৭ মার্চের ভাষণ এবং ইউনেস্কো রেজিষ্টার

সৈয়দ সাফিউল হাসান চিশতী

২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে মেমোরি অব দি ওয়ার্ল্ড রেজিষ্টারে অর্ন্তভুক্ত করে। ঐতিহাসিক এ ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। বিশ্বজুড়ে তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্যগুলোকে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যেই ইউনেস্কো এই তালিকা প্রণয়ন করে। যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম উপকৃত হতে পারে।

ইউনেস্কো তাদের যোগাযোগ ও তথ্য বিভাগের বিবৃতিতে ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক হিসাবে উল্লেখ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রসঙ্গকে টেনে এনেছে। যেখানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কথাটি উল্লেখ করেছে। শুধু তাই নয় ’৭০ এর নির্বাচন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে বাঙ্গালীর
জাতীয়তাবাদী নেতা বলা হয়েছে। ইতিহাসের এক প্রকৃত সত্যই যেন পুন: প্রকাশ পেয়েছে তাদের বিবৃতিতে। বলা হয়েছে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রকৃতপক্ষে কার্যকরভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা। বক্তব্যটি ছিল বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের সমাহার। যেখানে ব্রিটিশ শাসনের পরবর্তী জাতি রাষ্ট্রের
ব্যর্থতা সমূহ তুলে ধরেছে। সেখান থেকে অর্ন্তভূক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণের কথা এসেছে।

আমরা বিষয়টি বিশ্লেষণে যদি যাই, প্রথমেই আসবে প্রামাণ্য ইতিহাসের কথা। প্রামাণ্য শব্দটির সাথে প্রমাণ বা সত্য জড়িত আর ঐতিহ্য হচ্ছে অতীতের গৌরবের বস্তু। বঙ্গবন্ধু তার সত্য কথনে বিশ্ববাসীকে ইঙ্গিত দিলেন অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বাঙ্গালী জাতি ঐক্যবদ্ধ, তাদের দমন করার সাধ্য কারো নেই। স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তা প্রমাণিত।

নিগৃহের শিকার শোষিত, লাঞ্ছিত শ্রেণীর স্বাধীনতাপূর্ব সর্বশেষ জাগরণ ৭ মার্চ। আপামর বাঙ্গালী তাদের লাল সবুজ পতাকা হাতে ধরা। এর পথ ধরেই স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে লাখ লাখ মানুষের জীবন উৎসর্গ করা। নেতার মুক্তির সংগ্রামের ডাক। স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক যেন সব বন্ধনকে ছিন্ন করার ডাক। বাবা-মা থেকে সন্তানের, নব বিবাহিত স্ত্রী থেকে তার স্বামীর, ছোট্ট শিশুটিকে রেখে তার বাবার- সবাই যেন একক বন্ধনে আবদ্ধ। সেই বন্ধনটির নাম বাংলাদেশ। এই বন্ধনের ভিত্তি যেন ৭ মার্চের ভাষণ।

ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতির উপর নির্ভর করা রাজনৈতিক অভিব্যক্তি বাঙ্গালী জাতীয়াবাদী আন্দোলনের ফসল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী উত্থানের ধারাকে ধর্মের কথা বলে বিনষ্ট করার চক্রান্ত হয়েছিল। ধর্ম বরং শক্তি যুগিয়েছে। সব ধর্মের লোকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা জায়নামাজ খুলে কিংবা হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ , ভগবান প্রভুর কাছে তাদেও প্রার্থনা করেছে। বাংলা ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীদের ভিত্তি স্থাপন করেছে। তাই যেন ৭ মার্চ বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে।

“৫২ সালে রক্ত দিয়েছি…….’’ কিংবা “ …………এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান বাঙ্গালী অবাঙ্গালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই।”
ইউনেস্কোর সাইটেসনে অর্ন্তভুক্তিমূলক সমাজের প্রসঙ্গ টানা হয়েছে। এটা হচ্ছে সে ব্যবস্থা যেখানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, প্রতিবন্ধিতা, লিঙ্গ, শ্রেণী নির্বিশেষে সবার অর্ন্তভুক্তি হয়

প্রয়োজনীয়তার সমতার উপর। এ সমাজের লক্ষ্য যাকে সমাজের সব শ্রেণী পেশার লোকদের ক্ষমতায়ন। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

প্রসঙ্গ এসেছে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে নীতিনির্ধারণে প্রত্যেক নাগরিকের সমান আধিকার থাকবে। যেমন ভোটাধিকার, সরকার তার দেশের জনগণের স্বার্থে কাজ করবে, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার থাকবে।

এ নিয়মঅনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। যখন তিনি ’৫৪ এর নির্বাচন প্রসঙ্গ টানলেন, মার্শাল ল’র কথা বললেন, ’৭০ এর নির্বাচনের কথা বললেন, অধিকার চাইতে গিয়ে রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার
কথা বললেন।
ইউনেস্কো ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৪২৭ টি ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে তা রেজিষ্টার লিপিবদ্ধ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দলিলাদি, ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দলিলাদি,মিশরের জাতীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত কোরআন শরীফ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, রাষ্ট্র বনাম নেলসন ম্যান্ডেলার মামলা এবং অন্যান্য দলিলাদি। বিশ্বেও কোন নেতার বক্তৃতাই ডকুমেন্টে স্থান পায়নি, শুধুমাত্র ৭ মার্চের ভাষণ ছাড়া। বিশ্ববাসীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস ৭ মার্চের বক্তব্য, অনুকরণীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
অন্যদিকে নিউপোর্ট ইউনিভার্সিটি, লাটভিয়া বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণকে স্মরণীয় করে রাখতে ৭ মার্চকে ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বও ওয়ার্ল্ড লিডারশীপ ডে ঘোষণা করে। প্রতি বছর ৭মার্চ তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সকাল ১০ টায় ১ মিনিটের জন্য নিরবতা পালন করে,দিবসটি পালন করে। অবিস্মরণীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বিশ্বব্যাপী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে
পড়ুক।

লেখক:আহ্বায়ক, চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ।
(একটি আন্দোলন)
মোবাইল ফোন -০১৭৪২-৭৫৫৯৯১।