পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যা দেখেছি
।। প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট ।।
আগস্ট মাস এলেই মনটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিষণœ ও বিষাদক্লিষ্ট হয়ে পড়ে। কেননা এ মাসে দেশের ইতিহাসে অন্তত দু-দুটো জঘন্যতম-মর্মন্তুদ-নৃশংস-বীভৎস ও পৈশাচিক হত্যাকা- সংগঠিত হয়েছিল । প্রথমটি ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট এবং অপরটি ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট । অবশ্য এ দুটো বর্বরোচিত অতি পরিকল্পিত মানবনিধন ঘটনার একটাই উদ্দেশ্য ছিলো । তাহলো সদ্যস্বাধীন গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে অকার্যকর পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়া। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেরুদ- ধ্বংস ও জনগণের ক্রমশ: উন্নত ও উদার জীবনযাত্রা বা জীবনপ্রবাহ পঙ্গু করে দেয়া। যাতে করে স্বাধীনতা উত্তর নবজীবনপ্রাপ্ত রাষ্ট্রটি বিশে^ একটি মিস্কিনের জাতিতে পরিণত হয় ।
এই বর্বর নির্লজ্জ গভীর ষড়যন্ত্রের সর্বপ্রথম বহি:প্রকাশ ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট । যে কালো ও কলঙ্কজনক দিনে এদেশীয় কিছু কুলাঙ্গার পাকি এজেন্ট স্বাধীন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করে । কেবলমাত্র বিদেশে অবস্থান করার কারণে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান । অপর বর্বরোচিত পৈশাচিক হত্যাকা-টি সংঘটিত হয়েছিল ২০০৪ সনের ২১ আগস্ট। যখন জাতিকে স্বাধীনতা উপহার দেয়া দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও দলীয় প্রধানসহ জাতীয় নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করবার অভিপ্রায়ে এক উলঙ্গ চক্রান্তের অংশ হিসেবে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনূস্থ দলীয় প্রধান কার্যালয়ের সম্মুখে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগ প্রধান ও বিরোধীদলনেত্রী শেখ হাসিনা একটি ট্রাক-ডায়াস থেকে এক মিছিল-পূর্ব সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে হাজার হাজার জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছিলেন। এই হত্যাযজ্ঞে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান ।
প্রথম হত্যাকান্ডটির প্রত্যক্ষদর্শী না হলেও সেসময়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। স্নাতকোত্তর সমাপনী পরীক্ষার লিখিত পরীক্ষা শেষে হলে অবস্থান করে ডিগ্রির জন্যে অত্যাবশ্যকীয় ব্যক্তিগত থিসিস প্রস্তুত করছিলাম। অপর রক্তাক্ত মানবনিধন ঘটনাটির শুধুমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীই নই, ঐদিনের ঘটনাবলীর ওপর রিপোর্ট করবার জন্যে দ্য ডেইলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে নিয়োজিত (এ্যাসাইন্ড) হয়েছিলাম । তবে পরমপিতার অশেষ করুণায় সে হত্যাযজ্ঞ থেকে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। তাই এই স্মৃতিচারণমূলক লেখা সম্ভব হয়েছে ।
অবশ্য দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায় বা রক্তাক্ত ঘটনাটির ওপর আজ লিখতে বসিনি । ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের মহান শহীদদের অতল শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে ঐ কালিমালিপ্ত ঘটনা বা অধ্যায়ের শুধুমাত্র স্মৃতিচারণ করছি। সেদিনটি আপাতদৃষ্টে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসে বা জীবনে অন্যতম প্রণিধানযোগ্য বা ‘রেড লেটার’ দিন হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকতে পারতো । বাস্তবে হয়েছে তার উল্টোটি, অর্থাৎ সবচাইতে শোকবিধূর কালো কলঙ্কজনক একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে ।
