যেমনিভাবে সুন্দর, ভাষায় তেমনি সমৃদ্ধশালী, নাট্যকলায় ততোধিক চমৎকার’।

সুলতান মাহমুদ মজুমদার দীর্ঘদিন যাবত কুমিল্লা মহিলা কলেজ (বর্তমানে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ) এর পরিচালক পর্ষদের সদস্য ছিলেন। তিনি নজরুল পরিষদের ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির সহ-সভাপতি ছিলেন। কুমিল্লা কালচারাল কমপ্লেক্সের আমৃত্যু উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি কুমিল্লা জেলার ইতিহাস গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ‘কুমিল্লার নাট্য সাহিত্য’ ও ‘মঞ্চশিল্প ও নাটক’ শীর্ষক দুটি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যা পড়ার সুযোগ হয়েছিল। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ চোখে পড়েনি। সুলতান মাহমুদ মজুমদার সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ‘কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক’ পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি উষসী পুরস্কার ও ওল্ড ভিক্টোরিয়ান্স হিসেবে ঢাকা মোহামেডান ক্লাব কর্তৃক প্রদত্ত স্বর্ণপদক লাভ করেন।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।