আমার সাংবাদিক হয়ে ওঠা
এইচ.এম. সিরাজ
স্কুলজীবনে প্রথমবার বাংলা ব্যাকরণে ‘সংবাদপত্র’ রচনা পাঠকালেই বড্ড ভালোবাসায় জড়িয়ে যাই ‘সাংবাদিক’ পেশাটির প্রতি। এরও কিছুদিন পর সংবাপত্র পড়ার সুযোগ ঘটাকালে রীতিমতো যেনো এর প্রেমেই মজি। তখন অবশ্য ছিলোনা সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের এতোটা আধিক্য। জ্ঞানের বিস্তার লাভে নিয়ামক ভূমিকা পালন ও জীবন চলার পথ নির্দেশনা প্রদানকারী এই মাধ্যমটিতে নিয়োজিতরাই সাংবাদিক। মানুষের কথা জাতির অক্ষিগোচরে উপস্থাপন করা নি:সন্দেহে চাট্টিখানি বিষয় নয়। তাছাড়া ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মাতৃভাষার লড়াই, একাত্তরে দেশ মাতৃকার মুক্তির সংগ্রামসহ দেশ-জাতির সকল ক্রান্তিকালীনেই সাংবাদিক সমাজের ভূমিকা জাজ্বল্যমান। এসবের প্রেক্ষিত আর মনের নিগুঢ় ভালোবাসা থেকেই একদা এই পেশাটির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি আষ্টেপৃষ্ঠে।
কবিতার সনে আমার প্রেম স্কুলে পড়াকালীনই। কলেজ জীবনে সে ভূতটা ঘাড়ে চাপে আরো পোক্তভাবে। সংবাদপত্রের পাতায় নিজের কবিতা ছাপাবার নেশায় স্থানীয় পত্রিকা অফিসে ঢু মারা থেকেই সংশ্লিষ্টজনদের সাথে সখ্যতা গড়ায় একটা ক্লু পেলুম, সাংবাদিকতায় জড়াতে পারলে কবিতা প্রকাশে অনেকখানি কৃপা মিলবে। পেয়ে বসলো আরেক নেশা। বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে সাহস করে পরামর্শ লাভে অধ্যক্ষ মিন্নত আলী স্যার, কবি প্রফেসর খুরশেদুল ইসলাম স্যার এবং কবি জমিলা বেগম খালার স্মরণাপন্ন হতে ওনারাও সায় দিলেন। মিন্নত আলী স্যার বলেছিলেন, “মনে রেখো, সাংবাদিকতা হচ্ছে আজন্ম ছাত্রত্বের একটি পেশা। এখানে তোমায় প্রতিনিয়তই শিখতে হবে। যদি তুমি শেখার মানসিকতাকে মনোমাঝে লালন করতে পারো, তবে এই পেশায় সফলকাম হতে পারবে; নচেৎ নয়।” স্যারের কথাটার প্রতি অগাধ সম্মান দেখিয়ে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে ‘দৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামের সংবাদপত্রে সবচে’ নিম্ন পদ ‘সংশোধক’ (প্রুফ রিডার) হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়েই আমার সাংবাদিকতা জীনের যাত্রারম্ভ। অত:পর স্যার আমাকে জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব’র ‘আইউইটনেস’ নামীয় কলামটা প্রতিদিন পড়তে বললেন। মিন্নত আলী স্যার প্রদত্ত সাংবাদিকতায় এটি আমার দ্বিতীয় পাঠ বলে আজও মনে করি। এর সুফলও খুব অল্প সময়েই পাই দৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘এই শহরে’ নামীয় একটি কলাম লেখার প্রেক্ষিতে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভের মাধ্যমে।
পত্রিকার পাতায় আমার বাই নেইমে সংবাদ ছাপা হয়। কিন্তু তাতেও সাংবাদিক পরিচয় দেবার মতো অধিকার যেনো আমার ছিলো না! এই খেদ বুকে চাপা দিয়ে চলার একটা পর্যায়ে অনেকটা বকতালীয়ভাবে দৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া পত্রিকার অফিসেই পরিচয় ঘটে কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত-ইউনেস্কো পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশের প্রাচীনতম সংবাদপত্র সাপ্তাহিক আমোদ’র সম্পাদক (তখন ছিলেন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক) বাকীন রাব্বীর সাথে। বিদাই বেলায় দিয়ে গেলেন তার ভিজিটিং কার্ড। কয়েকদিন পর বড্ড আশায় বুক বেঁধে ওনাকে ফোন করলাম। সালাম বিনিময়ান্তে আমাকে গ্রহণ করার ধরণেই যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। এক পর্যায়ে মনের খেদ এবং প্রত্যাশার কথা বলাতেই ওনি আমার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত পাঠানোসহ সংবাদ পাঠাবার অনুমতি দিলেন। কিছুদিন না যেতেই তিনি রেজিস্ট্রি ডাকযোগে একখানা পত্র পাঠালেন। খামটা খুলে আমার চোখকেই বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। কারণ এতে ছিলো আমোদ’র ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংবাদদাতা’র পরিচয়পত্র যা আমারই নামে ইস্যুকৃত! যেটি আমার সাংবাদিকতার প্রথম পরিচয়পত্র বা আইডি কার্ড। সেই থেকে আজ অবধি আমি আমোদ পরিবারের একজন হয়েই আছি। কিছুদিন পর সাংবাদিকতায় বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগও সর্বপ্রথম পাই বাকীন ভাইয়ের বদান্যতাতেই। আর এভাবেই আমার সাংবাদিক হয়ে ওঠা।
