বরেণ্য চিকিৎসক ডা. হেদায়েত উল্লাহ
।। অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ।।
নগরীর বয়োজ্যেষ্ঠ জনপ্রিয় চিকিৎসক ডাঃ মোঃ হেদায়েত উল্লাহ বিগত ২৬.১১.২৪ইং অপরাহ্ন ২:২০ মিনিটে বার্ধক্যজনিত কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্কুল শিক্ষক মরহুম মৌলভী মকবুল আহমেদ সাহেবের লাকসামের কান্দিরপাড়ের বাড়িতে তার জন্ম এবং বেড়ে উঠা। তারপর সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে এল.এম.এফ, তৎপরবর্তীতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, মহাখালী থেকে ডিটিসিডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি প্রাথমিক অবস্থায় চিওড়া সাবসেন্টার ও পরে কুমিল্লা মর্ডানাইজ সদর হাসপাতাল ও কুমিল্লা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কন্সালটেন্ট হিসেবে চাকরি করেন। চাকরিকালীন অবস্থায় চাকরির সময়ের পর প্রাইভেট প্রাকটিস করতেন।
কুমিল্লা বক্ষব্যাধি হাসপাতাল থেকে সুনির্দিষ্ট কারণব্যাতিত বদলী করার কারণে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে চাকুরি থেকে ইস্তাফা দেন। লাকসাম রোডে ‘সেবাঘর’ নামক একটি ঔষধের দোকানে যতদিন সামর্থ্য ছিল ততদিন প্রাইভেট প্রাকটিস করেছেন আর কুমিল্লার অসংখ্য জনসাধারণকে সুচিকিৎসা বিতরণ করেছেন।
৮৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় ২ পুত্র ও ২ কন্যা রেখে গেছেন। বেশ কিছুদিন রোগ ভোগ করে কয়েকদিন আগে তাঁর স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। স্ত্রীর ইন্তেকালের পরই হেদায়েত ভাইয়ের অসুস্থতা বেড়ে যায় এবং প্রায়ই বলতেন যে, স্ত্রী মরে গেছে, আমি আর বেশি দিন বাঁচতাম না। বড় মেয়ের ঘরে নাতি হওয়ার পর নাতির নাম রেখেছিলেন গাদ্দাফী। রোগী দেখার অবসরে এ নাতিকে নিয়েই তিনি সময় কাটিয়েছেন। নাতি গাদ্দাফী এখন লেখাপড়া শেষে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। হেদায়েত ভাই প্রায়ই বলতেন আমার নামটা মনে হয় এ নাতিটাই সমাজে টিকিয়ে রাখবে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি সিলেটে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পরে কুমিল্লা মর্ডানাইজড সদর হাসপাতালে যোগদান করে বহু মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা সহায়তা করেছেন। ঐ সময় কুমিল্লার মানুষ হেদায়েত উল্লাহ’র চিকিৎসা পেতে উৎসাহ বোধ করতেন। সদর হাসপাতালে কাজ করার সময় বরেণ্য সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরীকে সাথে নিয়ে ব্লাড ব্যাংক গড়ে তুলেছেন। নগরীর অনেক সামর্থবান লোকজন ও চিকিৎসকদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন রোগী কল্যাণ পরিষদ। গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বিকালে হেদায়েত ভাইয়ের চেম্বারে গিয়ে ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের দেয়া ঔষধসমূহ সংগ্রহ করতেন এবং পরে তা হাসপাতাল ও নগরীর বিভিন্ন রোগীদের সরবরাহ করতেন।
