হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হেফাজতের ৮ হাজার আসামী
এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
হেফাজতী তাণ্ডবের ঘটনায় তোলপাড় চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ‘কেন-কিভাবে এই তাণ্ডব চালানো হলো, গান পাউডার কিভাবে এলো, কিভাবে পেট্রোল ঢেলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছারখার করা হলো, পাথরের ট্রলি নিয়ে কারা ঘুরে বেড়িয়েছিল, বস্তায় বস্তায় পাথর নিয়ে শহরের পথে পথে ঘুরা যুবকরা কারা?’ সর্বত্র বইছে এই আলোচনা। সমানে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সকল মহলে। ঘটনার দিন সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের নীরবতাও ভালোভাবে দেখছে না সাধারণ মানুষ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হেফাজতী হামলা-ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় দুুই থানায় আলাদা ৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা অন্তত ৮ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ মামলাগুলোর তদন্ত কাজ শুরু করেছে জোরেশোরে। পুলিশের একটি সুত্র জানায়, ঘটনার সময় ভিডিও ফুটেজ, দেখে মোবাইলে ধারন করা চিত্র দেখে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার চিত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব দেখে তাণ্ডবের সময় কারা-কিভাবে ভাঙচুর চালায় তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে সাথে ঘটনার উস্কানিদাতাদের শনাক্তের কাজও চলছে।
জেলা পুলিশের একটি সুত্র জানায়, ঘটনার সময়কার স্থির চিত্রগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ চলছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মামলার মধ্যে আশুগঞ্জ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর টোল প্লাজায় হামলার ঘটনায় টোল প্লাজা কর্তৃপক্ষ একটি, আশুগঞ্জ হাইওয়ে সার্জেন্ট জহিরুল হক বাদী হয়ে একটিসহ দু’টি মামলা দায়ের হয় আশুগঞ্জ থানায়। এসব মামলায় ১২শ’ অজ্ঞাত লোকজনকে আসামি করা হয়। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় গত চার দিনে ছ’টি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে দু’টি, আনসার বিডিপি ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় আনসার বাদি হয়ে একটি, পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে একটি, মৌলভীবাজারের পুলিশ হরতালের দিন আসামী নিয়ে যাবার সময় সুহিলপুর এলাকায় তাদের উপর হামলা-আসামী ছিনিয়ে নিয়ে যাবার ঘটনায় মৌলভীবাজার থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি, ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রেজিস্ট্রার বাদি হয় একটি মামলা দায়ের করেন।ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার পরিদশর্ক (ওসি) আবদুর রহিম ছয়টি মামলা ও আশুগঞ্জ থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ দুইটি মামলা রজুর বিষয় নিশ্চিত করেছেন। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত আটক করা হয়েছে ১৪ জনকে।
পুলিশের ক্ষয়ক্ষতি :
তিন দিনের তান্ডবের ঘটনায় পুলিশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা জানায়, তাণ্ডবের সময় কর্মকর্তাসহ শতাধিক পুলিশ আহত হয়েছে। সূত্র জানায়, পুলিশ সুুপার কার্যালয়ের ৪৩টি জানালার গ্লাস, প্রবেশ পথে কলাপসিবল গেইট, কন্ট্রোল রুমের সিসি ক্যামেরার মনিটর, দেয়াল ঘড়ি, টেবিলে গ্লাস, পুলিশ সুপার কার্যালয়ের গাড়ি রাখার গ্যারেজ, ডিসএবি অফিসের এনআইডি সার্ভারের ফায়ার স্টেশন মেশিন, কম্পিউটার, ফটোকপি মেশিন, জেনারেটর, জেনারেটর রাখার ঘর, কার্যালয়ের সামনের সাইনবোর্ড, ফুলের বাগানের লাইট ও বৈদ্যুতিক স্ট্যাণ্ড, ট্রাফিক পুলিশের ভাস্কর্য, রিকুইজিশন করা দু’টি মাইক্রোবাস, একটি পাজেরো, ১৩টি মোটরসাইকেল, ২নং পুলিশ ফাঁড়ির চারটি সিসি ক্যামেরা, দু’টি সিলিং ফ্যান, ছয়টি মোটরসাইকেল, ৫২টি জানালার গ্লাস, চারটি দরজার থাই গ্লাস ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
২৮ মার্চ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার তালিকাও দেখানো হয়, রিজার্ভ অফিসের দরজা-জানালা, ১নং গেইটের সেন্ট্রি পোস্টের দরজা-জানালা, পুলিশ লাইন্স গেইট ও বাউণ্ডারির লাইট, মসজিদের জানালা, ক্যান্টিনের মালামাল ও সাটার, পুলিশ লাইন্স স্কুলের জানালা, সাইনবোর্ড, খাঁটিহাতা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে পজ মেশিন, স্প্রিড গান, এলকোহল ডিটেক্টর, আরএফআই গান, ক্যামেরা, ওয়ারলেস সেট, কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ফটোকপি মেশিন, জেনারেটর, ইউপিএস, ফ্রিজ, টেলিভিশন, সিসি ক্যামেরা, মনিটর, হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর, টেবিল, খাটিয়া ছাড়াও অন্যান্য আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আশুগঞ্জ টোল প্লাজার পুলিশ ফাঁড়ির ৯২টি জানালা, দুইটি হ্যালমেট, ল্যাগগার্ড ছয় জোড়া, দু’টি ওয়াকি টকি চার্জার, চায়না রাইফেলের গুলি ২০টি, ল্যাপটপ একটি, ভিডিও ক্যামেরা একটি, এসি একটি ছাড়া অন্যান্য আসবাবপত্র লুটপাট ও ভাঙচুরের শিকার হয়।
স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরাই এনব ঘটিয়েছে: সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এ.কে.এম. খালিদ এম.পি বলেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তা বিশ্বাস করা যায়না। একাত্তর আর এখনকার ধ্বংসযজ্ঞ একই চরিত্রের। স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরাই এসব করেছে। তিনি বুধবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ শিল্পকলা একাডেমী, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গণ পরিদর্শন শেষে একথা বলেন। এসময় তিনি আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করেছি দ্রুত পুন:নির্মাণের কাজ শুরু হবে পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরিদর্শনকালে সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গণের সাধারণ সম্পাদক মনজুরুল আলম, শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক এসআরএম ওসমান গণি সজীবসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, রোববার হেফাজতে ইসলাম আহুত হরতাল চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরসহ অন্তত ত্রিশটি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালানোসহ অগ্নিসংযোগ করা হয়।