সাংবাদিতায় আমার পরমতম অভিভাবক অধ্যক্ষ মিন্নত আলী স্যার। পাশাপাশি কবি প্রফেসর খুরশেদুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রফেসর আশরাফুল ইসলাম, প্রফেসর মু. মজিবুর রহমান, প্রফেসর মো. আবুল হাসান, অধ্যাপক আবদুন নূর, অধ্যাপক নজির উদ্দিন আহমেদ, কবি জমিলা বেগম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার মোহতামিম (প্রিন্সিপাল) মুফতি মোহাম্মদ নূরুল্লাহ্, অধ্যাপক এ.কে.এম হারুনুর রশিদ, কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত দেশের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘আমোদ’র সম্পাদক বাকীন রাব্বী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গবেষক মুহম্মদ মুসা, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি সৈয়দ আখতার ইউসুফ সানু প্রমুখের নির্দেশিকা আমার আজন্মকালের পাথেয় হয়েই থাকবে। তিনাদের মধ্যে যারা নশ্বর দুনিয়ার মায়া ত্যাগে পরপারের বাসিন্দা হয়ে গেছেন, কায়মনোবাক্যে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি জীবিতদের প্রতি জানাই অতল শ্রদ্ধা আর প্রগাঢ় শুভ কামনা।
সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর বাঙালিকে আবারো কোণঠাসার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় জিন্নাহ-লিয়াকত আলী। বাঙালির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নাজিমুদ্দিন-নূরুল আমিন অতিশয় গোপনে হাত মেলায় অবাঙালিদের সাথে। প্রথমেই আঘাত হানে বাংলা ভাষায়। তখন ঢাকার পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও কম যায়না ভাষার সৈনিকেরা। কোর্ট বিল্ডিংয়ের উপর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পতাকা নামানো হয় কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই। এটি করেছিলেন ভাষা সংগ্রামী সামিউল আহমেদ খান ফটিক, যিনি পরবর্তীতে হয়েছিলেন ‘ফারাক্কা বাঁধ’র রহস্য উন্মোচনকারী খ্যাতিমান সাংবাদিক। জীবনের পড়ন্ত বেলায় ওনার সাক্ষাতকার গ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। দৈনিক প্রজাবন্ধুতে ওই সাক্ষাতকার প্রকাশের পর মসজিদ রোডের অফিসে এসে উচ্ছ্বাস প্রকাশে উদ্বেলিত হয়ে দোয়া করেছিলেন মাথায় হাত বুলিয়ে। এটি আমার এক পরম পাওয়াও বটে।
আমার সাংবাদিকতার বয়স খুব একটা কম নয়, দুই যুগের চৌকাঠে। সময়ের হিসেবে পাড়ি দিয়েছি অনেকটাই লম্বা পথ। সুদীর্ঘ সময়ে যেমন বদলেছে অনেককিছু, তেমনি বদলেছে সাংবাদিকতাও। আজকাল সাংবাদিকতা একেবারেই করতলে। রাত পোহালেই বাড়ছে সাংবাদিকের সংখ্যা। তবে এটিও ঠিক, বিশাল সংখ্যাধিক্যের সিংহভাগই কেবল স্মার্ট ফোন সর্বস্ব। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার মওকায় অনেকে ঘরে বসে দিব্যি করছেন সাংবাদিকতা। ‘এধারকা মাল ওধারকা ফেলা ‘ প্রবাদটির ন্যায়ই যেনো ওল্কার গতিতে চলছে সাংবাদিকতা। অনেক রসিকজন এসবকে ‘কপি পেস্ট’ সাংবাদিকতাও বলে থাকেন। আর ‘তৈলং’ সাংবাদিকতা? সেটিতো এক্কেবারে সবকিছুরই ওপরে। ওসি, ইউএনও, ডিসি-এসপির সন্তুষ্টি অর্জন করাতেই ব্যস্ত থাকেন কিছু সাংবাদিক। ঝুলিতে ভরপুর থাকা নানান বিশেষণের ব্যববহারেও তিনারা বেশ পারঙ্গম। চৌকষ অফিসার, মানবিক কর্মকর্তা, নামের আগে-পিছে জনবান্ধব, মানবতার ফেরিঅলা, সাংস্কৃতিকজন ইত্যাকার চর্বিত শব্দাবলী প্রয়োগে তিনারা অসাধারণ সিদ্ধহস্ত। এমনি হরকিছিম বাগাড়ম্বতায় মফস্বল সাংবাদিকতা আজকাল অনেকখানিই প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ সীমাহীন প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হয় মফস্বলের সাংবাদিকদের। সময়ের প্রেক্ষাপটে ‘ডাণ্ডি কার্ড’র ছড়াছড়িতে অতিশয় কঠিন-ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশাটিও হচ্ছে কলুষিত। অযোগ্য লোকের হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে ‘সাংবাদিক পরিচয়পত্র’। এসবের বেশিরভাগ দায়ই নাম সর্বস্ব আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার। বিশেষ কিছুর বিনিময়ে কার্ড ধরিয়ে দিয়ে অনেকটা ‘কইরা খাও’ স্টাইলে আনাচে কানাচে সাংবাদিক পয়দা করেই যাচ্ছেন! এমনও অনেকে আছেন শুদ্ধ করে কথা-ই বলতে পারেন না, অথচ বেশ সহিহ-শুদ্ধ আর অবলীলাতেই ‘অকাজটি’ করে যাচ্ছেন। সত্যিকার সাংবাদিকরা এতে লজ্জা পেলেও তাদের নেই লজ্জাবোধ। তবে আশার কথা, এদের বিরুদ্ধে মূলধারার সাংবাদিকরা বরাবরই সোচ্চার।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।