হারিয়ে যাচ্ছে পানতোয়া ডিম চিতই সরভাজা পিঠা

উঠে গেছে নাইওর উৎসব
ইলিয়াছ হোসাইন।।
কুমিল্লায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত শীতকালীন পিঠা এবং নাইওর উৎসব। শীতকাল আসলে গ্রামের লোকজনের ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি ছিলো এক উৎসবমুখর চিত্র! বিভিন্ন অঞ্চলভেদে আপ্যায়নের ধরন ছিলো ভিন্ন ভিন্ন! বাবার বাড়িতে মেয়েকে নাইওর করে আনা হতো পালকি দিয়ে। কেউ হেঁটে চলে আসতো কাপড়ের গাট্টি নিয়ে গুটিয়ে খেতের আইল ধরে। মামার বাড়ির রসের পিঠা খেতে মেতে থাকতো ভাগিনা-ভাগনিরা। পাড়া-মহল্লায় বিকেল থেকে শোনা যেতো ঢেঁকির ঠকঠক আওয়াজ। সারারাত চাল গুঁড়ি করতে ব্যস্ত থাকতো গৃহিনীরা। ভোর রাত থেকে শুরু হতো নানা রকমের পিঠা বানানোর আয়োজন। সকালের আলো নামতেই নতুন জামাইকে সাজিয়ে দেয়া হতো রসালো পিঠার থালা। চুলোর পাশে আড্ডার পাশাপাশি গরম গরম পিঠা গিলতো মা,চাচি,মামা-মামি এবং ফুফুরা। কিছু বিতরণ করা হতো প্রতিবেশীর ঘরে। এতে তৈরি হতো আত্মার বন্ধন। এমন সরল সুখকর চিত্র উঠে যাচ্ছে গ্রামীণ লোক জীবনের অধ্যায় থেকে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এ দেশে ১৫০ বা তারও বেশি রকমের পিঠা থাকলেও মোটামুটি প্রায় ত্রিশ প্রকারের পিঠার প্রচলন খুবই লক্ষ্যণীয়। যেমন: নকশি পিঠা, ভাঁপা পিঠা, ছাঁচ পিঠা, রস পিঠা, দোল পিঠা, পাকন পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চিতই পিঠা, মুঠি পিঠা, ছিট পিঠা, পাতা পিঠা, খেজুরের পিঠা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা,পানতোয়া পিঠা, ডিম চিতই পিঠা, জামদানি পিঠা, সবজি ঝাল পিঠা, সরভাজা পিঠা, ছিটকা পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, চাঁদ পাকন পিঠা, মালপোয়া পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, কাটা পিঠা, তেজপাতা পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, লবঙ্গ লতিকা পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, মালাই পিঠা, চুটকি পিঠা, গোকুল পিঠা, নারকেল পিঠা, আন্দশা পিঠা, পুডিং পিঠা, সুন্দরী পাকন পিঠা, রসফুল পিঠা, মেরা পিঠা, তেলের পিঠা, চাপড়ি পিঠা, সেমাই পিঠা, দুধরাজ পিঠা, গোকুল পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, ঝিনুক পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, ফুল পিঠা, ফুল ঝুরি পিঠা, কলা পিঠা, ক্ষীর কুলি, কুশলি পিঠা, ফিরনি পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি পিঠা, ঝাল মোয়া পিঠা, নারকেলের সেদ্ধ পুলি পিঠা, নারকেল জেলাফি পিঠা, চিড়ার মোয়া পিঠা, নারকেল নাড়ু পিঠা এবং কাউনের মোয়া পিঠা ইত্যাদি নাম অঞ্চল ভেদে পিঠা হিসেবেই বিবেচ্য।

