শৈশবে ফিরে যাওয়া– মমিনুল ইসলাম মোল্লা

 

 

inside post

পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ । বেশিরভাগ মানুষ একে ‘বকরি ঈদ’ বলে। কারণ, এদিন তারা বকরি বা খাসি কোরবানি দিয়ে থাকে। বর্তমানে অবশ্য খাসির চেয়ে গরুই বেশি কোরবানি দেয়াা হয়। তবুও ঈদের নাম বাংলায় রয়ে গেছে বকরি ঈদ।
কোরবানি দিতে হয় প্রিয় জিনিস। হাট থেকে একটা পশু কিনেই জবাই দেয়া হলে, সেটা অল্প সময়ে প্রিয় হয়ে ওঠে না। কথাগুলো বলেছিলেন – আমার দাদা আক্কাস মোল্লা । তিনি আমাদের পাড়া বা মহল্লার জামে মসজিদের খতিব এবং ঈদগাহের ইমাম ছিলেন। তখন মানুষের গোয়াল ঘরে গরুর অভাব ছিল না । ঈদুল আযহার নামাজ শেষে কোরবানির পর আগামী বছর কোন গরুটি কোরবানি দেয়া হবে তখনই নিয়ত করা হতো। তাই এক বছর ধরেই অত্যন্ত আদর যত্নে লালন পালন করে সবাই কোরবানি দিতেন। তখন ভাগে কোরবানি দেয়াার তেমন কোন রীতি ছিল না। তবে পারিবারিক অবস্থার উপর এটি নির্ভর করত।
আমার যতটুকু মনে পড়ে আমার বাপ-চাচারা সাতজনে মিলে ৭০০ টাকা দিয়ে একটি গরু কোরবানি দিয়েছিলেন। তখন আমাদের গ্রামে গরু কেনার কোন বাজার ছিল না। বুধবারে কংশনগর বাজার, মঙ্গলবারে মাশিকারা বাজার অথবা সোমবারে মোহনপুর বাজার থেকে গরু কিনতাম। দূর থেকে গরু আনার জন্য কোন পিকআপের ব্যবস্থা ছিল না। গরুর সাথে হেঁটে হেঁটে আসতে হতো, তাই দূরবর্তী কোন বাজার থেকে গরু কিনলে আমরা ছোটরা সেখানে যেতাম না । তাছাড়া গরুর বাজার মানেই ছিল ভয়ের বাজার । কখন কোন্ পাগলা গরু পেছন থেকে এসে শিং দিয়েগুতো মারে সব সময় টেনশনে থাকতাম। তাই দূরবর্তী কোনো গাছের আগায় উঠে বাজারের সবচেয়ে বড় গরুটিকে এক নজর দেখে নিতাম। মোহনপুর বা দিঘিরপাড় বাজারে গেলে একটি বিশেষ সুবিধা ছিল, সেখানকার উচ্চ বিদ্যালয়টি ছিল দ্বিতল বশিষ্ট। তাই দোতলার ছাদে উঠে বাজার পরিদর্শনের কাজটি সমাপ্ত করতাম। আমার সব সময়েরর সঙ্গী ছিল বড় ভাই মনির। তিনি বর্তমানে ভগবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক। গরু কেনার পর সবাই মিলে সেটিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতাম। যেদিক থেকে গরুট বাজারে এসেছে সে দিকে নিয়ে যেতে কোন কষ্ট হতো না। কিন্তু উল্টোদিকে গেলেই সমস্যা হতো, তাই আমরা আগে থেকেই গরু তাড়াানোর লাঠি সাথে নিয়ে রাখতাম। তখন মুরুব্বিরা বলতেন, এই গরুটিকে সেবা করলে অর্থাৎ যে যত বেশি খাওয়াাতে পারবে সে তত বেশি সওয়াব পাবে। ফলে আমাদের বিকেল বেলার ফুটবল খেলার রুটিন পাল্টে যেত।
গরু কেনার পর বাড়িতে আসার সাথে সাথেই আম্মা জিজ্ঞেস করলেন- গরুটা কয়টা দাঁতছেরে মমিন। গরু কেনার সাথে দাঁতের কি সম্পর্ক বুঝতে পারলাম না। তোরা গরুর দাঁত দেখে কিনে আনসনি ? আবারও প্রশ্ন করলেন মা।ব্যাপারটি পরিষ্কার করলেন সালাম কাকা। বললেন দুই বছর বয়সের নিচে গরু কোরবানি দেয়া যায় না। বিক্রেতাগণ সত্য কথা বললে কোন সমস্যা ছিল না। কেউ যদি কোরবানি দেয়ার জন্য গরু কিনতে যায় তখন হয়তো বিক্রেতা বলল, স্যার-গরুডা গিরস্তের ঘরেই ছিল দেড় বছর। আর আমি পালছি ছয় মাস। অহন আপনিই বয়সটা হিসাব করেন। কিন্তু আরেকজন যদি গরু মোটাতাজা করার জন্য কিনতে যায়, তাহলে সে হয়তো বলল, গরুর বয়স মাত্র এক বছর। উন্নত জাতের গরুতো তাই একটু মোটা-তাজা দেখা যায়। আসলে একবোরেই কচি গরু।” গরুর দুধ দাত পড়ে নতুন দাত উঠতে সময় লাগে দুই বছর ।তাই দাঁত দেখে গরু কিনলে আর কোন সন্দেহ থাকে না। এভাবেই সালাম কাকা আমাকে বুঝালেন।এছাড়া শিং এর মধ্যকার গোল দাগ দেখেও বয়স অনুমান করা যায়।