দুটি বিজয়ের সমন্বয়
হুমায়ুন কবির।।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটি বিজয়ের বিষয়টি এক অপূর্ব মিলন ঘটে। প্রথমটি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, যখন পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। দ্বিতীয়টি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, যখন তরুণদের অবদান ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশের একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। এই দুই বিজয় বাংলাদেশের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ গঠনে অসাধারণ ভুমিকা রেখেছে। এ লেখায় এই দুই বিজয়ের গুরুত্ব, তাদের প্রেক্ষাপট এবং তাদের মধ্যে যে অনন্য মিল রয়েছে তা বিশ্লেষণ করা হবে।
আমাদের পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক আমোদ’ নিজেই দেখেছে ‘ভারত’ আর ‘পাকিস্তান’, দুটি আলাদা স্বাধীন দেশ। তারপর দেখেছে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ আর ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ অর্থাৎ দুটি দেশ ‘পাকিস্তান’ আর ‘বাংলাদেশ’। একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ‘বাংলাদেশ’। আমাদের পত্রিকাটি সাক্ষী হল আরেকটি নতুন বাংলাদেশের। আমাদের পত্রিকাটি “সাপ্তাহিক আমোদ” সকল বিজয়ের সাক্ষী।
বাংলাদেশের প্রথম বিজয়ের সূচনা হয় পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম থেকে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে পূর্ব বাংলার জনগণ শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের জয়লাভ এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের নিষ্ঠুরতা, সবকিছুই পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তোলে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী বর্বর হামলা চালায়। এই গণহত্যা পুরো জাতিকে একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হয়।
এই বিজয় শুধু একটি ভূখ-ের স্বাধীনতার বিজয় ছিল না, এটি ছিল জাতির আত্মপরিচয়ের জন্ম। স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে একটি নতুন পরিচয় লাভ করে। তবে, মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা শুধু ভূখ-ের স্বাধীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক এবং সমতাপূর্ণ সমাজ গড়ার জন্য সংগ্রাম।
৫ আগস্ট, ২০২৪ সালের ঘটনাগুলি আধুনিক বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বিজয়ের অধ্যায়। এই বিজয়ের শুরু ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ দিয়ের শুরু। এই দিনটি একটি নতুন প্রজন্মের আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার মাধ্যমে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদী শাসন, দুর্নীতি ও বৈষম্যের শিকার হয়ে পড়েছিল। এক শ্রেণির ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তিরা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলে। এ সময় তরুণ প্রজন্ম অত্যন্ত সচেতনভাবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ফ্যাসিবাদের অবসানের জন্য একটি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে।
এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন করা। তরুণরা এই আন্দোলনে সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেয়। তারা নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশকে একটি নতুন পথে পরিচালিত করে। এই দিনটিকে মনে রাখার জন্য বেশির ভাগ একে নাম দিয়েছেন ‘৩৬ শে আগস্ট, ২০২৪’।
৫ই আগস্টের সেই দিন প্রায় হাজার হাজার তরুণ এবং তরুণী সাহসী আত্মত্যাগ করে। তাদের ত্যাগ দেশকে একটি নতুন প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসে। তাদের মৃত্যু আর শরীরের বিকলাঙ্গতা মনে করিয়ে দেয়। আমরা বাংলাদেশী আমরা নতজানু জাতি না। ১৯৫২ তে হই নাই, ১৯৬৫ হই নাই, ১৯৭১ হই নাই, পরাজিত হয় নাই। আর ২০২৪ সালেও দেখলাম রক্তের বিনিময়ে আনা বিজয়। আমাদের সব কটি তাদের এই অবদান ফ্যাসিবাদের অবসান ঘটায় এবং একটি নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করে। ১৯৭১ এবং ২০২৪ সালের বিজয়ের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিল লক্ষ্য করা যায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশি জনগণ তাদের আত্মপরিচয়ের জন্য লড়াই করেছিল। ২০২৪ সালে তরুণ প্রজন্ম তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। দুটি ক্ষেত্রেই এটি ছিল শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিজয় উভয় ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের প্রতিটি স্তর থেকে এসেছিল। ২০২৪ সালে তরুণরাই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছিল।
১৯৭১ সালের বিজয়ের মাধ্যমে জাতি স্বাধীনতা পেয়েছিল, যা একটি নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার সুযোগ দেয়। ২০২৪ সালে তরুণদের আত্মত্যাগ সেই ভবিষ্যৎকে বাস্তবায়নের পথে নিয়ে আসে।
উভয় বিজয়ই দেশকে একটি নতুন যুগে প্রবেশ করিয়েছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশ একটি নতুন গণতান্ত্রিক এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হয়।
দুটি বিজয়ের প্রভাব বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। ১৯৭১ সালের বিজয় জাতীয় ঐক্যের প্রতীক এবং দেশের সংবিধানের ভিত্তি স্থাপন করে। অন্যদিকে, ২০২৪ সালের দ্বিতীয় বিজয় তরুণ প্রজন্মের ক্ষমতায়ন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।
১৯৭১ ও ২০২৪ সালের বিজয় প্রমাণ করে, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার অর্জনের জন্য সংগ্রাম কখনো থেমে থাকে না। ২০২৪ সালের বিজয় তরুণ প্রজন্মের অবদানের একটি উদাহরণ, যা প্রতিটি সমাজে পরিবর্তনের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
এই দুই বিজয়ের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, গণতন্ত্র এবং ন্যায়বিচার কেবল অর্জন করাই যথেষ্ট নয়; এগুলোর সংরক্ষণ এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এবং ৫ আগস্ট, ২০২৪ দুটি বিজয় বাংলাদেশের জনগণের সাহসিকতা, ত্যাগ এবং আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। একটি জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে হলে এই দুটি বিজয়ের শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করতে হবে।
যে আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে একটি জাতির জন্ম হয়েছে এবং যে সাহসিকতার মাধ্যমে একটি জাতি নতুন করে উঠে দাঁড়িয়েছে, সেই দুই বিজয়ের স্মরণে আমাদের নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই দুটি বিজয়ের চেতনা আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।
লেখক: উদ্যোক্তা,টাট্কা এগ্রো ফার্ম.বুড়িচং।