হেদায়েত ভাই প্রেসিডেন্ট ও মোস্তফা ভাই সেক্রেটারি হিসাবে অনেকদিন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নাটাব (যক্ষা নিরোধ সমিতি) চালিয়ে গেছেন। তারপর আবার অনেকদিন বন্ধ ছিল। সেক্রেটারি হিসাবে কাউকে না পাওয়ার কারণে যখন ডাঃ গোলাম শাহজাহানকে সেক্রেটারি হিসাবে পাওয়া গেল তখন হেদায়েত ভাই প্রেসিডেন্ট হিসাবে নাটাব আবার চালু হল। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেই নাটাবের সভাপতি ছিলেন। হেদায়েত ভাই একসময় কুমিল্লা ক্লাবের বার্ষিক ভোজে গরুর মাংস রাখার ব্যাপারে অনেকের আপত্তির পরেও এ আইটেমটি রাখার মতামত দিলেন। বললেন, এটা আমার প্রিয় খাবার। সবার প্রিয় খাবারই রাখেন আপনার মনে না চাইলে আপনি খাবেন না, তাই বলে এ আইটেমটি রাখার ব্যাপারে বাধা দেয়া উচিত না। খাবারের ব্যাপারে তিনি কখনোই দুধ বা দধি খেতেন না। বলতেন, এটা গরু বা ছাগলের বাচ্চাদের খাবার, এটা খাব কেন মানুষের বাচ্চার খাবার আরেকজন খেতে পারে কিনা। খাসির মাংস তিনি খেতেন না। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন যে, অঙ্গহানি ও অত্যাচার করে ছাগলকে খাসি বানায়, এটা আমি খেতে রাজি নই।
টানা ১৬ বৎসর ডাঃ মোঃ হেদায়েত উল্লাহ কুমিল্লা বিএমএর সভাপতি ছিলেন। তিনি শুধু সভাপতি ছিলেন না তিনি ছিলেন চিকিৎসক সমাজের গার্ডিয়ান, বড় ভাই, সিনিয়র পেশাজীবী ও চিকিৎসকদের মুরুব্বি। অধ্যাপক ডাঃ মাহববু ও অধ্যাপক ডাঃ আলী আকবরদের বাসায় ডাকাতি হওয়ার কারণে তিনি সবাইকে নিয়ে আন্দোলন সৃষ্টি করে সারা শহরে যে জাগরণ সৃষ্টি করেছেন। তা স্মরণীয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর সাহেব তাঁকে খুজেছিলেন। কাজী জাফর সাহেব তাঁর পূর্ব পরিচিত ও খাতিলের একজন হওয়া স্বত্ত্বেও তিনি দেখা করেন নাই, আন্দোলনে হাল ধরে রেখেছেন। যতদিন আন্দোলন চলছে ততদিন বাসায় পর্যন্ত রাতে ঘুমান নাই এবং নেতৃস্থানীয় অন্য চিকিৎসকদের ঘুমাতে মানা করেছেন। তাঁর উদ্যোগে অনেক চিকিৎসকের চিকিৎসা কার্য্য চলছে পুরো জেলার চিকিৎসকদের সহায়তায়। একবার মুরাদনগরের ডাঃ মানবেন্দ্রনাথ সরকারকে ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় এক মুসলিম কর্মী আঘাত করে আহত করেছিলেন। খবর পাওয়ার সাথে সাথে হেদায়েত ভাই চেম্বার শেষে মুরাদনগর চলে গেলেন এবং মামলা করার জন্য ডা. মানবেন্দ্রকে বললেন, কিন্তু সেই মানবেন্দ্র দা মামলা দিলেন না বললেনÑ ঐ মুসলিম কর্মী না বুঝে এ কাজটি করে ফেলেছে ও একটু পরে এসেই আমার সাহচর্য্য চাবে। একবার প্রফেসর বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও প্রফেসর কামরুজ্জামান সার্কিট হাউজে এসে হেদায়েত ভাইকে ডাকলেন এবং ড্যাব এর প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন। ডাঃ হেদায়েতউল্লাহ উনাদেরকে বললেন ডাক্তারদের মধ্যে বিভক্তি আনবেন না স্যার। কয়দিন পরে আওয়ামী চিকিৎসকরা ড্যাবের মত একটি সংগঠন বানাবে, কমিউনিস্টরা বানাবে, জামাত বানাবে। আমরা ডাক্তাররা বিএমএ ছাড়া কিছুই করব না। উনি ১৬ বৎসর একটানা প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমার সঙ্গে কোনদিনও ভুল বোঝাবুঝি হয় নাই। শুধু একবার দুজনে প্রতিযোগিতা করেছিলাম এবং সে প্রতিযোগিতায় আমি জিতেছিলাম কিন্তু তিনি সবার সম্মুখে স্বীকার করেছিলেন যে ভুলটা তিনিই করেছেন। একবার হেপাটাইটিজ এর উপর কুমিল্লা বিএমএ’র সেমিনার হল। তখন হেপাটলজি ডিপার্টমেন্ট নাই কিন্তু গেষ্ট্রএন্টারলজি ডিপার্টমেন্ট এর সকল শিক্ষক যেমন প্রফেসর এ কে আজাদ খান, প্রফেসর মাহমুদ হাসান, এসোসিয়েট প্রফেসর এম.টি হোসেন ও এসোসিয়েট প্রফেসর প্রজেশ কুমার রায় সবাই কুমিল্লা এসে সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এমটি হোসেন ছিলেন হেদায়েত ভাইয়ের বন্ধু, তাই একেবারে জোর করেই সবাইকে এনে এমটি হোসেনের বন্ধুত্বের খাতিরে সেমিনারটি সম্পন্ন করলেন। বিএমএর সকল নেতৃত্ব স্বীকার করেছেন যে, বাংলাদেশে বিএমএর যতটি শাখা আছে তার মধ্যে কুমিল্লা শাখাই সবচেয়ে ভাল। কুমিল্লা বিএমএ জার্নালটি এখনও একটি দেশের বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল। হেদায়েত ভাই প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় রামঘাটের বিএমএ ভবন ছিল জমজমাট যা এখন পরিত্যক্ত ও ভুতুড়ে বাড়ি।
