নাসরুল্লাহ-কামালে লোপাট জনস্বাস্থ্যের শত কোটি!

অফিস রিপোর্টার॥
শতকোটি টাকা লুটের অভিযোগ উঠেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ ও সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের কথিত উন্নয়ন সমন্বয়ক কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে। গত ৪ বছরে এসব টাকা আত্মসাত করা হয়। একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ৪ বছরে কুমিল্লায় হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কার্যালয়। যেসব কাজের ১০ পার্সেন্ট কখনও টাকার বিনিময়ে নির্দিষ্ট লোককে টেন্ডার দেয়া, অযোগ্য ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করানো, এক কাজের ঠিকাদার দিয়ে অন্য কাজ করানো, কাজ করানোর বদলে টাকা লোপাট, মন্ত্রীর পিএয়ের মাধ্যমে টাকা দিয়ে বদলি ও অন্যান্য কাজসহ নানান অভিযোগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এনিয়ে দুদকেও অভিযোগ করা হয়েছে। দুদকের তিন সদস্যের একটি টিম জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কুমিল্লায় অভিযান করেছে।
জানা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা জেলায় যোগদান করেন। অভিযোগ আছে সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর উন্নয়ন সমন্বয়ক ও কথিত পিএস মো. কামাল হোসেনকে ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে কুমিল্লায় আসেন তিনি। তিনি একজন ৯ম গ্রেডের কর্মকর্তা। কিন্তু তিনি ৫ম গ্রেডে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে চাকরি করছেন। কুমিল্লাতে আসার পর প্রায় পাঁচ শতাধিক টেন্ডারের মাধ্যমে শত কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য করে নেন।
মাত্র ৪ দিনে আড়াই কোটি টাকার কাজ শেষ!
মাত্র চারদিনে আড়াই কোটি টাকার কাজ সমাপ্ত! ২০২২ সালের ২৬ জুন কার্যাদেশ দেয়া কাজ মাত্র চারদিন অর্থ্যাৎ ৩০ জুলাই শেষ হয়ে যায়। আড়াই কোটি টাকার এই কাজ সম্পন্ন ও চূড়ান্ত বিল প্রদানের মত মহা হরিলুট করেছেন এই কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর পিএ।
জানা গেছে, প্রকল্পটি ছিল ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে পল্লী অঞ্চলে পানি সরবরাহের প্রকল্প। এ কাজের দরপত্র আইডি-৭০৮৬৪২, প্যাকেজ নং ছিল ভিডব্লিউএসপি-১৯৯৮/৫। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কার্যাদেশ প্রদানের চারদিনের মাথায় কোনরুপ কাজ সম্পাদন না করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনের নামে চূড়ান্ত বিল প্রদান করে। যে টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। ওই প্রকল্পের প্যাকেজে ১০০টি গভীর নলকূপ ও ১০০টি আয়রন রিমুভাল প্লান্ট স্থাপন কাজে কমপক্ষে ছয়মাস সময়ের প্রয়োজন। সেখানে তিনি কিভাবে মাত্র চার দিনে কাজ সম্পন্ন ও চূড়ান্ত বিল প্রদান করেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে ১০ পার্সেন্ট
জানা গেছে, একটি প্রকল্পের আওতায় তিনি ৪টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করেন। সেগুলো থেকে সিএস বাবদ নিজে, প্রকল্প পরিচালক, প্রধান প্রকৌশলী, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর নামে ১০ পার্সেন্ট অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে অপর এই চারটি প্যাকেজ (৭০৮৬৩৭, ৭০৮৬৩৮, ৭০৮৬৩৯, ৭০৮৬৪১) এ কোন সাইট প্রদান করতে পারেন নাই। এই চারটি প্যাকেজ বাবদ অবশ্য তিনি ঠিকাদারদের অগ্রিম পানি পরীক্ষার চালান জমা ও মালামাল পরীক্ষা করান, যা আদৌ কাজ হয় নাই।
