ভোরের অপেক্ষায় বাংলাদেশ

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
এখন গভীর রাত।
চারপাশ নিস্তব্ধ, নিঃশব্দ নগরী ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট শুনশান, বাতাসও যেন থমকে আছে।
কিন্তু আমার বুকের ভেতর—
একটি দেশ জেগে আছে।
একটি রক্তমাখা নাম-বাংলাদেশ।
এ লেখা কোনো রাজনৈতিক শ্লোগান নয়, নয় সাজানো ভাষণের ছাঁদে আঁকা পোস্টার।
এ এক নিঃশব্দ হৃদয়বাক্য, যেখানে অভিমান, কৃতজ্ঞতা, আশাভঙ্গ আর অফুরন্ত ভালোবাসা মিশে গেছে এক অলিখিত কাব্যে।
বাংলাদেশ, তুমি আমাদের শেষ পরিচয়, আত্মার ঠিকানা।
তোমার আকাশ, তোমার মাটি, ধুলো, বাতাস—সব আমাদের ভেতরের জৈবিক শিকড়। কিন্তু সেই শিকড় আজ ক্ষয়ে গেছে বিষাক্ত নালায়। দুর্নীতি, অনাচার, মিথ্যাচার আর ক্ষমতার লোভ—
তোমার বুক বেয়ে প্রবাহিত হয় যেন এক বিষনদী। আমরা দেখি, চুপ থাকি, কখনো প্রতিবাদ করি, আবার পরদিন ভুলে যাই।
তোমার মনে আছে ২০২৪-এর সেই উত্তাল জুলাই-আগস্ট?
রাজপথে টায়ারের আগুনে জ্বলছিলো শুধু না—জ্বলছিল ছাত্রের চোখ, যুবকের বুক, মায়ের আর্তনাদে। জ্বলছিল জাতির বিবেক। ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!’
‘বুক পেতেছি, গুলি কর!’ এ শুধু স্লোগান নয়—এ এক জাতীয় আত্মার চিৎকার। আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ইয়ামিন, আহানাফ, রাফি, আলভী, নাফিজ, রুদ্র, রিয়া—
তারা কেবল নাম নয়, তারা প্রতিচ্ছবি একেকটি স্বপ্নের।
তাদের চোখে প্রশ্ন ছিল—
‘তুমি কবে মানুষ হবে, প্রিয় বাংলাদেশ?’ তারা চেয়েছিল একটি মানবিক রাষ্ট্র—যেখানে শুধু ধর্ম নয়, মানুষ হবে রাষ্ট্রের মুখ। কিন্তু আমরা?
আমরা ভুলে যাই।
ভুলে যাই প্ল্যাকার্ডে লেখা কান্না, মুখে জমে থাকা রক্ত। ভুলে যাই নিঃশব্দ প্রতিবাদ। আমরা শপিং করি, ট্রেন্ড বদলাই, উৎসবে মেতে উঠি। আর ইতিহাসের গহীনে জমে থাকে—কঠিন এক হাহাকার।
কিন্তু ইতিহাস তো ভুলে না।
যারা প্রাণ দিয়েছিল, তারা রেখে গেছে বিবেকের বীজ—যা আজও কাঁপায় কিছু হৃদয়, কিছু কলম, কিছু গান। তাদের রক্তে আঁকা হবে আগামীর মানচিত্র।
এই লেখা কেবল স্মরণ নয়—
এ এক জাগরণ, এক ভোরের প্রতীক্ষা। যদি কেউ আবার বলে—
‘সুবোধ, কবে হবে ভোর?’
তবে, হে বাংলাদেশ, তুমি বলো—
‘ভোর হয়ে গেছে, আমরা এখনো জেগে আছি।’ এ জাগরণ হোক হৃদয়ের, বিবেকের, মানবতার—
যেখানে পরিচয় একটাই—
‘আমরা মানুষ, আমরাই বাংলাদেশ।’ ভয় পেলে তুমি নিঃশেষ। কিন্তু দাঁড়ালে, তুমি ইতিহাস।
তুমি পারো—
রক্তাক্ত সময়ের পাঁজর ভেদ করে
একটি নতুন প্রভাত নির্মাণ করতে।
আজ, এ অলিখিত কাব্য রেখে গেলাম তোমার চৌকাঠে।
হয়তো একদিন তুমি পড়বে, কাঁপবে, বলবে
‘আমি এখনো বেঁচে আছি, আমি বাংলাদেশ।’
