সেই ডিসি এসপির আত্মত্যাগ

 

নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কর্মস্থল ত্যাগ করেননি। প্রাণ দিয়েছেন কুমিল্লা জেলার প্রশাসনিক সর্বোচ্চ দু’জন কর্মকর্তা। মৃত্যুর ৫০ বছর পরও স্বজনরা ভুলতে পারেননি সেই বিভীষিকাময় অধ্যায়। এনিয়ে গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
সংবাদে উল্লেখ করা হয়, মহান স্বাধীনাতা সংগ্রামে শুরুর প্রথম সপ্তাহে প্রাণ দিয়েছেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক এ.কে.এম সামছুল হক খান ও তৎকালীন পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমদ। শহীদ সামছুল হক খান টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার পাকুটিয়া ইউনিয়নের আখতারাই গ্রামের সন্তান। তিনি ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ কুমিল্লার জেলা প্রশাসক হিসাবে যোগদান করেন। ৭ মার্চ থেকে সহকর্মীদের নিয়ে তিনি সরকারি কার্যালয় ও বাসবভন ত্যাগ করে সার্কিট হাউজ থেকে রাষ্ট্রিয় কাজ পরিচালনা করেন। একই সাথে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসে পাক বাহিনীর রেশন, পেট্রোল, পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেন। ২৫ মার্চ রাতে পাক সেনারা কুমিল্লায় হামলা চালায়, ২৬ মার্চ সার্কিট হাউজ থেকে তাকে আটক করে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। নির্মম নির্যাতনের পর ৩০ মার্চ তাকে গুলিতে শহীদ করা হয়।

শহীদ পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমদ সিরাজগঞ্জ সদরের কাটারবাড়ি গ্রামে ১৯১৮ সালের পহেলা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার সন্তানরা ময়মনসিংহ শহরের শ্যামাচরণে থাকেন। ১৯৪৩ সালে তিনি সাব-ইন্সপেক্টর পদে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের ১৫ আগস্ট তিনি কুমিল্লার পুলিশ সুপার পদে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন বোখারী পুলিশ লাইন্সে অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তরের জন্য হুমকি প্রদান করলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। ২৪ মার্চ আক্রমণের শঙ্কায় পিস্তল হাতে পুলিশ লাইন্সে অবস্থান নেন। পুলিশ সদস্যদের প্রতিরোধের জন্য উজ্জীবিত করেন। ২৫ মার্চ রাতে সার্কিট হাউজের কন্ট্রোল রুমে অবস্থান নেন। ২৬ তারিখ সকালে সরকারি বাসভবন থেকে তাকে আটক করে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। নির্মম নির্যাতনের পর ৩০ মার্চ তাকে গুলিতে শহীদ করা হয়।

লেখক ও গবেষক মামুন সিদ্দিকী বলেন, সে সময়ে বৃহত্তর ক্যান্টনমেন্ট ছিলো কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস। পাক বাহিনী পুলিশ লাইন্স, আনসার-বিডিপির কার্যালয় ও বিটিসিএল অফিস দখলে নেওয়ার টার্গেটে অপারেশন সার্চ লাইটে অংশ গ্রহণ করে। কুমিল্লা একটি সীমান্তবর্তী অঞ্চল। ডিসি-এসপি চাইলে তারা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারতেন। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কর্মস্থল ত্যাগ করেননি। দেশকে ভালোবেসে তারা প্রাণ দিয়েছিলেন।

শহীদ পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদের বড় ছেলে মুন্সি কামরুল আহমেদ বলেন, পুলিশ বিভাগ আমাদের মাঝেমাঝে খবর নেয়, এতে আমরা খুশি। আব্বার জন্য দোয়া চাই। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত নসিব করেন। শহীদ হিসাবে কবুল করেন। বিশেষ কোন চাওয়া পাওয়া নাই। যদি আব্বার নামে স্কুল-কলেজ হয় আমরা খুশি হতাম।

শহীদ পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী মাকছুদা কবির কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, (২৬ মার্চ) সকাল ৭টায় তাকে আর্মি ধরে নিয়ে যায়। সে মুহূর্তের দুঃসহ স্মৃতি আমি আজও ভুলতে পারি না। যাওয়ার সময় ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে অনেক কেঁদেছেন। আর বলেছেন তাদের সাথে কথা বলে এক্ষুণি চলে আসবো। এ যাও যে শেষ বিদায় আমি বুঝিনি। এটাই শেষ দেখা ।

কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, শহীদ পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদ যে বাস ভবন থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন সে সড়ক তার নামে করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স নামক একটি বইয়ে তার জীবনী রয়েছে। আমার কার্যালয়ের সামনে স্মৃতি ভাষ্কর্য তৈরি করা হয়েছে। এ শহীদদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময় আমরা এ দেশ পেয়েছি। শহীদ পুলিশ স্মরণে পুলিশ লাইন্স স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও শহীদ আ. হালিমের নামে একটি সড়ক ও মিলনায়তন রয়েছে। প্রতিবছর বিভিন্ন দিবসে আমরা শহীদ পরিবার ও বীরমুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্য পরিবারের কথা স্মরণ করে থাকি।

এ.কে.এম সামছুল হক খানের জন্মস্থান পাকুটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. ছিদ্দিকুর রহমান জানান, তিনি আমাদের এলাকার বীর সন্তান। তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। তার গ্রাম আখতারাইলে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। জেলা সদরের একটি স্কুল আছে, এ প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। আমার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হবে।

শহীদ জেলা প্রশাসক এ.কে.এম সামছুল হক খানে ছোট ভাই আজহারুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিলো তার নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে। ৫০ বছরেও আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। পরে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুরে ওনার নামে আমরা একটি বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করি, প্রতিষ্ঠানটি এমপিও করা হয়নি। আমার মা বাবা হাসান খান- মাসুদা খানম এর নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করবো। সে ভবনের নামকরণ হবে আমার ভাইয়ের নামে। আমার বাড়ির কাজ আংশিক শেষ হয়েছে, পারিবারিক ভবন হবে শহীদ সামছুল হক ভবন। এ ভবনের নামনে ভাষ্কর্য থাকবে, ভেতরে স্মৃতি সংগ্রহ শালা তৈরির ইচ্ছা আছে।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, মাহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি একমাত্র জেলা প্রশাসক পাক বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছেন। আমরা তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। ২০০৯ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরষ্কারে ভূষিত করেছে সরকার। কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। কার্যালয়ের সামনে তাঁর জীবনীসহ ভাষ্কর্য তৈরি করা হয়েছে। তাঁর নামে একটি সড়ক রয়েছে। ডিসি বাংলাতে একটি মুক্ত মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। আমি যোগদানের পর তাঁর জীবনী গ্রন্থের কাজ হাতে নিয়েছি, তথ্য সংগ্রহ চলছে। দ্রুত তা প্রকাশ করা হবে। এছাড়াও তার দেশে প্রেমের কথা তরুণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে শহীদ এ কে এম সামসুল হক খান মিলনায়তন নাম দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি।

প্রাণ দিয়েছেন কুমিল্লা জেলার প্রশাসনিক সর্বোচ্চ দু’জন কর্মকর্তা। আমরা মনে করি, দেশের জন্য এইভাবে জীবনদান বিরল ঘটনা। তাদের বীরত্বগাঁথা পাঠ বইতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের দেশ প্রেম, সততা ও আদর্শ ছড়িয়ে দিতে হবে।