প্রজন্মের আত্মত্যাগ ও স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি

 

inside post

।। মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম সোহেল ।।
বাংলাদেশের জনগণের জন্য নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবার এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমাজকে নতুন ভাবে আলোকিত করার আরো একটি সুযোগ সৃষ্টি হলো। একটা বিষয় সবসময় মনে রাখতে হবে এই ধরনের সম্ভাবনা কিংবা সুযোগ বারবার আসবেনা। সম্ভাবনাটি এমন প্রজন্মের দ্বারা পরিচালিত হযয়েছে যারা অন্যায়কে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেনি। এরাই সেই তরুণ যারা অন্যায় ও দুর্নীতির প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিহত হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে জীবনের সাথে লড়াই করছে, অনেকেই স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, আহত হয়ে শরীরে বুলেট বহন করছে। এই প্রজন্মের আত্মত্যাগের বিনিময়ে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানে ১৬ বছরের আওয়ামী স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। দেশের দুঃসময়ে আত্মত্যাগী এই প্রজন্মের প্রতি রইল অবিরাম ভালোবাসা।
উল্লেখিত সময়ে পরিকল্পিতভাবে ব্যাংক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার নীলনকশা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করে পুরো জাতিকে ঋণের জালে আবদ্ধ করা হয়েছে। উন্নয়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে দুর্নীতি উৎসবে পরিণত হয়েছে । প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয় শিক্ষা ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা,বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ বাহিনী, নিয়োগ ব্যবস্থা। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে চেতনার ফেরিওয়ালা শেখ হাসিনা ইতিহাসে পাতায় একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত, ক্ষমতালিপ্সু ও প্রতিহিংসা পরায়ণ শাসক হিসেবে বিবেচিত হবেন।
অতীতের গণঅভ্যুত্থানের সাথে এই গণঅভ্যুত্থানের স্পষ্ট পার্থক্য হল দলকানা হওয়ার কারণে জাতীয় মসজিদের খতিব পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী,সকল মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সকল বিচারপতি, চারটা পার্লামেন্টের সকল পার্লামেন্ট মেম্বার, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে সকল জনপ্রতিনিধি, পুলিশ বাহিনীর প্রধান থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত, সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা থেকে নিম্নস্থ কর্মচারীর অনেকই দেশ ছেডয়ে পালিয়েছেন। কেউ দেশে আত্মগোপন করে আছেন। যারা আছেন তাদের অধিকাংশই আতংকিত! যা ইতিহাসের একটি নজিরবিহীন ঘটনা। পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী প্রজন্ম রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এখনো সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
হুইলচেয়ার সারভাইভার ও দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের একজন হিসেবে দেশের বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন থাকা এই গণঅভ্যুত্থান আমাকেও আশান্বিত করেছে। আমি আশা করি চলমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের সাথে সংঘটিত অপরাধসমুহ ও এর সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করবে। সবকিছুর উর্ধ্বে থেকে সতর্কতার সাথে তদন্ত কাজ সম্পূর্ণ করে সত্যিকারের দোষীদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে। এতে ভবিষ্যতে আর কেউ রাষ্ট্রের সাথে অপরাধ সংঘটিত করতে সাহস পাবে না। দেশে প্রায় পাঁচ কোটির কাছাকাছি তরুণ প্রজন্ম যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। যারা দেশের অন্যতম শক্তি। আমরা সবাই অবগত আছি বিশ্বের নানা দেশে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোন সরকারের আমলেই তরুণ প্রজন্মের জন্য সময়োপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাইনি। আমি মনে করি চলমান সরকার কিংবা পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার যারাই দেশ পরিচালনা করবেন তারা তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে নানা প্রকল্প হাতে নেবে। তরুণ প্রজন্মকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখবে। আর এই চিন্তা সফলতার মুখ দেখলে আমাদের তরুণরা দেশ এবং ও বিশ্বের জন্য দক্ষ হয়ে গড়ে উঠবে।
