সাপ্তাহিক আমোদ ও এর পরিবার-পরিজনদের অবদান
।। মোতাহার হোসেন মাহবুব।।
জন্মস্থানের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যকে প্রকাশ করার ব্যাকুলতা সব মানুষেরই থাকে। আমার বেলায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সম্প্রতি সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ড. আলী হোসেন চৌধুরী সম্পাদিত ‘কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও শিক্ষানুরাগী আবদুল মতিন খসরু স্মারকগ্রন্থে’ খসরু ভাইকে নিয়ে আমার একটি লেখায় এর প্রতিফলন ঘটেছে বলে কয়েকজন পাঠক মন্তব্য করেছেন। লেখাটির শিরোনাম ‘খসরু ভাই: যাকে ভোলা যায় না।’ এ প্রবন্ধে খসরু ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় পর্বে জন্মস্থান নানার বাড়ির সংক্ষিপ্ত পরিচয় ওঠে এসেছে। লেখাটি পড়ে যারা অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই। আসলে লেখালেখিতে প্রবেশ প্রাক্কালে বুড়িচং ইউনিয়নের (বর্তমানে উপজেলার) পশ্চিম বুড়িচং (বর্তমানে পীরযাত্রাপুর) ইউনিয়নের শ্রীপুর আবিদ আলী ভূঞা বাড়ির লাইব্রেরির অবদান অনস্বীকার্য। ওই লাইব্রেরিটিতেই খসরু ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এটি ১৯৬৮ সালের কথা। এ নিয়ে এ মুহূর্তে কথা বলছি না। সাংবাদিক মহিউদ্দিন মোল্লা লেখালেখির শুরুটা জানতে চেয়েছেন তা-ই উল্লেখ করেছি।
লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চায় সাংগঠনিকভাবে ১৯৭৬ সালে প্রবেশ করলেও সাংবাদিকতায় প্রবেশ করি ১৯৯৫ সালে। অনুরূপভাবে সাপ্তাহিক আমোদ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর সাথে ১৯৭৬ সালে পরিচিতির সুযোগ হলেও সাপ্তাহিক আমোদ এর সাথে পরিচয় ১৯৬৯ সালে। আমি তখন ইউসুফ বহুমুখী কারিগরী উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। দেশে তখন অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গেÑ যা পরবর্তীতে এ দেশের ইতিহাসে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হিসেবে গৌরব্যেজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিিহ্নত হয়েছে। আমার সহপাঠী জাহাঙ্গীর মিয়ার বড় ভাই মোঃ মমিন মিয়া একই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি এ স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭২ সালে বিএ পাস করেন। এরপর চকবাজারে স্থায়ীভাবে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর পিতার নাম মোঃ মন্তাজ মিয়া হলেও নূরপুর এলাকায় মন্তু মিয়া নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক আমোদ এর গ্রাহক ছিলেন। আমার সহপাঠী জাহাঙ্গীর ইউসুফ হাই স্কুলের ছাত্র না হলেও একই গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে হৃদ্যতা ছিল। আমি প্রতি বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটি শেষে চকবাজারে তাদের দোকানে ঢু মারতাম সাপ্তাহিক আমোদ পড়ার জন্য। উদ্দেশ্য, প্রথমত কুমিল্লার খেলাধুলার খবর জানতে। আরও একটি বিষয় ছিল- সিনেমার খবর। সাপ্তাহিক আমোদ-এ তখন সিনেমার বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। বিশেষ করে রূপকথা ও লির্বাটির বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখেছি। পরে অবশ্য কবিতা, গল্প ও রাজনৈতিক খবর- বিশেষ করে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের খবর জানতে আগ্রহ জন্মে। মন্তাজ মিয়ার দোকানটিতে প্রাথমিক পর্যায়ে তামাক ও শাদাপাতা বিক্রি হলেও পরে তা গো-খাবারÑ খৈল, ভূষি ও মুদিমালের দোকানে রূপান্তরিত হয়। এ দোকানে আমোদ সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীকে প্রায়শ আসতে দেখেছি। তখন পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি। মন্তাজ মিয়া ১৯৯০ সালের ২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। এরপর দোকান পরিচালনা করেন তাঁরই বড় ছেলে মোঃ মমিন মিয়া। জাহাঙ্গীরও দোকানে বসতো। মমিন মিয়া বর্তমানে অসুস্থ । সহপাঠী জাহাঙ্গীর ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মমিন মিয়া জানান, রাব্বী সাহেব পত্রিকা হাতে নিয়ে প্রায়ই আসতেন এবং আমাদের দোকানে বসে আশপাশের দোকানে আমোদ পত্রিকা বিলি করতেন। প্রথমে প্রতি সপ্তাহে গ্রাহক চাঁদা দিয়েছি। পরে তিনি একদিন বললেন, আপনারা তো সব সময় আমোদ রাখেন, এখন থেকে মাসিক গ্রাহক হয়ে যান। এরপর থেকে আমরা এ পত্রিকার মাসিক গ্রাহক হিসেবে চাঁদা পরিশোধ করে আসছি। এখনও আমরা এ পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক। খানিকটা অনুশোচনার সুরে বলেন, আমোদ-এর পর অনেক নতুন পত্রিকা দৈনিক হয়েছে। আমোদ এখনও সাপ্তাহিক রয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, তবে আমোদ- এ এখনও বেশকিছু গঠনমূলক সংবাদ পাওয়া যায়, যা সত্যই প্রশংসনীয়। সম্প্রতি রঙ্গিন কাগজে প্রকাশ হলেও বাড়তি বাণিজ্যিক দিক ধরা পড়েনি। শুনেছি, রাব্বী সাহেবের ছেলে বাকীন আমেরিকা থাকে। দেশে থাকতে সেও আমাদের দোকানে এসেছে। ফোন করলেই আসতো। একবার বিডিআর চকবাজার রেইড করলো। আমি ফোন করলাম, সে এসেছিল।
রাব্বী সাহেব সম্পর্কে বলেন, উনি ভদ্রলোক ছিলেন- চলনে-বলনে। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন। রাব্বী সাহেবের সাথে ডা. লুৎফর রহমানের ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাদের পারিবারিক ডাক্তার ছিলেন। আমাদের পরিবারের সবাই তাঁর পেসেন্ট ছিলেন। বাদশা মিয়া বাজারের পাশে তাঁর বাড়ি ছিল। ডা. লুৎফর রহমানের বাবা মনসুর- পুরো নাম মনে নেই, আমাদের ক্লাশ নিতেন। আমার সহপাঠী- ছিলেন নূরপুর দক্ষিণ পাড়ার অধ্যাপক জালাল উদ্দিন- ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও লাল মিয়া সরদারের ছেলে অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীর আলম জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তারাও সাপ্তাহিক আমোদ এর পাঠক ছিলেন। অধ্যক্ষ মোঃ আবদুর রউফের পরে আফজল খান এডভোকেট ভিক্টোরিয়া কলেজের ভিপি ছিলেন। এর আগে মান্নান ভাই ভিপি ছিলেন। তখন ছাত্র রাজনীতি জমজমাট ছিল। আমার সাথে রাব্বী সাহেবের সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়েছিল ১৯৭২ সালে। এর আগে বাবাই কথা বলতেন। আমি দূরে বসে শোনতাম। গত ২১ এপ্রিল মমিন ভাই অসুস্থাবস্থায় বাসার বারান্দায় বসে একটানা একথাগুলো বলেন।
একটি কথা না বললেই নয়, এই মোঃ মমিন মিয়াই ১৯৮০ সালের ১০ অক্টোবর গঠিত বিনয় সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন। এবং একটানা ৩২ বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ূন কবীর মজুমদার সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। বর্তমানে তিনিও অসুস্থ। মহান আল্লাহ দ্রুত তাঁকে সুস্থ করুন- এ প্রার্থনা করি। আমার সহপাঠী জাহাঙ্গীর বিনয় সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাকালীন কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
