ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে সে কী ভাব!

সানোয়ার হোসেন।।
অনুর্বর মস্তিষ্ক থেকে সাংবাদিকতা শুরুর স্মৃতি খুঁজে বের করে তা পাঠযোগ্য করে লেখা কঠিন। যত সহজে নামের আগে ‘সাংবাদিক’ জুড়ে দেওয়া গেছে, তত সহজে স্মৃতিবৃত্তান্ত লেখা সম্ভব হবে না জানলে হয়তো এ লজ্জা থেকে বাঁচার উপায় আগেই খুঁজে নিতাম। শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস শ্রীকান্তের প্রথম খ-ের প্রথম পাতায় যথার্থই লিখেছিলেন, ‘দু-হাত থাকিলেই লেখা যায় না।’ কোনো অজুহাত দেখিয়ে যদি এই স্মৃতি লেখার মতন কঠিন কাজটি থেকে বাঁচা যেত, তবে আজ তা-ই করতাম। অনন্যোপায় কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসে মনে পড়ল উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনার সময় একদিন এক নিকটাত্মীয় পকেট ডায়েরি ও কলম ধরিয়ে দিয়ে সাংবাদিকতার কাজ চাপিয়ে দেওয়ার কথা। তখন নিজেকে আকর্ষণীয় দেখাতে মায়ের শত বকুনিকে উপেক্ষা করে লম্বা চুল রাখি। ভাব নিতে শার্টের উপরের দুই বোতাম খুলে চলি। রোমান্টিক গান শুনে মুখস্ত করে বন্ধুদের সাথে গলা ছেড়ে গেয়ে পাড়ার মানুষের কানের পাখি মারি। রংধনুর চেয়েও রঙিন কল্পনার জগতে বেমালুম ডুবে থাকি। মাঘের তীব্র শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ভালো লাগার মানুষকে এক পলক দেখার জন্য রসিক হয়ে শীতে মরি। এই যখন আমার অবস্থা, তখন সাংবাদিকতা করার মতন কাজে আমার ভীষণ আপত্তি। যা জানি, তাই-ই ঠিকঠাক করতে পারি না। কিন্তু যেটা জানি না, যে কাজ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, সেই কাজে হ্যাঁ বলি কি করে! আমার আপত্তির বিপরীতে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘হয়ে যাবে।’ সেই ‘হয়ে যাবে’ আজ এত বছর পর কতটুকু হয়েছে, এই অপ্রিয় সত্য নিজে আড়াল করার চেষ্টা করলেও ‘আমোদ’ পরিবার হয়তো ঠিকই বুঝে ফেলেছে। সাংবাদিকতা করতে যে সাংবাদিকতার পাঠ আছে, সেই পাঠ না শিখিয়ে যিনি এই পেশায় নামিয়েছিলেন, তাঁকে আজ আমার লজ্জা ও ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি হয়তো উল্টো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবেন চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো শত শত সাংবাদিককে। দেখিয়ে দিবেন অন্য পেশা ছেড়ে উসাইন বোল্টের গতিতে জার্নালিস্ট হয়ে যাওয়াদের। সে যাই হোক, কয়েক মাস অতিবাহিত হয়ে গেল, কিন্তু আমার কোনো আগ্রহ নেই। একদিন সেই নিকটাত্মীয় একটা ক্যামেরা এনে দিলেন। দেখিয়ে দিলেন কীভাবে চালাতে হয়। নতুন কিছু হাতে পেয়ে অন্যরকম অনুভূতি। ফুজি, কোডেক কোম্পানির ফিল্ম রিল কিনে সেই ক্যামেরায় ছবি তুলতে হতো। ২৭-২৮টি ছবি তোলা যেত। ওই ক্যামেরাই সাংবাদিকতার দন্ত্যস না জানা আমাকে পরিচিত মহলে সাংবাদিক স্বীকৃতি পাইয়ে দিয়েছিল। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ছাড়া সময়ে ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে আমার সে কি ভাব! আশপাশের মানুষের অবাক দৃষ্টিতে তখন আমার অবস্থা মুই কি হনুরে। একদিন ডাক পড়ল প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার। চৌদ্দগ্রাম এইচ জে সরকারি পাইলট উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে অনুষ্ঠান। অতিথিদের মধ্যখানে কাজী জাফর আহমেদ বসা। কর্মী-সমর্থকে পূর্ণ লম্বাকার ভবনের (বর্তমানে পরিত্যক্ত) অনুষ্ঠানস্থলে আর কোনো সাংবাদিক নেই। ভয় ও লজ্জায় আমি পেছনের সারিতে বসতে চাইলাম। অতিথিদের সামনের বসতে আয়োজকদের বারবার আহ্বানে ভয়কে জয় করে সামনের সারিতে গেলাম ঠিকই, কিন্তু অতিথিদের সম্মুখে বুক ও হাত-পায়ের কাঁপুনি বেড়ে হয়ে গেল দ্বিগুণ। এত মানুষের মাঝে নিজেকে মনে হলো একা। যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হলো। আমার কী কাজ আমি তাও জানি না। শুরু করলাম ছবি তোলা। অতিথির আশেপাশে থাকা কেউ কেউ দেখিয়ে দিচ্ছেন কোন দিক থেকে ছবি তুলতে হবে। নির্দেশনা মাত্রই জ্বলে উঠছে ফ্লাশ লাইট। একের পর এক ডান-বাম হেলে ঘ্যাঁচাৎ ঘ্যাঁচাৎ করে ছবি তুলছি। দ্রুতই শেষ হয়ে গেল ক্যামেরা রিল। কিন্তু অনুষ্ঠান তখনও শেষ হয়নি। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। ছবি তোলার কায়দা করে কাটিয়ে দিলাম বাকি সময়। সপ্তাহান্তে সেই নিকটাত্মীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদক এলেন। পত্রিকা প্রকাশ করবেন। আমার কাছে নিউজ চাইলেন। আমি বললাম, কাজী জাফরের অনুষ্ঠান। তিনি বললেন, ‘নিউজ কই।’ প্রত্যুত্তরে বললাম, ছবি আছে, কাজী জাফরের অনুষ্ঠানের।
লেখক:সংবাদকর্মী।

inside post
আরো পড়ুন