লেবু আর এক টুকরো পেয়াজে !

খোরশেদ আলম মোল্লা।।
আজকাল ঈদ মানেই ছবি তোলা, ফ্রিজ ভর্তি মাংস আর সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলক। কিন্তু আমাদের শৈশবের ঈদ মানে ছিল ভিন্ন ভালোবাসা, মিলন, আর ত্যাগের নিঃস্বার্থ অনুভব। গরুর গলায় ঘন্টা বাঁধা মানেই ছিল উৎসবের সুর, প্রতিবেশীর সাথে ভাগাভাগি করা আনন্দ, আর সীমিত সাধ্যে অপার ভালোবাসা। তখন ঈদ ছিল হৃদয়ের ঈদ।
প্রস্তুতির আনন্দ
ঈদের কয়েকদিন আগেই শুরু হতো উত্তেজনা। সাতটি পরিবার মিলে একসাথে গরু কেনার পরিকল্পনা করত। বাজারে যাওয়ার আগের রাতে উত্তেজনায় ঘুম হতো না। গরু দেখা, দামাদামি আর শেষে একসাথে সেই ‘ভালো দামে মোটা গরু’ নিয়ে ফেরা,সব মিলিয়ে এক অমলিন আনন্দ।
গরু বাড়িতে আসার পর গলায় ঘন্টা, রঙিন মালা, লাল ওড়না,এসব ছিল শিশুসুলভ ভালোবাসার প্রকাশ। প্রতিবেশীদের মাঝে খুনসুটি চলত। “আমাদের গরুটা বড়!” তবে তার মাঝেও ছিল বন্ধনের মায়া।
আর এক আকর্ষণ ছিল ছুরি-কুড়াল ধার করা। লাল বালুতে ঘষে কে কত ধারালো করতে পারে, তা নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা। এইসব ছিল প্রাক-ঈদের শৈশবীয় উত্তেজনা।
ঈদের সকালের স্মৃতি
ভোরে মায়ের ডাকেই ঈদের সূচনা। ফজরের নামাজের পর কবর জিয়ারত করে মনে হতো, পূর্বপুরুষেরা যেন আছেন আশীর্বাদ হয়ে। গরু গোসল করানোর সময় তার চোখে জল দেখে মনে হতো, সে বুঝি জানে নিজের নিয়তি। তখনও ত্যাগের অর্থ বুঝতাম না, তবে অন্তরে অনুভব করতাম এক অজানা আলো।
নামাজ শেষে হুজুর এলে শুরু হতো কোরবানির প্রস্তুতি। কে আগে গরু কাটবে,এ নিয়ে ছোটাছুটি, উত্তেজনা আর সাহসের প্রশিক্ষণ! রক্তমাখা মাঠে দাঁড়িয়ে মনে হতো, আমরা বড় হয়ে গেছি।
মানবিকতা ও রান্নাঘরের সুরভি
কোরবানির পরে যাদের ঘরে কোরবানি হয়নি, সেখানে মাংস পৌঁছে দেওয়াটা ছিল আমাদের আনন্দ। হাসিমুখে, লজ্জা মিশিয়ে, কিন্তু মনভরা ভালোবাসা নিয়ে যেতাম। ওটাই ছিল ঈদের প্রকৃত শিক্ষা,ভাগ করে নেওয়ার আনন্দ।
মায়ের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা ঝাল মাংসের ঘ্রাণ ছিল ঈদের বাড়তি উপহার। চালের রুটি, কাঁচা পেয়াজ, আর লেবু দিয়ে খাওয়া সেই খাবার ছিল অভাবনীয় রাজকীয়তা।
পরিবারের মিলনমেলা
দুপুরে সবাই মিলে পাটি পেতে খাওয়া ছিল ঈদের অনন্য রীতি। দাদীর মুখে শুনতাম”বিসমিল্লাহ না বললে শয়তান খায়”, “মোড়ামুড়ি দিলে খাবার কুকুরের পেটে যায়” এই কথাগুলো আমাদের শিখিয়েছে খাবারের প্রতি শ্রদ্ধা, আর পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব।
দাদী আমাদের প্লেটে বড় মাংসের টুকরো তুলে দিতেন, আম্মার যতেœ চলত পরিবেশন,সবকিছু মিলিয়ে ছিল এক অভিজ্ঞতা, যা কেবল হৃদয়েই বেঁচে থাকে।
এক ব্যতিক্রম ঈদের গল্প
এক ঈদে গরুর পেটে পাওয়া যায় এক মৃত বাচ্চা। সবাই অবাক, আর আমরা কাঁপছিলাম ভয় আর লজ্জায়। আমি আর শাহজাহান ভাইয়া চুপিচুপি সেটা বাঁশবাগানে মাটিচাপা দিই। সেই ঈদে মাংস খাইনি, বাহানা করে নানাবাড়ি চলে গিয়েছিলাম।
খেলা ও সৃষ্টিশীলতা
ঈদের পরদিন গরুর মূত্রথলি ফুলিয়ে বানানো ফুটবল আর ভুড়ি দিয়ে বানানো ঢোল ছিল আমাদের সৃষ্টিশীল খেলনা। মাঠে ফুটবল খেলা আর ঢোলের শব্দে মুখর হতো গ্রাম। তখন এগুলোই ছিল ঈদের বোনাস ট্রফি।
উপসংহার
আজ ঈদে গরু আগে থেকেই বুকড, কোরবানি হয় মেকানিকালি, আর আনন্দ হয় ক্যামেরার ফ্রেমে। কিন্তু আমার অন্তরে এখনো বেজে ওঠে সেই ঘন্টার শব্দ, সেই মায়া-মাখানো গরুর চোখ।
শৈশবের ঈদ ছিল হৃদয়ের, এখনকার ঈদ টাকার। তবুও বিশ্বাস করি,একটুখানি হৃদয় থাকলেই ঈদ হতে পারে আগের মতো, যেখানে চালের রুটি, গরুর মাংস, লেবু আর এক টুকরো পেয়াজেই ছিল ঈদের প্রকৃত আনন্দ।
লেখক: ব্যাংকার।