বিনয় সাহিত্য সংসদের কথা যে কারণে বলছি, অবশ্য এ নিয়ে আগেও কয়েকবার বলেছি- বিনয় সাহিত্য সংসদ গঠনের নেপথ্যের অন্যতম উৎসাহদাতা ছিলেন মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী। যাকে আমি জীবৎকালে খালু বলে ডেকেছি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত না থাকলেও তাঁরই পরামর্শ অনুযায়ী তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) খবির উদ্দিন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আমার বাবা মনিরুল ইসলাম সরদারের কথার জের টেনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথি সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ‘বিনয়’ নামকরণ প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। তাঁরা উভয়ই এখন পরপারে। এরপর থেকে সাপ্তাহিক আমোদ পরিবারের সাথে আমার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। অবশ্য তা নিতান্তই লেখালেখিকে কেন্দ্র করে। মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর সহধর্মিণী শামসুন নাহার রাব্বীকে খালাম্মা ডাকতে শুরু করি। খালাম্মাও পরপারে চলে গেছেন। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। খালু মারা যাবার পর বিনয় সাহিত্য সংসদের উদ্যোগেই প্রথম স্মরণসভার আয়োজন করি। আসলে আমোদ-কে নিয়ে লেখার অন্ত নেই। কত কথা, কত ঘটনা, বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না।
মনে আছে, মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর মৃত্যুর পর লিখেছিলাম, ‘ফজলে রাব্বী: আমার লিখিয়ে জীবনের অনুপ্রেরণার উৎস’। যা সাপ্তাহিক আমোদ-এ ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর ছাপা হয়েছিল। এর আগে মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীকে নিয়ে নিবেদিত কবিতা ‘স্বপ্নের আর্তনাদ’ সাপ্তাহিক আমোদ-এ ১৯৯৪ সালের ৮ ডিসেম্বর ছাপা হয়। এরও আগে কী পরে লিখেছিলাম ‘গোমতী পাড়ের মাটির মানুষ’ শীর্ষক নিবেদিত কবিতা। এরপর সুবর্ণ জয়ন্তীর ক্রোড়পত্রে ছাপা হয় ‘মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর আদর্শকে বুকের গভীরে লালন করি’। মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন কালে ‘ফজলে রাব্বী স্মারক বক্তৃতা’র আয়োজন করেছিলাম। মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী স্মরণে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের পর লিখেছি ‘একটি স্মারকগ্রন্থের প্রকাশনা: কিছু স্মৃতি কিছু অনুভূতি’ (সাপ্তাহিক আমোদ, ১৩ এপ্রিল ২০০৫)।
১৯৭৭ সাল থেকে আজ অব্দি সাপ্তাহিক আমোদ-এ কত ফিচার, কত ছোট গল্প, কত কবিতা ছাপা হয়েছে বলা মুশকিল। কারণ সবগুলো লেখা সংরক্ষণ করতে পারিনি। শ্রদ্ধেয় খালাম্মাকে নিয়ে এবং বাকীন রাব্বীর অনিন্দ্যাসুন্দর বই নিয়ে এখনো লিখা হয়নি। তবে আপন ২৬তম সংখ্যাটি শামসুন নাহার রাব্বী মানে খালাম্মাকে উৎসর্গ করেতে পেরেছি; এতে খানিক স্বস্তি পাচ্ছি। তিনি পরপারে সুখে থাকবেন- বিশ্বাস করি। আসলে আমোদ-কে নিয়ে লিখতে পারলে একধরনের মানসিক তৃপ্তি লাভ করি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কল্লোল যুগের অন্যতম আধুনিক কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য (১৯০৯-১৯৬৯) কে লেখা এক চিঠিতে লিখেছেন ‘নিজের মত প্রকাশ করবার অধিকার আমাদের সকলেরই আছে কিন্তু জাহির করবার অধিকার নেই।’ রবীন্দ্রনাথের এ উক্তিকে সাপ্তাহিক আমোদ আন্তরিকভাবে রপ্ত করেছে বলে আমার বিশ্বাস। তাই এর চলার গতি স্বাভাবিক। সম্পাদকীয় নীতিতেও এর প্রতিফলন ঘটেছে।
এ লেখার শুরুতে বলেছিলাম জন্মস্থান নিয়ে গৌরবের কথা। আমার লেখালেখির জন্মস্থান হিসেবে সাপ্তাহিক আমোদ কার্যালয়কে আখ্যায়িত করা না গেলেও প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় বলা অত্যুক্তি হবে না। আমার সকল অর্জনের নেপথ্যে সাপ্তাহিক আমোদ ও এর পরিবার পরিজনদের অবদান অনস্বীকার্য। কাজেই সাপ্তাহিক আমোদ আমার গৌরবের; অহঙ্কারের।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।