সেই বীভৎসতার কাহিনি

 

।। মতিন সৈকত।।
” একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল।/
প্রতীক্ষা মানুষের: কখন আসবে কবি?’ কখন আসবে কবি? /
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, /
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্য্যরে মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি/
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,/
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।” —- নির্মলেন্দু গুণ।

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণে ছিলো শতাব্দীর পর শতাব্দী। ইংরেজদের দীর্ঘ ষড়যন্ত্র আর এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ- উদ-দৌলা কে পরাজিত ও হত্যা করে বিট্রিশরা দখল করে নেয় বাংলার স্বাধীনতা। ইংরেজরা টানা ১৯০ বছর এদেশে লুণ্ঠন, নির্যাতন, হত্যা চালায়। প্রায় দুইশ বছর সংগ্রাম করে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই রাষ্ট্র ভাষা ইস্যুতে মানসিক দ্বন্দ্বে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। পাকিস্তানের শাসক শ্রেণিরা নিজেদেরকে অভিজাত ভাবা শুরু করে। সে থেকে শাসক ও জনতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উর্দু এবং ইংরেজিকে সরকার পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করে। পূর্ব পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ জনগণ বাংলায় কথা বলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা বাংলাকে তোয়াক্কা না করে বৈরী আচরণ শুরু করে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রকাশ্য ঘোষণা করেন urdu and only urdu will be the state Language of  Pakistan. সে থেকে পাকিস্তান মানসিক ভাবে দি খ-িত হয়ে যায়। মূলতঃ ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথম বৈরীতার সূত্রপাত।
নানারকম জুলম নির্যাতনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে শুরু করে। ৫২র ভাষা আন্দোলন, ৫৪র যুক্ত ফন্ট্রের নির্বাচনে জয় লাভ, ৬২র গনবিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬৬র ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি, ৬৯র গণঅভূথ্যান, ৭০’ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়, ৭১র ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের বর্বরোচিত হামলা এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতার আপোষহীন লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার যুদ্ধ। ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অসংখ্য বাড়ি-ঘর, দোকান,কল কারখানা সহায় সম্পদ হারানোর বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমাদের পরিবারের ও গৌরবজনক ভূমিকা ছিল। আমার দুই চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদ এবং মোঃ শাহজাহান। আবদুস সামাদ চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের তৎকালীন জি এস এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। পরবর্তীতে তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেন্টার ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট এসিস্ট্যােন্স সিসিডিএ’র প্রতিষ্ঠা করেন এবং নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বহুমুখী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
আমার দুই চাচা মুক্তিযোদ্ধা এবং আমাদের বাড়িটি মুক্তি যোদ্ধাদের ঘাটি হওয়ার কারণে রাজাকার এবং পাকবাহিনীর রোষানলে পড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার রায়পুর গণহত্যা শেষ করে পাকবাহিনী চরম উত্তেজিত হয়ে আমাদের ছোট গ্রাম আদমপুর কে তিন দিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে।
বড়দের কাছে শুনেছি পাকবাহিনীর কাছে আদমপুর গ্রামের ১৮ জন যুবককে হত্যার তালিকা ছিলো। সে টার্গেট অনুযায়ী তারা আদমপুরে গণহত্যা বাস্তবায়নের জন্য তাৎক্ষণিক চলে আসে। পাক-হানাদার বাহিনীর কাছে আদমপুরের মানচিত্র ছিলো। গ্রামের দক্ষিণ পাশে মহাসড়ক সংলগ্ন পুটিয়া হয়ে কাচা সড়ক দিয়ে আদমপুর। পূর্ব পাশে বিটমান। পশ্চিমে সিংগুলা-রায়পুর। উত্তরে কালাডুমুর নদী। পাকহানাদার বাহিনীর দল যখন তিনদিকে ঘেরাও করে আক্রমণ স্থলে পৌঁছতেছে। ঠিক সে সময়ে আল্লাহর অশেষ রহমতে গ্রামবাসী টের পেয়ে দ্রুত কালাডুমুর নদীতে বেপারীদের রাখা বড় নৌকা করে নারী পুরুষ শিশু কিশোররা সৌভাগ্যক্রমে পার হয়ে কলিযুগ-নগরপাড়, পাঁচপুকরিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে চলে যায়। পাকহানাদার বাহিনীর লক্ষ ভ্রষ্ট হওয়ার কারণে আমার মেঝ দাদা হাজী সুজাত আলীর সামাদ চাচাদের চারটি বসত ঘর এবং গনি দাদার একটি বসত ঘরসহ মোট পাঁচটি ঘর সমস্ত মালামালসহ পুড়িয়ে ফেলে। দুইজন নিরীহ লোককে গুলি করে হত্যা করে। সামাদ চাচার বড় ভাই শামসুল হক চাচা নিজেরদের বাড়ি ঘর সহায় সম্পদ অগ্নিসংযোগে ধ্বংসের শোক সামলাতে না পেরে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। পাকিস্তানি বাহিনী আমার দাদা হাজী মহব্বত আলীকে জেরা করেন। আমাদের বাড়ির উপর পাকিস্তানিদের বর্বর পৈশাচিক হামলার সাক্ষীরা এখনো এক নিঃশ্বাসে সে বিভৎসতার কাহিনি শোনান।
ঐতিহাসিক এ গানটি আমাদের স্বাধীনতার কথা সবসময় মনে করিয়ে দেয়।
“এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলব না।”
লেখকঃ জাতীয় পরিবেশ পদক এবং দুইবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত।