একদিন ইতিহাস অবাক হয়ে লিখবে

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
একদিন ইতিহাস থমকে দাঁড়াবে
বিস্ময়ের অক্ষরে খুঁজবে এক অদ্ভুত জাতির পরিচয়, যারা রাতের অন্ধকারে বসে জাগরণের গান গাইত, আলোর নামে স্লোগান তুলতো, দিগন্ত জুড়ে মশাল জ্বালাতো, আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতো—
“আলোই আমাদের মুক্তি,
আলোই আমাদের চেতনা!”
কিন্তু সেই আলো যখন সত্যি সামনে এসে দাঁড়াতো, তখন তারা ধীরে ধীরে বন্ধ করতো জানালার কপাট। তারা মুখ ফিরিয়ে নিত আলো থেকে, নিজেকে গুটিয়ে নিত নিঃশব্দ ছায়ার আড়ালে।
কিন্তু কেন?
কারণ, আলোতে মুখ স্পষ্ট হয়! আলো মানে আরশির সামনে দাঁড়ানো, আত্মপ্রকাশের নির্মম সত্য, নিজের ভেতরের অন্ধকারের সঙ্গে আলোর সংঘাত।
আর তারা অভ্যস্ত ছিল—
মুখোশ পরে নিজের প্রতিচ্ছবিকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে। তারা চেয়েছিল জাগরণ,
কিন্তু জাগ্রত হতে নয়—তারা চেয়েছিল আলোকে ব্যবহার করতে, নিজেকে মহান প্রমাণ করতে একটি তামাশাচ্ছন্ন সমাজে!
তবুও তারা বলত—
“আলো আমাদের চেতনার ভিতরে আছে।”
হয়তো ছিলও একদিন, কিন্তু সেই চেতনার দীপ্তি ঢেকে গিয়েছিল রাষ্ট্রীয় কুয়াশায়,
ক্ষমতায় যাবার ধোঁয়াশায়, আর সুবিধাবাদের ঘন ধোঁয়ায়।
এই জাতি স্বপ্ন দেখেছিল—
স্বাধীনতার, ন্যায়ের, গণতন্ত্রের,
তারা রাজপথে মিছিল করেছিল,
নাম দিয়েছিল বিপ্লব, কিন্তু ভেতরে ভেতরে লালন করেছিল
স্বার্থের সাপ—যে ছোবল মেরেছে নিজের ভবিষ্যৎকেই।
তাদের চোখে ছিল না দৃষ্টি,
হৃদয়ে ছিল না দায়িত্বের দীপ্তি,
কেবল মুখে মুখে গর্জন—
“ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই!”
কিন্তু হাতে ছিল কেবল ক্ষমতা দখলের মুঠো ও সুবিধার হিসেব।
তাদের শিক্ষার আলো ছিল প্রশ্নবিদ্ধ,
সাংস্কৃতিক চেতনা ছিল আবরণহীন,
আত্মিকতা ছিল বিজ্ঞাপনের মতো—
চকচকে কিন্তু ফাঁপা। তারা চেয়েছিল মুক্তি,
কিন্তু সেই মুক্তির পথে চলতে চায়নি,
কারণ সেই পথ কণ্টকাকীর্ণ, আত্মত্যাগময়।
তারা বলেছিল,
“আমরা নতুন প্রজন্মকে আশা দেবো”—
কিন্তু নতুন প্রজন্মকে তারা দিয়েছে ভাঙা শিক্ষা, ভয়, বিভ্রান্তি, ও আদর্শহীনতার উত্তরাধিকার। তারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে বানিয়েছে একটি আয়নার খেলা—
যেখানে মুখ নয়, মুখোশই প্রতিফলিত হয়!
এরা ছিল সেই জাতি—
যারা শতশত শহীদের রক্তে গড়া স্বাধীনতা
দখল করেছে মুষ্টিমেয় শ্রেণির লালসায়।
যারা মুখে বলেছে গণতন্ত্র, কিন্তু পদতলে পিষে দিয়েছে মানুষের ভোট। যারা বলেছে মানবতা, কিন্তু কণ্ঠরোধ করেছে প্রতিবাদের।
একদিন, ইতিহাসে প্রশ্ন উঠবে—
তারা আলোকে ডেকেছিল কেন?
যদি তাদের মুখই লুকিয়ে রাখতে চায়!
যদি তারা ভয় পায় সত্যের সামনে দাঁড়াতে?
তবে কেন সেই মিছিল, কেন সেই স্লোগান?
কেন সেই নাট্যমঞ্চ, মশাল, কবিতা আর জাগরনের গান ?
একদিন ইতিহাসের পাতায় লেখা হবে—
“এটা ছিল সেই জাতি,
যারা নিজেদের মহত্ত্ব দেখাতে গিয়ে
নিজেরাই নিজের পথ হারিয়েছিল।
যারা বুকে জাতীয় সংগীত রাখলেও
হৃদয়ে রাখেনি দেশমাতৃকার ব্যথা।”
তাদের স্মরণে রয়ে যাবে এই একটিমাত্র প্রশ্ন
“আলোকে ডেকেছিলে কেন, যদি মুখই লুকিয়ে রাখতে চাও?”কিন্তু সবটাই কি হারিয়ে যাবে? না!
এই ধোঁয়াশার বুক চিরে জন্ম নেবে নতুন কিছু হৃদয়, যারা মুখোশ ছিঁড়ে ফেলবে,
আত্মসমালোচনায় উদ্বুদ্ধ হবে, আলোকে ডাকবে, তবে আর পালাবে না—
আলোকে বুকে জড়াবে,দায়িত্ব নেবে,
দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, সত্যকে বলবে—
“তুমি এসো, আমরা প্রস্তুত!”
তখন ইতিহাস নতুন কলমে লিখবে—
“এই জাতি ঘুমিয়েছিল, কিন্তু হারায়নি সব।
তারা জেগেছে, আবার ফিরেছে,
আবার শপথ নিয়েছে—
আলোকে শুধু ডাকবে না,
আলোকে ধারণ করবে হৃদয়।
inside post
আরো পড়ুন