ঐ দিনটিতে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনীতির কবি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক ডক্টর-অব-ল বা ডি-লিট ডিগ্রিতে (উপাধি) ভূষিত করবার জন্যে নির্ধারিত ছিল। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই মহানায়ককে বেশ কিছু বছর আগে বহিষ্কার করবার ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যেই যেন এ আয়োজন করেছিল। এর আগে প্রায় একমাস পূর্বাহ্ন থেকেই চলছিল আড়ম্বরপূর্ণ ও আলোকোজ্জল সংবর্ধনার প্রস্তুতি। বেশ কিছু বছর আগে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র হয়েও বঙ্গবন্ধু চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারীদের এক ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবার অভিযোগে বহিষ্কৃত হন। ঐ দিনের কর্র্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুর কলা ভবনের সেইসব স্মৃতিবিজড়িত স্থানসহ ঐতিহাসিক বটতলা, জগন্নাথ হল-এর বধ্যভূমি, ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ইত্যাদি ঘুরে ঘুরে দেখবার কথা ছিল । যেসব স্থাপনা ও পথ দিয়ে জাতির জনকের যাবার কথা ছিল তা আলোকমালা ও অনুপম চিত্রকর্মে সজ্জিত করা হয়েছিল । যথাযথ পথ-নির্দেশিকাও প্রস্তুত করা হয় । ইউওটিসি এবং ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনি নের এক বিশাল সুশৃংখল যৌথ কর্মীবাহিনী তাঁর যাত্রাপথে শান্তি-শৃংখলা রক্ষার্থে ও অভিবাদন জানাবার জন্যে রীতিমত প্রশিক্ষণ নিয়েছিল । চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরা সুদৃশ্য গ্র্য্রাফিটি, ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টার প্রস্তুত করে এবং বঙ্গবন্ধুর জন্যে স্থিরিকৃত যাত্রাপথে আলপনা এঁকে দিয়ে প্রায় সমস্ত বিশ^বিদ্যালয় এলাকা সুসজ্জিত করে রেখেছিল ।
তাছাড়া বর্ণিল আলোকসজ্জায় সেজেছিল বিশ^বিদ্যালয় যেন কোন রাজকন্যা অপরূপ সাজে সেজেছে এই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানের জন্যে । শুধুমাত্র ইতিহাসের সেই রাখালরাজাকে ক্যাম্পাসে বরণ করে নেবার জন্যে । কিন্তু হা হতোস্মি-সবই পন্ড ও বিপর্যস্ত হল পরিবারসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণে সেই বিশেষ দিনটিতে । যা তাঁর স্বঘোষিত আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীরা বেছে নিয়েছিল তাদের চরম আঘাতের নিমিত্তে । আবার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের উল্টোযাত্রা শুরু হল সেই কালোদিনটি থেকে। জনাকয় পাকি উচ্ছিষ্টভোগী উচ্চাভিলাসী সেনা সদস্যের জিঘাংসার কারণে ।
১৪ আগস্ট অনেক রাত মানে ২.৩০ মিনিট পর্যন্ত ইউসুফ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক শ্রদ্ধেয় রমনীমোহন দাশের বড় ছেলে আমাদের সহপাঠী ও বন্ধু ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী অনুপম দাশসহ আরো ক’জন হলমেট বর্ণিল আলোকচ্ছটায় সজ্জিত কলা ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা দেখতে গিয়েছিলাম । আমাদের ধারণা ছিল হাজার-হাজার ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ জনগণ বঙ্গবন্ধুকে প্রদেয় এই অভূতপূর্ব ডি-লিট প্রদান অনুষ্ঠান-কাম-গণ সংবর্ধনা প্রত্যক্ষ করবেন পরদিন । কিন্তু বিধি বাম, কেননা খুব ভোরে অনুপম আমাদের উত্তর বাড়ির প্রথম তলার ৪৯ নং রুমে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুললো এবং বললো—মেজর শরিফুল হক ডালিম বাংলাদেশ বেতার (শাহবাগস্থ ট্রান্সক্রিপশান সার্ভিস) থেকে কিছু ক্ষণ পর পর ঘোষণা করছে “স্বৈরাচারী” শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।
আমাদের মতো সমস্ত জাতি এ অনভিপ্রেত-অযাচিত-অপ্রত্যাশিত ঘোষণায় হত-বিহ্বল, স্তব্ধ, হতবাক ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে । যেন সমস্ত বাংলাদেশ কান্নাটুকু পর্যন্ত ভুলে গেছে। আমরা ক’জন হলমেট সহশ্রাংশু গুপ্ত গৌতম, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল চক্রবর্তীসহ সহপাঠীবন্ধু তৎক্ষণাৎ আশঙ্কা প্রকাশ করলাম—অল্প কিছুক্ষণ পরই আমাদের হল আক্রান্ত হবে । কেননা কোন ধর্মীয় দাঙ্গা থেকে শুরু করে যেকোন মনুষ্যসৃষ্ট জাতীয় দুর্যোগকালে জগন্নাথ হলকেই প্রথম লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে নিকট অতীতকালে ।
