ভাত দিয়ে দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবি সাটিয়ে ছিলাম

।। জয়নাল আবেদীন রনি ।।
‘নয়ন সমুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’
প্রিয় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই হল আমার উপলব্ধি। খুব ছোট বেলায় আমি একবার বঙ্গবন্ধুর একটা হাসিমাখা ছবি এঁকেছিলাম। পেন্সিল দিয়ে। পরীক্ষায় আমরা যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছি, তাদেরকে কিছু চিত্র বাধ্যতামূলক আঁকতেই হত। আমিও ঠিক সেই দলেরই চিত্রকর। কিন্তু এর বাইর জীবনে একবারই মানুষের ছবি এঁকেছিলাম, সেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি। সেই ছবিটা আমি আমার শোবার ঘরে ভাত দিয়ে আঁঠা বানিয়ে দেয়ালে সাটিয়ে দিয়েছিলাম। একটা ছেলে আমার খেলার সাথী ছিল। এত বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলাম যে এ ওর বাড়িতে অনায়াসেই যেতাম। স্বাভাবিকভাবেই ও আমার বাসায় এসে বঙ্গবন্ধুর ছবিটা দেখল। আমার অনুপস্থিতিতে ও বঙ্গবন্ধুর ছবির মুখের অংশটুকু ছিড়ে ফেলে দিয়েছিল। কারণ ওর পুরো পরিবার তখন ছিল অন্যদলের সমর্থক। এত ছোট বয়সে এমন আচরণ দেখে আমি যারপরনাই আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম। এর অনেক পরে, ওর বাবার সাথে কি একটা বিষয় নিয়ে স্থানীয় বিএনপির সাথে খুব ঝামেলা হয়। ওর পরিবার আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। তখন আবারও বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে মিছিল করতে গিয়ে বিরোধী পক্ষের লাঠিপেটাও খায়। ও তখন ছিল বঙ্গবন্ধু প্রেমিক। হালের আলোচিত শাহেদকেও দেখলাম তিনি বঙ্গবন্ধু বলতে অজ্ঞান ছিলেন। এমন অনেকেই তাদের কুকর্মকে ঢাকছেন বঙ্গবন্ধুর সাইনবোর্ড ব্যবহার করে। ইসলামে সকল কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে বলা হয়েছে বরকত লাভের জন্য। কিন্তু এটাও নিষেধ আছে, কোনো হারাম কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর মত মহীরুহ, পরম পূজনীয় মানুষের নাম নিয়ে তথাকথিত প্রেমিকেরা যখন কুকর্মে জড়িয়ে যায়, সেটা কি চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়! আমাদের সমাজে নিয়মিত ধর্মকর্ম পালন করা মানুষজনকে চারিত্রিক দিক দিয়ে আদর্শ মানি। তাই তাদের খোলামেলা পার্কে মেয়ে নিয়ে ঘোরাঘুরি বেশি দৃষ্টিকটু লাগে বলেই পাবলিক রিএক্ট করে। তাই যিনি এই দেশকে, জাতিকে জন্ম দিয়েছেন, সেই মহান বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে কেউ যদি নিজেকে দাবি করেন এবং পরবর্তীতে এই সৈনিকটির অসামাজিক আচরণ দেখতে পাওয়া যায়, তখন সাধারণ মানুষের বুকে কষ্ট একটু বেশিই লাগে। ছোটবেলায় গান শিখলেই যে বড় গায়ক হওয়া যাবে তা কিন্তু নয়। তাল লয় এবং বিশেষ করে কণ্ঠ কিন্তু ঐশ্বরিক দান। এই জন্য গানের গ্রামার জানলেও শুধু কণ্ঠের জন্য অনেকেই বড় গায়ক হতে পারে না। আবার কখনো গান না শেখা কিশোর কুমারের মত ভুবন বিখ্যাত গায়কও আমরা পেয়ে গেছি। কাজেই কিছু মানুষের মধ্যে প্রকৃতিই বিশেষ কিছু দান করেন। তাই তারা অনন্য, অদ্বিতীয়। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুও আসলে আমাদের জাতির পিতা হতেই জন্মেছিলেন। প্রকৃতিই তাঁকে সাজিয়েছেন একজন নেতা হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর শুধু বাহ্যিক অবয়বটাই খেয়াল করে দেখুন – এত লম্বা চওড়া,এত ভরাট ও দরাজ গলা,এত বিস্তৃত চিন্তাশক্তি সবকিছুই কিন্তু প্রকৃতি অকাতরে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়লেই বুঝা যায়, তিনি আসলে ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েই ছিলেন। তিনি তার সময়ের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়েই ছিলেন। ছোটবেলায় তিনি তার গণ্ডির মধ্যে মানুষের সেবা করেছেন। বড় হয়ে তিনি জাতিকে মুক্তি দিয়েছেন। যারা অন্যকে ভালবাসার অভ্যাস করে ফেলে,তারা আসলে সেই অভ্যাস আর ত্যাগ করতে পারে না। তিনি সারা