রোগী দেখার ব্যাপারে তিনি সর্বদাই সতর্ক ও নিয়মানুবর্তী ছিলেন। সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ২টা এবং বিকাল ৫ টা থেকে রাত্র ৮ টা পর্যন্ত শুক্রবার ব্যতীত প্রতিদিন নিয়মিত প্রেকটিস করতেন। একটি আশ্চর্য্য ব্যাপার ছিল তিনি শুধু প্রেসক্রিপশন করেই ক্ষ্যান্ত হতেন না, সদর হাসপাতাল থেকে স্টেরিলাইজেশন কার্য সমাধান করে এ চেম্বারেই প্লুরাল ফ্লুইড ড্রেন করতেন এবং আরও আশ্চর্য্য ব্যাপার হচ্ছে এ কাজে কোন ধরনের একটি কমপ্লিকেশনের ঘটনা ঘটে নাই। এখন এ প্লুরাল ফ্লুাইড হাসপাতাল ছাড়া ড্রেনত কেউই করেন না তবে প্রচুর কমপ্লিকেশনের খবর আছে। কুমিল্লা শহরের অনেক পরিবারই তাঁহার পরিচিত ছিল। তাই চেম্বার শেষে অনেকের বাসায় গিয়েও রোগী দেখে সমাজকর্মটি সম্পন্ন করেছেন। একটি গল্প না বললেই নয়। একবার প্রায় রাত ১২ টার সময় পান্নাদা বললেন তার ভাই চুনি শ^শুর বাড়িতে গিয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন, যা যথেষ্ট ভয়ংকর। সাথে সাথে গাড়ি বের করে পান্নাদাকে গাড়িতে তুলে রওয়ানা হলেন। হেদায়েত ভাই ড্রাইভিং করতে গিয়ে দেখলেন সামনে পুলিশ, রসিকতার ছলে বললেন, “পানু পুলিশ জনগণের দুশমন, মারি দিব নাকি।” পান্নাদা একটু ভয় পেয়ে গেলেন এবং যদি সত্যিই গাড়ি পুলিশের উপর মেরে দেয় তবে কিনা কি দুর্ঘটনা ঘটে যায় তাই বললেন, “গরিব পুলিশ স্যার, এসপি বা ডিএসপি নয়, মেরে লাভ নাই স্যার।” এতে পুলিশের রক্ষা ও চুনির শ্বশুর বাড়িতে হাজির নিশ্চিত হল। হেদায়েত ভাইয়ের চেম্বারটি ছিল অতি সাধারণ, কোন চাকচিক্য ছিল না কিন্তু রাজনীতিতে মাওলানা ভাসানীকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতেন বলে মাথার উপরে ছিল মাওলানার একটি ছবি। আরেকবার এক রোগী হাত পা ঝিম ঝিম করে, রাতে ঘুম কম হয়, শরীর অবসাদগ্রস্থ থাকে এ রকম শারিরীক অবস্থার ডেসক্রিপসন দিয়ে প্রেসক্রিপশন করিয়ে চলে যান। একটু পরে ফিরে এসে বলেন যে, স্যার একটা কথা বলতে ভুলে গেছি -আমি একটু আধটু এলকোহল খাই। অমনি তার প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বললেন “এটা আগে বললেন না কেন, পরিমিত পরিমাণে রেগুলার চালিয়ে যান, কোন কমপ্লেইন থাকবে না।”
কুমিল্লায় সরকারি মেডিকেল কলেজটি করতে গিয়ে সকল শ্রেণীপেশার লোককে নিয়ে তার আন্দোলনের নেতৃত্ব অনস্বীকার্য। সাধারণ জীবনযাপন করেছেন সাধারণ লোকের চিকিৎসা করেছেন। যাকে বিশ^াস করতেন তাকে ১০০% ই বিশ^াস করেছেন। মোসলেহ উদ্দিন এটা বলেছে এটা বললে বলতেন, “যদি মোসলেহ উদ্দিন এটা বলে থাকে তাতে বিশ^াস করুন। এত দৃঢ় বিশ^াসের মধ্যে আমি ছিলাম একজন। জীবনে কোন দিন মিথ্যা কথা বলা এবং ছলÑচাতুরী করতে দেখি নাই। তাঁর সহৃদয়তা, সহানুভূতী, সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তা একজন অসুস্থ লোককে সুস্থ হতে সাহস যুগিয়েছে। আগামী দিনে সহজ পথে চলার কার্য পরিচালনার উদ্যম এনে দিয়েছে। রোগ নিরাময়ে মানুষের প্রতি যে দিয়েছে সর্বোচ্চ মনোযোগ, তার সকল শুভ কর্মের মাঝে কিছু বিচ্যুতি থেকেই যেতে পারে যার জন্য আমরা মনে করি মহান রাব্বুল আলামীন তাকে ক্ষমা করে জান্নাতবাসী করে দেবেন। আমিন॥
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।