এই দু:সময়ে আমরা কোথায় সম্ভাব্য আশ্রয় নিতে পারি তা-ও আলোচনায় এল । আমি বল্লাম, নিরেট অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ক.আ.ই.ম. নূরুদ্দিন স্যারের হল সংলগ্ন আবাসে অথবা ঐ শিক্ষকদের কোয়ার্টারে অধ্যাপক সনজিদা খাতুনের বাসায় বিকল্প হিসেবে আপাতত: আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার কথা বললো। যে কথা সেই কাজ । হল থেকে ছাত্রদের একটা শ্লোগানবিহীন মিছিলে সামিল হয়ে আমরা ক’জনা শামসুননাহার হল পেরিয়ে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের কাছাকাছি গিয়ে একটা সামরিক বাহিনীর অগ্রসরমান সাঁজোয়া যান ট্যাঙ্ক-এর নজল্ (গোলানিক্ষেপকারী পাইপ) দেখতে পাই । সঙ্গে সঙ্গে আমরা আতঙ্কে বিদ্যুৎ বেগে হলে পিছু হটে আসি ।
কিছু সময় পর হলের এক সহপাঠী (মেট) এসে খবর দেয় তথাকথিত সেনা অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বিপথগামী সেনা সদস্যরা এবং তাদের নেতারা ট্যাঙ্কের ওপর থেকে জনগণের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন (হ্যান্ডশেক) উপাচার্যের অফিস ও সিনেট সংলগ্ন মাঠে (মল এরিয়া)। তিনি সে দৃশ্য দেখেছেন । তারা উপস্থিত কিছু সংখ্যক উৎসুক মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন এই বলে যে, দেশের জনগণের ওপর তাদের কোন ক্রোধ বা বিতৃষ্ণা নেই । দেশবাসীর কোন ক্ষতি করতে তারা গ্যারিসন থেকে রাস্তায় বের হননি । এই বলে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজনকে তারা আশ^^স্ত করছিল–যেন তারা আর একটি হিমালয়ের মাউন্ট এভারেস্ট লঙ্ঘন করেছেন বা ভূমিধ্বস (ল্যান্ড স্লাইড) বিজয় অর্জন করে এসেছেন ।
কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি, এই নারকীয় হত্যাকা-ের সবচাইতে বিস্ময়কর দিক হলো–শাসকদল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠন বা অন্য কোন স্বাধীনতাপন্থী রাজনৈতিক-সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে কোন প্রতিরোধতো এই জঘন্য বর্বরোচিত হত্যাকা-ের প্রতিবাদে হয়ইনি, এমনকি কোন মিছিল-মিটিংও হয়নি। সমস্ত জাতি স্তম্ভিত বিস্ময়ে পরবর্তী ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছে মাত্র । তবে পরবর্তীতে শুনেছিলাম, পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুল করিম সাহেব বংশাল এলাকা থেকে এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ১৫ আগস্টই একটি ছোটখাট মিছিল বের করেছিলেন। তার পুরস্কার হিসেবে ২১ বছর পর ক্ষমতারোহন করে আওয়ামীলীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফজলুল করিম সাহেবকে কোতয়ালী-সূত্রাপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেন। কিন্তু তিনি ঐ নির্বাচনে হেরে যান ।
ঐ কালোদিনের দুপুর বেলায় অপর একটি অনভিপ্রেত-অপ্রত্যাশিত দৃশ্য অবলোকন করেছিলাম । আর তা হলো–দলে দলে সাধারণ জনগণ আমাদের হলের সন্নিকটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের দিকে যেন মিছিল করে চলেছেন । যেখানে ১৫ আগষ্ট হত্যাযজ্ঞের আওয়ামী যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণিসহ অন্যতম কয়েকজন শহীদের মরদেহ ফেলে রাখা হয়েছিল । যাতে করে জনগণ তাদের বুলেটবিদ্ধ বিকৃত ঝাঁঝরা হওয়া মরদেহ দেখে শিহরিত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে ।
আমরা ক’জন বন্ধুও দেখতে গিয়ে পুঁতিগন্ধময় মশা-মাছির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র ঐ মর্গের পরিবেশে তিষ্ঠাতে না পেরে হলে ফিরে আসি। আমাদের সঙ্গে পিকিংপন্থী বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতাও ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে অবস্থিত মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে (বর্তমানে পাট অধিদপ্তরের অফিস) বোমা মারার অভিযোগে জেল খেটেছিলেন । শুনেছি বর্তমানে তিনি তার কোলকাতার বাড়িতে ঘোর ধর্মান্ধ শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অফিস খুলেছেন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের কট্টর সমর্থক হিসেবে। মনে পড়লো, মস্কোপন্থী বামেরা কেন পিকিংপন্থীদের তস্কর বলে আখ্যায়িত করতো সেসময় ।