জানা গেছে, এসব দরপত্রেও অনিয়ম হয়েছে। দরপত্র আইডি ৭০৮৬৪২ এর প্রাক্কলিত মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা। অপর চারটি দরপত্র আইডি (৭০৮৬৩৭, ৭০৮৬৩৮, ৭০৮৬৩৯, ৭০৮৬৪১) এর প্রাক্কলিত মূল্য প্রায় এক কোটি ৯৫ লক্ষ। অথচ ঠিকাদারের আনুকূল্য প্রদান ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে বিল উত্তোলন করে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ৭০৮৬৪২ এ একক কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় মাত্র এক কোটি ৪০ লাখ টাকা। অন্য চারটি আইডিতে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এতে করে তিনি পিপিআর- ২০০৮ বিধির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন। জানা গেছে, এই যে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনের সনদ অনুযায়ী একক কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। জানা গেছে, উক্ত সনদও কাজ চূড়ান্ত হওয়ার পূর্বেই প্রদান করেন। প্রাক্কলিত মূল্য এক কোটি ৯৫ লাখে অভিজ্ঞতার সনদ চাওয়া হয় এক কোটি ৭৫ লাখ এবং প্রাক্কলিত মূল্য ২ কোটি ৫০ লাখ এর অভিজ্ঞতার সনদ চাওয়া হয় ১ কোটি ৪০ লাখ, যা মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনের একক কাজের সনদ। এতে করে বুঝা যাচ্ছে যে, সরকারি অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে তিনি পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে বিল উত্তোলন করেছেন। তাছাড়াও উক্ত কাজে (দরপত্র আইডি ৭০৮৬৪২) টার্নওভার ৫ বছরে ১১ কোটি চাওয়া হয়েছে। যা মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশন এর রয়েছে ৭ কোটি ৫০ কোটি। রুদ্র কনস্ট্রাকশন এর টার্ন ওভারে বিভিন্ন কাজের সার্টিফিকেট অন্য ঠিকাদারের কাগজে নির্বাহী প্রকৌশলী নাসরুল্লাহ নিজে স্বাক্ষর করে রুদ্র কনস্ট্রাকশনের নামে দিয়ে দেয়।
এছাড়াও তিনি ঠিকাদারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে কার্যাদেশের ১০শতাংশ টাকা গ্রহণ করতেন। জানা গেছে, সারাদেশে ১০শতাংশ লেসে কাজ হয়। কিন্তুমন্ত্রীর সমন্বয়ক কামাল হোসেন প্রভাব খাটিয়ে উক্ত কাজ ১০শতাংশ উর্ধ্বদরে পাস করিয়ে নিতেন। তাছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাসরুল্লাহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর তাজুল ইসলামের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন কাজে অনিয়ম চালিয়ে আসছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাসরুল্লাহ বর্তমানে কয়েক শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক। চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকায় পাঁচতলা বিলাস বহুল ভবন নির্মাণ করেছেন। কুমিল্লা লালমাই পাহাড়ে তার বড় ভাইয়ের নামে ৫০ একর জায়গা ক্রয় করেছেন। ঢাকার পূর্বাচলে ১০ কোটি টাকা দিয়ে তিনি প্লট কিনেছেন। তিনি তার এক বড় ভাইয়রে নামে দুইটি প্রিমিও গাড়ি ৮০ লাখ টাকায় কিনেছেন। একটি তিনি নিজে ব্যবহার করেন। নিজের ব্যবহারকৃত গাড়ি নম্বর: ঢাকা মেট্রো-গ-২০-৮৫১৩। আর অন্যটি তার স্ত্রী সুরাইয়া সানজিদা চৌধুরী ব্যবহার করেন। তার স্ত্রী সুরাইয়া সানজিদা চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রাম বিএসটিআই এর সহকারী পরিচালক পদে কর্মরত রয়েছেন। তার স্ত্রীও প্রায়শই সবাইকে ভয় দেখান এই বলে যে, তার স্বামী মো. নাসরুল্লাহ সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সাথে উঠাবসা করেন। তার অবৈধ টাকা স্বজনদের একাউন্টের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। ( স্বজনের নাম ও নম্বর গুলো সংরক্ষিত রয়েছে।)
