মহাসড়কে বাড়ছে অবৈধ ক্রসিং,বেড়েছে দুর্ঘটনা


তৈয়বুর রহমান সোহেল।।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে বাড়ছে অবৈধ ক্রসিং। এতে বেড়েছে দুর্ঘটনা। নন্দনপুর থেকে সুয়াগাজী পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকায় অন্তত এমন ১২টি ক্রসিং রয়েছে। দাউদকান্দি থেকে চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত রয়েছে এমন অসংখ্য অবৈধ ক্রসিং।
সরেজমিন দেখা যায়,বুধবার দুপুর। মেঘলা আকাশ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাত্রাপথে সদর দক্ষিণের সুয়াগাজী এলাকায় কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়। একটু পর বৃষ্টি। তাই মোটরসাইকেল থামিয়ে বসা হয় একটি টি স্টলে। সেখানে দেখা হয় পার্শ্ববর্তী ধনপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আবদুল জলিল ও আলম মিয়ার সাথে। এর আগে সুয়াগাজী প্রবেশের সামান্য আগে মহাসড়কের বিভাজক কেটে অন্য লেনে সংযোগের দৃশ্য চোখে পড়ে। ভারী যান চলাচলের সুযোগ না থাকলেও ছোট এই অংশ দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা, অটোরিকশা, রিকশা ও মোটরসাইকেল পারাপার হতে দেখা যায়।
এ বিষয়টি নিয়ে কথা উঠতেই দোকানে আড্ডা দেওয়া আবদুল জলিল বলেন, এ বাজারের সামনে ও পেছনে এরকম দুটি জায়গায় বিভাজক কেটে ক্রসিং করা হয়েছে। এই দুই বিভাজকে কমপক্ষে পঞ্চাশটা দুর্ঘটনা ঘটতে দেখেছি। অথচ এর এক কিলোমিটার পূর্বে একটি বৈধ ইউটার্ন আছে। ইউটার্ন ব্যবহার করলে এসব দুর্ঘটনা ঘটত না।
এ সময়ে আলম মিয়া বলে ওঠেন, রোডসের (সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর) লোকজন এসব অবৈধ ক্রসিংয়ের ব্যাপারে আগে কয়েকবার খোঁজখবর নিয়েছেন, তবে ব্যবস্থা নেননি।
শুধুমাত্র সুয়াগাজী নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে এমন অসংখ্য অবৈধ ইউটার্ন রয়েছে। যেগুলোর কিছু দিয়ে মোটরসাইকেল পার হওয়ার মতো সরু জায়গা রয়েছে। আবার কিছু জায়গা দিয়ে ত্রিচক্র যান, ক্ষেত্রে বিশেষ চারচক্রযানও চলাচল করে।
দাউদকান্দির জিংলাতলী এলাকার বাসিন্দা এম এ হানিফ জানান, সম্ভবত ২০২৩ সালের শেষদিকে। আমরা কয়েকজন মিলে মাছের হ্যাচারির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি ঢাকা থেকে নোয়াখালীগামী একটি বাস একটি অটোরিকশাকে চাপা দেয়। অটোরিকশাটি অবৈধ টার্নিং দিয়ে বের হতেই আচমকা বাসের সামনে পড়ে যায়। ওই দুর্ঘটনায় তিনজন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। তাদের বাড়ি উপজেলার বারপাড়া গ্রামে। শুনেছি ওমরা হজ করতে যাওয়ার আগে মহাসড়কের অপরপাশের একই উপজেলার ছান্দ্রা গ্রামের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসছিলেন তারা। এমন ছোটবড় দুর্ঘটনা এখানে হরহামেশাই ঘটে।
মহাসড়কের ওপর বাজার, ফিলিং স্টেশন এবং উভয়পাশে সংযোগ সড়ক রয়েছে এমন স্থানে এসব অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা বেশি। দাউদকান্দির শহীদনগর, আমিরাবাদ, গৌরীপুর, ইলিয়টগঞ্জ, চান্দিনার মাধাইয়া, চান্দিনা বাস স্ট্যান্ড, বুড়িচংয়ের নিমসার, কালাকচুয়া, সৈয়দপুর, সদর দক্ষিণের বেলতলী, নলচর, চৌয়ারা সড়ক, চাষীপাড়া সিএনজি ফিলিং স্টেশন, লালবাগ, সুয়াগাজী, চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজারসহ বেশ কিছু স্থানে অবৈধ ক্রসিংয়ের সন্ধান মিলেছে। কোথাও মহাসড়কের বিভাজক সরাসরি তুলে ফেলা হয়েছে। কোথাও কোথাও বিভাজক তুলে পাকা করা হয়েছে। বিভাজক তুলে ফেলায় কিছু কিছু স্থানে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে প্রতিনিয়ত ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটছে।
বুড়িচংয়ের সৈয়দপুর এলাকার বাসিন্দা দুলাল উদ্দিন জানান, কিছু ক্রসিং নতুন করে বিভাজক কেটে তৈরি করা হয়েছে। কিছু ক্রসিং দিনের পর দিন পড়ে আছে। মহাসড়ক বারবার সংস্কার হলেও বিভাজক তুলে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ক্রসিং বন্ধ করা হয় না।
বিভাজক তুলে অবৈধ ক্রসিং করার সঙ্গে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের যোগসূত্রের তথ্য বেশি পাওয়া গেছে। এছাড়া এ কাজে স্থানীয়রা জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিবেশ ও কৃষিবিদ দাউদকান্দির মতিন সৈকত বলেন, ফুটওভার ব্রিজগুলো মানুষের চলাচলের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত নয়, তাই মহাসড়কের একপাশ থেকে অন্যপাশে যাতায়াতের জন্য অনেক বয়স্ক মানুষ, নারী ও শিশু অটোরিকশা, রিকশা ব্যবহার করেন। আবার অনেকে মহাসড়কের একপাশের গ্রাম থেকে অন্যপাশের গ্রামে যাতায়াতে কয়েককিলোমিটার ঘুরে ইউটার্ন ব্যবহার করতে চান না। তাই তারা শর্টকার্ট পথ খুঁজতে গিয়ে এসব অবৈধ ক্রসিং ব্যবহার করেন। বাজারে যাতায়াতের জন্য, আবার হাইওয়ে পুলিশের চোখ এড়াতেও এসব ক্রসিং ব্যবহার করা হয়। আর এতে অসাবধানতাবশত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
তিনি বলেন, স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও পরিবহনের সঙ্গে জড়িতরা বিভাজক কেটে এমন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। দুর্ঘটনা ছাড়াও এগুলো যানজটেরও কারণ হয়।
বয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেন, ‘মহাসড়কে ধীরগতির যান না উঠলেই নিরাপদ থাকে। আর মহাসড়কে গাড়ির স্বাভাবিক গতি বজায় রাখতে হলে আইন মানা এবং কড়া নজরদারি দরকার।’
তিনি বলেন, ‘সড়ক বিভাগ চাইলে এসব অবৈধ ইউ-টার্ন বন্ধ করতে মাঝখানে কংক্রিটের জার্সি ব্যারিকেড বসাতে পারে, যাতে কেউ সহজে উঠতে না পারে। আবার ধীরগতির যানবাহনের জন্য শাস্তির ব্যবস্থাও দরকার।’
সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ম্যানেজার বদরুল হুদা জেনু বলেন, দেশে যতগুলো মহাসড়ক আছে, সবগুলোর চেয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক গুরুত্বপূর্ণ। এ গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যেখানে বাড়তি তদারকির দরকার, সেখানে অবহেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। হাইওয়ে পুলিশ এসব অবৈধ ক্রসিং নিয়ে যদি সওজের সাথে কথা না বলেন, এটিও দায়িত্বে অবহেলার মধ্যে পড়ে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এমন পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। নইলে এসব অবৈধ ক্রসিং নিয়ে সামনে আরও বড় বড় বিপদে পড়তে হবে।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে হাইওয়ে রিজিয়ন কুমিল্লার পুলিশ সুপার খাইরুল আলমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বোঝেননি বলে উত্তর দেন। পুনরায় প্রশ্ন করলে অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া মেলেনি। এরপর কয়েকদফা কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, বৈধ ইউটার্নের একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ও শৃঙ্খলা আছে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমি নতুন এসেছি। অবৈধ ক্রসিংয়ের বিষয়ে অবগত নই। অবৈধ ক্রসিংয়ের সন্ধান পেলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। বৈধ ইউটার্নের সংখ্যা কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি তার জানা নেই।