জীবন বাঙালি জাতির জন্য সংগ্রাম করেছেন, আমাদের ভালবেসেছেন। তাইতো, গোয়েন্দারা স্বাধীনতার পর বার বার সতর্ক করার পরেও তিনি সবাইকে শুধু ভালবাসাটাই দিয়ে গেছেন ; প্রতিদানে তিনি এবং তার পরিবার কি পেলেন, সেই শোক কখনো মুছবার নয়। কিউবার স্বাধীনতার নায়ক ফিদেল কাস্ত্রো তার স্বপ্নের মত করে দেশকে সাজিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা অনেক সংগ্রামের পর দেশের দায়িত্ব নিয়ে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। মাহাথির মোহাম্মদ শতবর্ষেও মালেশিয়ার অগ্রযাত্রায় সামিল হয়েই আছেন। অথচ,আমরা কতইনা তাড়াতাড়ি বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি। আহা! বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এ দেশের কত কিছুইনা নেয়ার ছিল। সংসারে অনেক কিছুর প্রতিস্থাপন করা গেলেও জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার কোনো প্রতিস্থাপন নেই। বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন রাজনীতির মাঠে থেকে যে স্বর্ণালী অভিজ্ঞতা নিয়েছেন তার যথাযথ প্রয়োগের সময়টুকু যদি তিনি পেতেন, তবে আমরা স্বাধীনতার সঠিক স্বাদ পেতে পারতাম। চীন আগে ক্লোজড ইকোনমিতে বিশ্বাস করত। এখন চীন পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক না আবার গণতান্ত্রিকও না। একটা ভিন্ন নিজস্ব নিয়মে চলছে। রাশিয়ার মত দেশ সমগ্র বিশ্বে যারা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছিল, তারা সময়ের বিবর্তনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে দিয়েছে। প্রয়োজনের ভিত্তিতে বারবার সংবিধান পরিবর্তন করেই যাচ্ছে। আসলে যুদ্ধ বিধস্ত একটা দেশ ঠিক পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ফর্মুলাতেই এগিয়ে যাবে বা এগোবে না এমন মন্তব্য চট করে করা যায় না। তাই নতুন দেশকে অনেক সময় নানা অর্থনৈতিক মডেল চর্চা করতে হতে পারে। সেকারণেই বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অনেক সিদ্ধান্তই পরিবর্তন করতে হয়েছে। খোলা চোখে সেসব বিষয়কে বিবেচনা না করে বরং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে চিন্তা করলেই বুঝা যায় বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল কত বেশি কল্যাণকামী। সুপার শপে গেলে লক্ষ্য করবেন একিই ব্রান্ডের সাবান দেশে উৎপাদিত পাওয়া যায়, আবার সেই সাবানটিই অন্যান্য দেশ যেমন ইউকে,থাইল্যান্ড বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত পাওয়া যায়। আসলে এক একটা দেশের প্রসাধনী ওই দেশের সামগ্রিক আবহাওয়া, সেই দেশের মানুষের গায়ের চামড়ার গুণগত মানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। অথচ, আমরা মেড ইন ইউকে দেখলেই দেশেরটা রেখে ওইটাই কিনে ফেলি। আসলে কিন্তু আমার দেশে উৎপাদিত পণ্যটাই আমার উপযোগী করে তৈরি করা। দেশের তৈরি পণ্যটাই ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর। বঙ্গবন্ধু তাই তার অভিজ্ঞ এবং স্বকীয় ধারাতেই এগোচ্ছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক চক্রান্ত আমাদের শতবর্ষ পিছিয়ে দিল। কোনো জাতিকে পিছিয়ে দেয়ার জন্য সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বা জ্ঞানীগুণীদের ধ্বংস করে দিলেই হয়। সেকারণেই ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা বেছে বেছে দেশের প্রখ্যাত সব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এই ধারার শেষ পেরেকটি মারে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। কিন্তু তারা যেটা বুঝতে পারেনি, সেটা হল বঙ্গবন্ধুর মত মানুষের শারীরিক মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু তিনি অমর। তাইতো,আমাদের দেশের আপামর সকলের মনে বঙ্গবন্ধু চির ভাস্বর, চির উজ্জ্বল। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এ ভালবাসা, এ শ্রদ্ধা কখনো শেষ হবার নয়।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা।