আধুনিক ট্র্যাজেডি: মানবিক দুঃখের মহাকাব্যিক প্রতিচ্ছবি

inside post
মনোয়ার হোসেন রতন।।
মানব সভ্যতার ইতিহাস আসলে এক দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস। সময়ের বুকে শুয়ে থাকা প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি সম্পর্ক, প্রতিটি সমাজব্যবস্থা গভীরতর ট্রাজেডির ভিতর দিয়েই নিজস্ব অর্থ খুঁজে ফিরেছে। আধুনিক জগতের প্রেক্ষাপটে ট্র্যাজেডি আজ আর মঞ্চনির্ভর কোনও নাট্যকাঠামো নয়; বরং এটি হয়ে উঠেছে মানুষের নিঃশব্দ চিৎকার, হারিয়ে যাওয়া আত্মার রুদ্ধ আকুতি। “Representation of human unhappiness”—এ বাক্যটি যেন আধুনিক ট্র্যাজেডির হৃদস্পন্দন।
এক কালে ট্রাজেডি ছিল রাজাদের পতন, নায়কের আত্মত্যাগ, প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যুবরণ। কিন্তু আধুনিক ট্র্যাজেডি আর গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর অলঙ্কারে আবদ্ধ নয়। এটি এখন শূন্য ফ্রিজের দিকে এক মায়ের তাকিয়ে থাকা, প্রেমিকের ব্লক করা ইনবক্স, কিংবা ঘুমহীন বৃদ্ধ পিতার নিঃসঙ্গ দুপুর। এ ট্র্যাজেডি গুলো চিৎকার করে না, কান্নাও করে না—তারা শুধু জীবনের ছায়ায় নীরবে ভেসে বেড়ায়, আত্মার গভীর গুহায় অনুরণন তোলে।
আধুনিকতার আশীর্বাদ মানুষকে প্রযুক্তির আয়নায় বন্দি করেছে, কিন্তু সেই আয়নায় প্রতিফলিত হয় না হৃদয়। জীবনের উপকরণ বেড়েছে, কিন্তু অনুভব হয়েছে ক্ষীণ। কৃত্রিম আলোয় আমরা উজ্জ্বল, অথচ অন্তরের কোণে জ্বলছে বিষণ্নতার অদৃশ্য আগুন। এ নিঃসঙ্গ দহনই আধুনিক ট্র্যাজেডির মুখচ্ছবি।
মানবিকতা আজ পরিণত হয়েছে ব্যাকরণে, সহানুভূতি হয়েছে বিজ্ঞাপনী বার্তা, এবং প্রেম—সে এখন একঘেয়ে এলগরিদমের ছকে সাজানো ডেটা। ফলে, ট্র্যাজেডি আর কোনো মহৎ আত্মত্যাগের নাম নয়; বরং এটি এক বিষণ্ন বেঁচে থাকার নাম। এ ট্র্যাজেডি ফুটে ওঠে সেই তরুণীর চোখে, যে ক্যারিয়ার আর সংসারের টানাপোড়েনে নিজের অস্তিত্ব খুইয়ে বসে আছে। এ ট্র্যাজেডি আবর্তিত হয় সেই মধ্যবিত্ত পিতার চারপাশে, যিনি সারাজীবন ছেলের জন্য সংগ্রাম করে শেষ বয়সে শুনতে পান—”বৃদ্ধাশ্রমে থাকাই আপনার জন্য ভালো হবে”।
এ সময়ের ট্র্যাজেডি এতটাই সূক্ষ্ম, এতটাই নিঃশব্দ যে, কেউ কাঁদে না, তবুও চারপাশে শুধু কান্নার ঘ্রাণ। একটি মেয়ের অন্ধকার ঘরে নিঃশব্দে কেঁদে ওঠা, একজন কবির অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, একজন বৃদ্ধার শুকনো চুলে হাত বুলানোর মানুষ না থাকা—
এসবই আজকের পৃথিবীর ট্র্যাজেডি।
বিশ্বসাহিত্যে, বিশেষ করে দস্তয়েভস্কি, কাফকা, বেকেট বা অ্যালবে কামুর সাহিত্যে এ আধুনিক ট্র্যাজেডির ছায়া গভীরভাবে পরিলক্ষিত। তারা দেখিয়েছেন—মানুষ তার চারপাশে যতই প্রগতি করুক না কেন, আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানেই এক নিরব ট্র্যাজেডির জন্ম। নিটশে বলেছিলেন, “যে জীবনের অর্থ খুঁজে পায় না, তার জন্য প্রতিটি সকাল এক নতুন ট্র্যাজেডি।” আজকের মানুষ সেই জীবনযাপন করছে—যেখানে জীবন আছে, কিন্তু তা হৃদয়ের সাথে যুক্ত নয়।
এ দুঃখের প্রতিফলন কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিকও। একদিকে দারিদ্র্য, অনাচার, শোষণ, অন্যদিকে বৈষম্যের যন্ত্রণা, অন্তহীন প্রতিযোগিতা ও অবচেতন হীনমন্যতা—সব মিলে গঠিত হচ্ছে এক অভূতপূর্ব মানসিক নিপীড়ন-নাটক। মানুষ আজ আর অন্যকে ভালোবেসে স্বস্তি পায় না; বরং নিজের মতো করে বেঁচে থাকাই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় সংগ্রাম।
ট্র্যাজেডি আজ সেই ঘরে থাকে, যেখানে দুইজন মানুষ পাশাপাশি শুয়ে থেকেও পরস্পরের কাছে চির দূরত্বে থাকে। ট্র্যাজেডি আজ সেই চায়ের কাপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, যেটি একদিন হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে, এখন পড়ে থাকে ঠাণ্ডা হয়ে, উপেক্ষার আড়ালে।
তবুও, এ নিঃসঙ্গ ট্র্যাজেডি আমাদের ভেঙে না দিয়ে আমাদের ভাবায়। এটি আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার দিকে ঠেলে দেয়।
আমরা কেন দুঃখ পাই? কেন এত কিছু পাওয়ার পরেও আমাদের মনে শান্তি নেই?
কেন আমাদের সম্পর্কগুলো মুঠোফোনের নোটিফিকেশনের চেয়েও ঠুনকো? এ প্রশ্ন গুলোই আমাদের ভাবায়, জাগায়, কাঁদায়—এবং সেই কান্নার ভিতর দিয়েই জন্ম নেয় সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম রত্ন, শিল্পের সূক্ষ্মতম সৌন্দর্য।
আধুনিক ট্র্যাজেডি আমাদের চোখে জল এনে দেয় না, বরং আমাদের চেতনায় এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষ এখনো অনুভব করতে পারে, ব্যথা পেতে পারে, ভালোবাসতে চায়। এবং এ চাওয়াটাই এখন সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

 

আরো পড়ুন