কুমিল্লার বরুড়া অঞ্চলের ৭০বছরের আমেনা বেগম বলেন,”আমগো গেরাম থাইকা তিন গেরাম পরেই গোহালনগর(গোপালনগর) গেরাম। ঐ গেরামের তিন পাড়ায় আমগো তিন বইনেরে বাবা বিয়া দিছে। সরিষা ক্ষেতের মাঝখান দিয়া হাগ(শাক) টোকাইতে টোকাইতে আডি(হেঁটে) বাবার বাইত(বাড়িতে) আইয়া পড়তাম। বেড়াইতে আইলে মা পুলি হিডা,হাক্কন,ভরা,হুলহিডা(ফুলপিঠা) ,ছড়াহিডা বানাইতো, আমরাও বানাইতাম। চুলার লগে বইয়া বইয়া গরম গরম হিডা খাইতাম। সংগ্রামের পর হাইট্টা ধান, কনক তারা,সুলতান ভাস,গিগজ,ধারিসার,বুড়াবাজার,কামিনিসার,ছড়াবাজার,জাবরাধান,কাউন ধানসহ অনেক ধরনের ধানের হিডা তহন বানাইতো। কোনো উৎসব লাইগলে বাবা আমগোরে নাইওর নিতো! সরেজমিনে দেখা যায়,বরুড়ার হোসেনপুর গ্রামের হোসনেয়ারা বেগম মাটির চুলোয় ভাপা পিঠা,চিতই,পুলি পিঠা বানাচ্ছেন। উনুনের পাশে ধুঁয়ো উড়া গরম পিঠা খাচ্ছে তার মা, ননদ,ভাবি,ছেলে-মেয়ে এবং নাতি-নাতনিরা। তিনি বলেন, ছেলে-মেয়ে শহর থেকে এসেছে,ননদ এসেছেন বেড়াতে। তাই গতকালকে বিকেলে ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ি করেছি। রাতে মিঠাইর সিরাপ, নারিকেল কুচি, গুঁড়ির সাথে মাখিয়ে রেখেছি। ভোর থেকে পিঠা বানাচ্ছি। প্রতি বছর শীতে আমি পিঠা বানানোর আয়োজন করি। মেয়েদের বাড়িতে পাঠাই। প্রতিবেশীকে দেই।
পিঠা-সন্দেশ নিয়ে কাজ করা তরুণ উদ্যোক্তা মুক্তি সাহা ঈশিতা বলেন, ছোটবেলা হতেই দিদার মুখে শুনে আসা। পৌষসংক্রান্তির উৎসবের মধ্যে দিয়েই শুরু হতো গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে অতীব প্রিয় আয়োজন পিঠাপায়েশের সমারোহ। কালের আবর্তনে এই আনন্দমুখর উৎসবের ব্যপ্তি দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। ফাস্টফুড আর ভিনদেশী স্বাদ সংস্কৃতির আয়ত্বের প্রয়াসে এখন দেশীয় নবান্নের আমেজ হারিয়ে যাচ্ছে। সে চিন্তা থেকেই কাজ করছি বাংলার ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির ধারক পিঠা-পায়েশ-সন্দেশের নব উদ্যোগ ‘সন্দেশালয়’ নিয়ে। মা-মেয়ের এই উদ্যোগে প্রতিনিয়ত আমরা প্রয়াস করেছি বাংলার অতীব পরিচিত পিঠার সমারোহ নবান্ন উৎসব, পৌষসংক্রান্তি, বৈশাখী পার্বণসহ পূর্বের গ্রামবাংলার সকল আমেজগুলো সবার নিকট বিশেষভাবে প্রতিফলিত করার। প্রযুক্তির এই যুগে কিছুটা ভিন্নতা এবং বৈচিত্র্যতা রয়েছেই। কুয়াশামাখা ভোর সকালে গাছ থেকে নিয়ে আসা খেজুর গুড়ের মিষ্টি গন্ধ আর মাটির উনুনে ভাপে আসা পুলিপিঠার স্বাদ ইলেকট্রনিক গ্যাসচেম্বারে কি মিলে! দীর্ঘদিন সংরক্ষিত ফ্রিজিং গুঁড়, চিনির স্বাদ কিংবা মেশিনে করা পিঠার চালগুঁড়া তৈরি পদ্ধতি সহজ করে তুললেও গ্রাম্যমায়ের ঢেঁকিতে গুঁড়ি করা তৈরি পিঠার মধ্যে স্বাদের ভিন্নতা আছেই। পিঠা-পায়েশ কেবলমাত্র ভোজন নয়। এটা বাংলার লোক ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।