আখাউড়ায় অনিয়মের কারণে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৪২টি ঘরের নির্মাণ কাজ বন্ধ
মো.ফজলে রাব্বি,আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সংবাদদাতা ঃ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী এবং রড কম দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে আশ্রয়ণ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার সকালে জেলা প্রশাসক মোঃ শাহগীর আলম আখাউড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে আসেন। এসময় তিনি নির্মাণ কাজে বিভিন্ন অনিয়ম দেখতে পেয়ে ১৪২ টি ঘরের নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কর্মকর্তাকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে। তিন কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ২ শতক ভূমিতে আধা পাকা ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ১৩৮টি ঘর নির্মাণ শেষে উপকারভোগীদের মাঝে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকী ঘর গুলোর নির্মাণ কাজ চলছিল। বৃহস্পতিবার সকালে নির্মাণ কাজ পরিদর্শণে আসেন জেলা প্রশাসক শাহগীর আলম। দুপুর পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে নির্মাণ কাজ দেখেন। সেসময় কাজের সঠিকতা যাচাই করতে গ্রেড ভিম, পিলার, লিন্টারের কিছু অংশ ভেঙ্গে ভেঙ্গে দেখেন। এসময় তিনি দেখতে পান সঠিক মাপের রড দেওয়া হয়নি। রড কম দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট দূরত্বে রডের রিং না দিয়ে অতিরিক্ত দূরে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ইট, বালি, সিমেন্টেও কিছু ত্রুটি পাওয়া গেছে। এসব কারণে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭টি স্থানের ১৪২ টি ঘরের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসক। এ বিষয়ে প্রাথমিক ভাবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তাপস চক্রবর্তী, ঠিকাদার নূরুজ্জামান ভূইয়া, মোঃ আক্তার মাস্টার এবং মোঃ লিটনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। অন্য কোন সরকারী কর্মকর্তা অনিয়মের সাথে জড়িত কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হবে।
উপজেলা প্রশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানাগেছে, দ্বিতীয় পর্যায়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১৬৯টি ঘরের নির্মাণকাজ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক ঠিকাদার নুরুজ্জামান ভূঁইয়াকে মৌখিকভাবে দেন আখাউড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুমানা আক্তার। উপজেলার রাজাপুর ৩২, চানপুর-১এ ৪৩, চানপুর-২এ ১৩, চানপুর-৩এ ৯, সাতপাড়ায় ২০, খলাপাড়ায় ২৩, ঘাগুটিয়ায় ৮, নিলাখাদে বা কর্মমঠে ১০টি ঘরের নির্মাণকাজ চলছিল। এগুলোর মধ্যে চানপুর-১, রাজাপুর, নিলাখাদ ও খলাপাড়ায় ঘর নির্মাণের কাজ পান উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের আহ্বায়ক ও ঠিকাদার নুরুজ্জামান ভূঁইয়া। একই ভাবে ঘাগুটিয়া, সাতপাড়া ও কর্মমঠ এলাকার ঘর নির্মাণের কাজ পান ঠিকাদার আক্তার হোসেন। কিন্তু চানপুর-২ ও চানপুর-৩ ছাড়া অন্য ছয়টি প্রকল্পের ৮৮টি ঘর নির্মাণে অনিয়ম পেয়ে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসক।
উপজেলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন আখাউড়া ইউএনও রুমানা আক্তার। ঘরের নির্মাণকাজ তদরকির দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইফুল ইসলাম, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) তাপস চক্রবর্তী ও উপজেলা প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম।
বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত উপজেলার রাজাপুর, চানপুর, সাতপাড়া, খলাপাড়া, ঘাগুটিয়া, কর্মমঠ এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মো. শাহ্গীর আলম। এ সময় তাঁর সঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমিনসহ তদন্ত কমিটির তিন সদস্য, আখাউড়ার ইউএনও, এসিল্যান্ড, পিআইও, উপজেলা প্রকৌশলীসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। জেলা প্রশাসক এ সময় সঙ্গে করে শহর থেকে একজন শ্রমিক নিয়ে যান।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে নিয়ম অনুযায়ী, রড, ইট, সিমেন্ট ও বালু দেওয়া হয়েছে কি না, যাচাই করতে প্রতিটি প্রকল্পের একাধিক ঘরের গ্রেড ভিম ও লিংটার ভেঙে দেখেন। এ সময় নির্মাণকাজে অনিয়মের প্রমাণ পায় জেলা প্রশাসক ও তদন্ত কমিটি।
এ সময় তাঁদের সঙ্গে উপস্থিত থেকে দেখা গেছে, গ্রেড ভিমে ১২ মিলিমিটার ব্যাসের চারটি রডের স্থলে কোথাও কোথাও ১০ মিলিমিটারের তিনটি রড এবং লিংটারে ১০ মিলিমিটার ব্যাসের চারটি রডের স্থলে ৮ মিলিমিটারের তিনটি করে রড দেওয়া হয়েছে। অনেক ঘরের লিংটারে কোনো রডই দেওয়া হয়নি। প্রত্যেক ঘরের গ্রেড ভিম ও লিংটারে ছয় ইঞ্চি পরপর রডের রিং থাকার নিয়ম রয়েছে, যা মানা হয়নি।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কয়েক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, উপজেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রতিটি ঘর থেকে ২৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা তাঁদের সম্প্রতি ঈদের কেনাকাটার জন্য পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদার মো. নুরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ইউএনও ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এসব কাজ করছেন। আমি শুধু নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা আক্তার বলেন, ৫ সদস্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি আমি। সদস্য সচিব প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তাপস চক্রবর্তী। তিনিই কাজের মনিটরিং করছেন। অনিয়মের বিষয়ে আমাকে কখনও কোন তথ্য দেননি। তিনি বলেন, দুই ঠিকাদার পরিচিত। বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁদের কাজ দেওয়া হয়েছিল। ঢালাইয়ের সময় আমরা উপস্থিত থাকতে পারিনি। এটা আমাদের গাফিলতি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শাহ্গীর আলম বলেন, রড কম দেওয়াসহ বড় ধরনের অনিয়মের কারণে ১৪২টি ঘরের নির্মাণ করা বন্ধ করা হয়েছে। এ অনিয়মের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইউএনও, এসিল্যান্ড, পিআইও, উপজেলা প্রকৌশলীর কেউই এসব কাজের তদারকি করেননি, পরিদর্শনে যাননি, ঢালাইয়ের সময়ও যাননি। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে যাদের অপরাধ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা সহ ফৌজদারী মামলা করা হবে। কিছু সরকারী কর্মকর্তা এবং রাজনীতিক ঠিকাদার যারা প্রধানমন্ত্রীর আবেগকে শ্রদ্ধা করেনি তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ নিব। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ঘরগুলোর নির্মাণকাজ বন্ধ থাকবে।