এছাড়াও তিনি তার বিভিন্ন ঠিকাদারদের একাউন্টে শতকোটি টাকার লেনদেন রয়েছে যা সরোজমিনে তদন্ত করলে বের হয়ে আসবে। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান থেকে তার ও তার স্ত্রীসহ আত্মীয় স্বজনের একাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। যার প্রমাণ এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অধিদফতরের বদলি বাণিজ্যের মূল হোতা এই কর্মকর্তা মো. নামরুল্লাহ। নাসরুল্লাহ তার সমপর্যায়ের কর্মকর্তা তথা নির্বাহী প্রকৌশলীদেরও মন্ত্রীর সমন্বয়ক কামালের মাধ্যমে ব্যক্তিগত বিরোধের জের ধরে নির্বাহী প্রকৌশলীদের বদলী বাণিজ্য করে থাকেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের স্মারক নং ৪২৯ অনুসারে ঋত্তিক চৌধুরীকে কক্সবাজার থেকে বরিশাল বদলি করেন। সফিকুল আলমকে ফরিদপুর থেকে রাঙ্গামাটি ও পরবর্তীতে ৪৮২ স্মারক অনুসারে মাদারীপুরে বদলী করা হয়। এভাবে তিনি তার ব্যক্তিগত আক্রোশকে কাজে লাগান। এভাবে তিনি দাফতরিক কাজকর্ম বাদ দিয়ে সকাল থেকে শুরু করে মধ্যরাত অবধি বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্ট এমনকি অফিসে বসেও বদলি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ও কমিশন বাণিজ্য করে থাকেন। হোটেল গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কুমিল্লার মিয়ামী রেস্টুরেন্ট, হোটেল নুরজাহান, হাই ওয়ে ইন, অফ-বিট রয়েছে। এই হোটেল গুলোর বিভিন্ন সময়ের সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করলে তা বের হয়ে আসবে। তিনি তার ঘুষের টাকা ক্যাশিয়ারের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। অভিযোগ আছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিবিএস পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে ১৭ জন নন ক্যাডার অফিসারকে ক্যাডার পোস্টে পদায়নের মাস্টার মাইন্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাসরুল্লাহ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের অবৈধ ইনকামের ক্যাশিয়ার মো. নাসরুল্লাহর মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা লেনদেনের বিনিময়ে এই অফিসার গুলিকে ক্যাডার পোস্টে পদায়ন করা হয়। এখানে উল্লখ্য যে, মো. নাসরুল্লাহ নিজেও বিসিএস ক্যাডার পরীক্ষা না দিয়ে বিসিসি ক্যাডার পোস্ট অর্জন করেছেন। এনক্যাডারমেন্ট গেজেটের ৬৭-৮৩ পর্যন্ত হল বিসিএস পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে ক্যাডার তালিকা। যার মধ্যে রয়েছেন অত্যন্ত (স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালায়ের সাবেক প্রভাবশালী এক সচিবের কন্যা। এই সচিবের কন্যাসহ প্রতিজনের কাছ থেকে এক কোটি ২০ লাখ টাকাসহ মোট ২০ কোটি টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে ক্যাডার দাবি করে নিজেদেও বীরদর্পে জাহির করেন।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহকে কল দিলে তিনি এই প্রতিবেদককে এসব বিষয় পুরোপুরি অস্বীকার করেন। তিনি তা মিথ্যা বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, আমার আত্মীয় স্বজনদের একাউন্ট থাকতেই পারে। আর একাউন্টে টাকা আসতেই পারে। এসব অভিযোগ দিয়ে আমাকে হেনস্থা করা হচ্ছে।
তার স্ত্রীর প্রভাব বিস্তার ও মন্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা তা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, এগুলো আমি বলার কথা না। এগুলো আমি কিভাবো বলবো?
৯ম গ্রেডে চাকরির বিষয়ে তিনি বলেন, এটি মন্ত্রণালয়ের বিষয়। অনেকেই চাকরি করছেন আমাদের সাথে। আর মন্ত্রীকে ব্যবহার করে ট্রান্সফার করানোর বিষয়ে তিনি বলেন, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা বিষয়।
এবিষয়ে দুদক কুমিল্লা অফিসের উপ-পরিচালক ফজলুল হককে একাধিক কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে অপর এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা একটি ইমফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়েছি। এর ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি খুবই গোপনীয় ও সংবেদনশীল। তাই এক্ষুনি কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা খুবই নিখুঁতভাবে এই প্রতিবেদন দিয়েছি। এই বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।