অর্থপাচার,ঋণ খেলাপি, অসঙ্গতিপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বৃত্তায়নসহ নানা অসংগতিপূর্ণ বিষযয়ে বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রীর নীরব ভূমিকা বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থাকে একটি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের কৃষক, রেমিটেন্স যোদ্ধা, পোশাক শিল্পের যোদ্ধা ও বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ অর্থনীতিকে সচল রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
সবার সাথে আলোচনা করে স্থায়ী ভাবে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ঠিক করার পাশাপাশি এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যেখানে ব্যক্তি তার মনের মানুষকে ভোট দিতে পারে। সবাই এক বাক্যে অঙ্গীকার করবে এই নির্বাচন ব্যবস্থা কেউ পরিবর্তন করবে না।
নিয়োগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। যোগ্য ব্যক্তিকে যথাস্থানে নিয়োগের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত না করলে বিচার বিভাগ ,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,প্রশাসন ক্যাডারসহ সকল স্তরে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে। কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জনগণের বন্ধু পুলিশকে জনশত্রুতে পরিণত করে পুরো বাহিনীর মনোবলকে ভেঙে দেওয়া হযয়েছে। গণ আন্দোলনের ছাত্রদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল পুলিশ। এ যেন ভাইয়ের সাথে ভাই এবং সন্তানের সাথে পিতার লড়াই। আরো বিশ্বাস করি ভবিষ্যতে আর কোন নির্বাচিত সরকার পুলিশবাহিনীকে এভাবে ব্যবহার করবে না। পুলিশ হয়ে উঠবে সত্যিকার অর্থেই জনবান্ধব বাহিনী।
এস আলম গ্রুপের গাড়ি না জেনে ব্যবহার করায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ। পরবর্তীতে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিওর মাধ্যমে আরো জানা গেল চট্টগ্রামে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের গোডাউন থেকে এস আলম গ্রুপের বিলাস বহুল গাড়ি সরিয়েছেন দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিএনপি কতিপয় প্রভাবশালী নেতা। বিএনপির কেন্দ্র থেকে এ বিষয়ে ঐ নেতাদের শোকজ করা হয় এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এটি একটি ভালো লক্ষণ। অন্তবর্তী সরকার এস আলম গ্রুপের দুর্নীতিকে বিস্তারিতভাবে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেন এবং বলেন এস আলম গ্রুপের সম্পদ বিক্রি করে লুট করা টাকা সমন্বযয়ের চেষ্টা করা হবে। আপনারা কেউ এস আলম গ্রুপের সম্পদ ক্রয় করবেন না। সরকারের এরকম আহবানের পর যখন রাতের আঁধারে গাড়ি সরিযয়ে নেওয়া হয় তখন বুঝতে হবে এস আলম গ্রুপের লুটের টাকা শুধু শেখ পরিবারই গ্রহণ করেনি এর ভাগ অনেক ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের পকেটেও গেছে। এই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পুরনো ধ্যান ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নতুন প্রজন্মের ধ্যানধারণাকে সবসময় মাথায় রাখতে হবে। “জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস” এটি যেমন মুখে বলবেন অন্তরেও ধারণ করবেন। সাধারণ জনগণও আপনাকে অন্তরে ধারণ করবে।
সংবাদকর্মীদের আমার কাছে মনে হয়েছে সমাজের অন্যতম শক্তিশালী একটি মাধ্যম। কিন্তু এবার কষ্ট পেয়েছি। যখন দেখতে পেলাম শক্তিশালী মাধ্যমের একটি গোষ্ঠী কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করেছে। আমি আশা করি ভবিষ্যতে সংবাদ কর্মীরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব কারো কাছে মাথানত করবে না। আমি মনে করি প্রতিটি পেশাজীবী শ্রেণী কোন রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করবে না। তারা নিজ নিজ শ্রেণীতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করবে। সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
ভবিষ্যতের যে কোন সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হবে সমাজের সকল স্তরে বৈষম্য বিরোধী মনোভাব তৈরি করা। তরুণদের মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে সর্ব্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও বিভাজন সৃষ্টি না করে ঐক্যবদ্ধভাবে হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। তাহলেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের আত্মা শান্তি পাবে।
লেখক:সংগঠক ও হুইলচেয়ার সারভাইবর।

আরো পড়ুন