অনেক বছর পর প্রচলিত আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের জীবিত আত্মস্বীকৃৃত ১১ জন খুনীকে মৃুতুদণ্ড প্রদান করা হয়। তারমধ্যে বিচার ও আপীল শেষে পাঁচ জন ঘাতকের (খুনির) রায় কার্যকর করা হয়েছে ইতোমধ্যে । এখন শোকস্তব্ধ বিক্ষুদ্ধ জাতি বিদেশে পালিয়ে থাকা অপর ছয় খুনীকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করবার জোর দাবি জানিয়ে আসছে প্রতি বছর শোকের এই মাসটিতে । যাতে করে জাতি একটি দীর্ঘকালের কলঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারে ।
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দলের বিভিন্ন মিটিং-এ ও আলোচনা সভায় প্রায়শ:ই একটা উক্তি করতে শুনেছি। আর তা হচ্ছে—আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের বদান্যতায় বা অবদানের ফলশ্রুতিতে যখনই একটু সুখের মুখ দেখতে পায়, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী চিহ্নিত একটি চক্র জাতির জন্যে একটা না একটা বিপদ-বিপর্যয় ডেকে আনে ।
বর্ষিয়ান আওয়ামীলীগ নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সেসময়কার বিরোধীদল আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের এক আলোচনা সভায় তার এক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন । তিনি বলেন তিনি এক ব্যক্তিগত সফরে বাগদাদ গিয়েছিলেন বেশ কিছু বছর আগে (সম্ভবত: জাতীয় পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হবার পর)। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে তিনি ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে একটা কমদামী হোটেলে নিয়ে যেতে বলেন । তিনি বাংলাদেশী শুনে আরবী ট্যাক্সি ড্রাইভার তাকে তৎক্ষণাৎ ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতে বলে । কারণ জিজ্ঞেস করলে তখন ট্যাক্সি ড্রাইভার বলেছিল-যারা তাদের জাতির পিতাকে হত্যা করেছে সে দেশের নাগরিকদের তিনি ঘৃণা করেন । তার ট্যাক্সিতে চড়াননা ।
জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনকালে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও দলের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য জনাব তোফায়েল আহমেদ প্রায়শ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী সমাজতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিউবার অবিসংবাদিত প্রয়াত নেতা ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন ।
কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবীতে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ শিখর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক সচিব জনাব তোফায়েল আহমেদ । সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে দেখে ক্যাষ্ট্রো বিশ^নেতৃবৃন্দের সম্মুখে বলেছিলেন—আমি হিমালয় পর্বতমালা দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবর রহমানকে দেখেছি ।
এই মন্তব্য থেকেই প্রতীয়মাণ হয় আমাদের জাতির জনক কী পর্বতপ্রমাণ উচ্চতার অধিকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন ।
“কাঁদো বাঙালী কাঁদো”—কী সম্পদ তোমরা হেলায় হারিয়েছো, এখনো বুঝতে পারছোনা।
পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহীদদের বিদেহী আত্মার প্রতি অতল শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি ৪৫তম জাতীয় শোক দিবসের প্রাক্কালে ।
লেখক:সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক সাধারণ
সম্পাদক, কুমিল্লা প্রেসক্লাব।