তখন সকল গিরস্তের গরু রাখার ঘর ছিল। তাই সবাই একদিন একদিন পরে পালাক্রমে কুরবানির গরুটিকে নিয়ে রাখতো। তবে যার ঘরেই গরু থাকুক না কেন আমরা ছোটরা সবসময় সেই গরুর জন্য কচি ঘাস,ভাতের মাড় ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতাম। তখন গরু মোটা তাজাকরণের কোন মেডিসিন ছিল না । আমরা ধান থেকে প্রাপ্ত কুড়া, সরিষা থেকে খৈল, গুড় থেকে প্রাপ্ত রাব খাইয়ে গড়ুর যত্ন নিতাম। কে কত বড় কুরবানি দিতে পারে সে প্রতিযোগিতা তখনও কম- বেশি ছিল। ঈদের ১৫ দিন আগে আমরা গ্রামের অলি গলি ঘুরে দেখা শুরু করতাম। কে কত বড় গরু এনেছে এবং কোন গরুর রং কি রকম। কোনটি বেশি দুষ্ট তা আমাদের নখ দর্পণে থাকতো। একবার আমাদের বাড়ির উত্তর দিকের মুন্সি বাড়িতে আঠারো হাজার টাকা দিয়ে কালো রঙের একটি ষাড় গরু কেনা হয়েছিল। সে কি বিশাল গরু! আমরা ভয়ে তার কাছে যেতাম না, দূর থেকে গাছের পাতা ছুড়ে মারতাম। সেটি খেয়ে গরুটি আমাদের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকতো, মনে হতো সে যেন আল্লাহর কাছে দোয়া করছে। বিশাল গরুটি দেখার জন্য কয়েক গ্রামের লোক এসে ভিড় করেছিল। আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসে ১৯৮৩ সালে । তবে সে সময় গ্রামের কারো ঘরে ফ্রিজ ছিল না। তাই বড় গরু কিনে তা ফিজে রাখার রেওয়াজ তখনও চালু হয়নি। যারা বড় গরু কোরবানি দিতেন তারা অতিরিক্ত মাংস গরীব- মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। তখন শুনতাম তিনদিনের বেশি কুরবানির গোশত জমা করে রাখা যায় না। আমাদের গ্রামে ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুজাফফর আহমদের বাড়ি। তিনি কুড়ের ঘর মার্কা নিয়ে রাজনীতি করতেন। লাল রঙের একটি বিশাল বড় গরু মোজাফ্ফরের মাঠে বাঁধা বাঁশের খুঁটিতে আটকে রাখতে দেখতাম। কুরবানির পর দিন সকালে লাল টুপি মাথায় দিয়ে ন্যাপের কর্মীরা সেটি কুরবানি করেগরিব নেতা কর্মীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।
নামাজ শেষে দ্রুত বাড়ি আসতাম। কার গরু কখন জবাই হয় সেই খবর নিয়ে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখতাম।কোনটি স¦াভাবিকভাবে আমার দাদা জবাই করলেন আর কোনটি জবাইয়ের সময় উঠে দৌড় দিল, তারপর আবার সবাই রক্তমাখা গরুটিকে ধরে এনে পুনরায় শুইয়ে দিল তা খেয়াল রাখতাম।অন্যদের গরু জবাইয়ের দৃশ্য দেখা শেষ হওয়ার পর হঠাৎ মনে হতো ঢোল বানানোর কথা। আর তো ঘুরাঘুরি করা যায় না । দৌড়ে আসতাম আমাদের গরুর কাছে। এতক্ষণে গরুর কাজ অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে। অপেক্ষায় থাকতাম কখন গরুর পেট থেকে বের করা হবে চর্বি জাতীয় এক ধরনের সাদা পর্দা। বড় ভাই সেগুলো আমাদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। আমরা সেগুলো ভাঙা কলসের মুখে লাগিয়ে টিনের চালে শুকাতে দিতাম। কলসের খুলি ঈদের চার-পাঁচ দিন আগে থেকেই সংগ্রহ করে রাখতাম। বিকেল হলেই কচুর চিকন ডগা দিয়ে বাজানো শুরু করতাম ঢোল। ডুম-ডুম আওয়াজে মাতিয়ে তুলতাম সব বাড়ি। একসময় কারটা কত বেশি বাজানো যায় সে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে সেটি ফেটে গেলে কান্না-কাটি করতাম। বাড়িতে যাতে প্রেতাত্মা না ঢুকে সেজন্য গরুর শিংগুলো দরজার পাশে, লাউ ক্ষেতে যাতে কারো নজর না লাগে সেজন্য গরুর দুপাটি দাঁত লাউয়ের মাচার নিচে ঝুলিয়ে রাখতাম।। মধুর আনন্দঘন সেই দিনগুলো ঢোলের আওয়াজের মতো হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। খুব মিস করি সেই দিনগুলোকে। খু–উ–ব। খুব বেশি।
লেখক পরিচিতিঃ সাংবাদিক, ঐতিহ্য গবেষক ওমুরাদনগর সামছুল হক কলেজেরসিনিয়র প্রভাষক।

আরো পড়ুন