আখাউড়ায় বাড়ছে তালাকের সংখ্যা!
মো.ফজলে রাব্বি,আখাউড়া
‘আজ দুজনার দুটি পথ/ওগো, দুটি দিকে গেছে বেঁকে’। পুরনো দিনের এই গানের মতোই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় ঘর-সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে। সন্তানদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে বাবা-মা নিজেদের মতভেদকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছেন। স্থানীয় কাজীরা বলছেন, বাল্যবিবাহ, পরকীয়া, স্বামীর মাদকাসক্তি, দীর্ঘদিন স্বামী প্রবাসে থাকা,স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের অমিল ও যৌতুকের মতো ঘটনাসহ নানা কারণে বিচ্ছেদ বেড়ে গেছে।
করোনাকালে আখাউড়ায় বিয়ে আর বিচ্ছেদ দুটোই বেড়েছে। গত ২০২০-২০২১ এই দুই বছরে আখাউড়া উপজেলায় ১ হাজার ৮২১টি বিয়ে হয়েছে আর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ৩৮৫ টি। এক হিসেবে দেখা গেছে ২০২০ সালে বিয়ে হওয়া প্রতি ৫ জন নারীর ১ জনের বিচ্ছেদ হয়েছে আর ২০২১ সালে বিয়ে হওয়া প্রতি ৪ জনের ১ জন বিচ্ছেদ হয়েছে।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, আখাউড়াতে দিন দিন বেড়েই চলেছে তালাকের ঘটনা। এতে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। ভেঙে যাচ্ছে সংসার ও পারিবারিক বন্ধন। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিশু সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবন। বছরে যে পরিমাণ তালাকের আবেদন করা হয় তার গড়ে ৮০ শতাংশই স্ত্রীদের। স্বামীদের আবেদন খুবই কম।
করোনাকালের দুই বছরে স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদ হয়েছে ১৭৭টি আর স্বামীর পক্ষ থেকে হয়েছে মাত্র ৩২টি। এর বাইরে দু’জনের সমঝোতায় বিচ্ছেদ হয়েছে ১৭৫টি। বিচ্ছেদ চাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ২০ গুণ বেশি।
আখাউড়ায় ১টি পৌরসভা ও ৫টি ইউনিয়নে মোট ৭টি নিকাহ নিবন্ধনের কার্যালয় (কাজী অফিস) রয়েছে। এসব কার্যালয় থেকে জানা যায়, ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনাকালে আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নে বিয়ে হয়েছে ২৩৩টি আর বিচ্ছেদ হয়েছে ৪৮টি। আখাউড়া উত্তর ইউনিয়নে বিয়ে ১৯০টি, বিচ্ছেদ ৪৩টি। মোগড়া ইউনিয়নে বিয়ে ২৯৬টি, বিচ্ছেদ ১১৫টি। মনিয়ন্দ ইউনিয়নে বিয়ে ৩৪০টি, বিচ্ছেদ ৫৬টি। ধরখার ইউনিয়নে বিয়ে ৩২৯টি, বিচ্ছেদ ৫৮টি। আখাউড়া পৌরসভার দুইটি কার্যালয়ে ৪৩৩টি বিয়ে, বিচ্ছেদ ঘটেছে ৬৫টি।
আখাউড়া মনিয়ন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম চৌধুরী দ্বীপক বলেন, বাল্যবিবাহ,পরকীয়া,স্বামীর মাদকাসক্তির করণে এখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম নেয়। এর কারণে তালাকের মতো ঘটনা বেশি ঘটছে।
আখাউড়া উপজেলা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) সমিতির সভাপতি মুফতী কাজী কেফায়েত উল্লাহ মাহমুদী বলেন, পরকীয়া ও মাদকের প্রভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের মাত্রা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বিয়ের পর নেশাগ্রস্থ স্বামীর প্রতি স্ত্রী আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। নেশায় আক্রান্ত মানুষ শারীরিকভাবেও ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে ওঠে। সংগত কারণে একজন নারী ওই পুরুষের কাছে জীবন ও সংসারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন না।
এ ব্যাপারে আখাউড়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রওনক ফারজানা (রুবা) বলেন, আখাউড়ায় প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। অভিভাবকরা অল্প বয়সেই মেয়েদের প্রবাসী ছেলেদের কাছে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে তাদের মধ্যে তেমন বুঝাপরা হয়ে উঠে না। স্বামী বিদেশে থাকা ও সম্পর্কঘটিত নানা জটিলতা নিয়ে প্রথমে দুই পরিবারে ফাটল ধরে পরে তা বিচ্ছেদে রূপ নিচ্ছে। আমরা এবং বিভিন্ন এনজিও উঠান বয়ঠকের মাধ্যমে নারীদের কাউন্সিলিং করছি।
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার অংগ্যজাই মারমা মনে করেন, বিচ্ছেদ কমাতে হলে আগে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে হবে। বিয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে। বাল্যবিবাহ যাতে না হয় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই দিকে খেয়াল রাখছি।