ইহুদি জাতির উত্থান-পতনের গল্প

inside post
মনোয়ার হোসেন রতন।।
ইতিহাস এমন কিছু জাতিকে চিহ্নিত করে রেখেছে, যাদের জীবনপথ এক রহস্যময় দ্বৈততার প্রতিচ্ছবি—তারা একদিকে নির্যাতিত, অন্যদিকে নির্যাতনকারী; একদিকে নিপীড়িত, অন্যদিকে চক্রান্তকারী। ইহুদি জাতি এমনই এক নিদর্শন, যাদের ইতিহাসে আছে আকাশচুম্বী গৌরব, আবার অন্ধকার চূড়ায় পতনও।
ইহুদি জাতির সূচনা ঘটে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর মাধ্যমে, যিনি আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস রেখে অন্ধকার যুগে জ্বালিয়েছিলেন আস্থার আলো। তাঁর বংশধর ইসহাক (আ.), ইয়াকুব (আ.)—যাঁর অপর নাম ছিল ইসরাঈল—এবং পরবর্তীতে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর হাত ধরে এই জাতির উত্থান মিশরে। কিন্তু তারা দাসে পরিণত হয় মিশরের ফেরাউন শাসনে। দীর্ঘ দাসত্বের পর মুসা (আ.)-এর নেতৃত্বে তারা লাভ করে মুক্তি এবং সিনাই পর্বতে পায় তাওরাত—আল্লাহর বিধান, যা ধর্মীয় জাতি হিসেবে তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার ভিত্তি।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই জাতির ইতিহাস যেন এক আত্মঘাতী চক্র। মুসা (আ.)-এর সাময়িক অনুপস্থিতিতেই তারা স্বর্ণগরুর পূজায় লিপ্ত হয়, যা ছিল তাদের ঈমানের প্রথম বড় বিপর্যয়। কোরআন তাদের বর্ণনা করেছে এক অবাধ্য, অহংকারী ও লোভী জাতি হিসেবে, যারা বারবার নবীদের অমান্য করেছে এবং আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
তবুও তাদের গৌরবের এক সময় এসেছিল—দাউদ (আ.) ও সুলায়মান (আ.) এর যুগে, যখন জেরুজালেমকে ঘিরে গড়ে ওঠে একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ ধর্মীয় রাজ্য। কিন্তু এ ঐশ্বর্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়ে—উত্তরে ইসরায়েল ও দক্ষিণে জুদা। এরপর থেকেই একের পর এক সাম্রাজ্যের আক্রমণে তারা পড়তে থাকে চরম বিপর্যয়ে—বাবেলীয়, আসিরীয়, গ্রিক, রোমান—সবাই কোনো না কোনো সময় এই জাতিকে দমন করেছে।
৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ধ্বংস করে দেয় জেরুজালেমের দ্বিতীয় টেম্পল। এখান থেকেই শুরু হয় “ডায়াসপোরা”—বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ইহুদিদের নির্বাসিত জীবন। শত শত বছর রাষ্ট্রহীন থেকেও তারা বিশ্বজুড়ে গড়ে তোলে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এক অদৃশ্য সাম্রাজ্য। তারা শিক্ষিত, সংগঠিত এবং প্রভাবশালী হয়ে ওঠে ব্যাংকিং, মিডিয়া, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রাজনীতিতে। কিন্তু এই অতিরিক্ত আধিপত্য তৈরি করে নতুন সংকট—বিশ্বব্যাপী ঘৃণা, সন্দেহ ও বিদ্বেষ।
এই বিদ্বেষ চরম রূপ নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। জার্মানির নাৎসি নেতা হিটলার তাদের চিহ্নিত করে ‘জাতিগত হুমকি’ হিসেবে, আর তার পরিণতিতে ঘটে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা—হলোকাস্ট। প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যাকাণ্ডে বিশ্বজুড়ে তৈরি হয় গভীর মানবিক সহানুভূতি। এই সহানুভূতির রাজনীতি থেকেই ১৯৪৮ সালে পশ্চিমাদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল রাষ্ট্র—ফিলিস্তিনের বুক চিরে, আরব জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে।
এই ‘রাষ্ট্র’ গঠনের পর থেকে শুরু হয় এক অব্যাহত দখলযুদ্ধ। ফিলিস্তিনিদের জমি, ঘরবাড়ি, ইতিহাস ও অস্তিত্ব মুছে ফেলার এক নিষ্ঠুর প্রচেষ্টা। একদিন যারা ছিল নিপীড়িত, আজ তারা পরিণত হয়েছে নিষ্ঠুর দখলদার ও হত্যাকারীতে। একটি জাতি কিভাবে ইতিহাস ভুলে যায়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ আজকের ইহুদি শাসন।
তবে ইতিহাসে যেমন উত্থান চিরস্থায়ী নয়, তেমনি ক্ষমতার দম্ভও চিরকাল থাকে না। পবিত্র কোরআনের বলা হয়েছে—
“তোমাদের ওপর বহুবার আমার অনুগ্রহ ছিল, কিন্তু তোমরা তা অস্বীকার করেছ। অতএব শাস্তিও তোমাদের জন্য অনিবার্য।”
(সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৩৭)
ইহুদি জাতির ইতিহাস এক বিস্ময়কর পাঠ—তারা দেখিয়েছে কিভাবে ধর্মীয় ঐক্য, শিক্ষা ও সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে একটি জাতি টিকে থাকতে পারে সহস্রাব্দকাল। কিন্তু সেই একই জাতি, যদি নিজেই নিপীড়কে পরিণত হয়, তাহলে তাদের পতনও হয় অনিবার্য—ঐশ্বর্যের চূড়ায় নয়, বরং ন্যায়ের বিচারে।
আজ তারা ক্ষমতার চূড়ায়। কিন্তু সময়ের হাত যখন নেমে আসবে, তখন তারা বুঝবে—অন্যের লাশের উপর দাঁড়ানো কোনো উত্থান টেকে না। তাদের ইতিহাস আমাদের শেখায়—ক্ষমতার অপব্যবহারই একটি  জাতির পতনের শ্রেষ্ঠ কারণ।
আরো পড়ুন