কুমিল্লার পুরাতন গোমতী উন্নয়নে চাই টেকসই প্রযুক্তি

 

inside post

অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ

অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ

কুমিল্লা শহর রক্ষার জন্য গোমতী নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হলে শহরের উত্তরপ্রান্তে কাপ্তানবাজার থেকে শুভপুর হয়ে টিক্কারচর পর্যন্ত দীর্ঘ মৃত নদীটি পুরনো গোমতী নামে পরিচিতি লাভ করে। এই প্রাকৃতিক জলাধার প্রতিদিন প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে। নদীতে আবর্জনা ফেলে দখল করা হচ্ছে। দখল হওয়া নদীর এ বিশাল এলাকা জুড়ে নির্মিত হয়েছে দোকানপাট ও বহুতল ভবন। সবাই প্রতিযোগিতায় নেমেছে বাড়িটা নদীর দিকে বাড়িয়ে করার। নদীর বিভিন্ন অংশে সুয়ারেজ লাইন এবং আবর্জনা ফেলায় তা মরা খালে রূপান্তরিত হচ্ছে। ২০১৭ সালে সিটি নির্বাচনে নির্বাচিত মেয়র পুরাতন গোমতীকে হাতির ঝিলে রূপ দেয়ার ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন। নগরবাসী এ ঘোষণার দ্রুত বাস্তবায়ন চায়।

নদ-নদী, খাল-বিল উদ্ধারে সরকারের ঘোষণা এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা কোন কিছুই আমলে নিচ্ছে না অবৈধ দখলদাররা। দখলদারিত্বের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ভূমি অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলেও লোকমুখে শুনা যায়। কুমিল্লা নগরীকে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য দিতে পারে যে পুরাতন গোমতী তাকে রক্ষা করার কোন কার্যকরী উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এটি এখন দুইতীরের নগরবাসীর আবর্জনা ফেলার ভাগাড় মাত্র। প্রতিনিয়ত দূষিত করছে পলিথিন মেশানো নগরীর বিভিন্ন আবর্জনা, পরিত্যক্ত বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য ও নদীর পাড়ে নির্মিত আধাকাঁচা পায়খানা। এতে নদীর পানি গুণগত মানে অবনতি, মাছ ও জলজ প্রাণীর ক্ষতি, বাণিজ্য, কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের অনুপযোগী এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। চাঁদপুর, শুভপুর অঞ্চলে ভরাট অংশে গড়া হয়েছে সারি সারি স্থাপনা এবং দুপাশ যেন প্রতিযোগিতা দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। গড়ে তুলছে স্থায়ী, অস্থায়ী ঝুপরি ঘর। দেখার কিংবা রক্ষার যেন কেউ নেই। নদীর দুদিকের বসতীরা একটু একটু করে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে নদীর জায়গা দখল করে নিচ্ছে।

উত্তর প্রান্তে শুভপুর এবং দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে চকবাজার হয়ে টিক্কারচর শ্মশানঘাট পর্যন্ত গোমতী নদীর পূর্বপ্রান্তে টিক্কারচর সুইপার কলোনির পর থেকে শ্মশানের নিকট পর্যন্ত নদীর পাড় দখলের সঙ্গে নদীর অংশও দখলে নিয়ে অবৈধভাবে শতাধিক ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আমরা মনে করি নদীটি দখলমুক্ত করে দুপারে বৃক্ষরাজি দিয়ে সবুজায়নের মাধ্যমে ওয়াকওয়ে করা যেতে পারে। উপরে হাতিরঝিলের আদলে সৌন্দর্য বাড়ানো যেতে পারে। সামগ্রিক পরিবেশ উন্নয়নে জলাধারটি পরিচ্ছন্ন করা অতীব জরুরী এবং দখল ঠেকাতে প্রশাসনকে এখনই ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। আর তাতেই পুরাতন গোমতী হয়ে উঠবে নগরীর ফুসফুস।

১৪.০৩.২০২১ এ বাপা আয়োজিত নদী রক্ষায় মতবিনিময় সভায় কুমিল্লার সুধীজন বলেন প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি, জনপ্রতিনিধিত্বশীল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিস্পৃহতায় পুরাতন গোমতী দূষিত জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। হাইকোর্টের দুটি নির্দেশনার আলোকে অবিলম্বে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যায়। পুরাতন গোমতীর সীমানা চিহ্নিতকরন, খুটি স্থাপন এবং হাঁটার পথ তৈরি করা যায়। দুপারে হাঁটার রাস্তা তৈরি করে দেয়া অত্যন্ত জরুরী এবং পরিবেশ রক্ষায় জলাশয়টি পরিচ্ছন্ন করে জনস্বাস্থ্য রক্ষা নিতান্ত প্রয়োজনীয়। পরিবেশবাদীরা হাতিরঝিলের অনুরূপ প্রকল্পও পুরাতন গোমতীতে নেয়া যায় বলে বিশ্বাস করে। পুরাতন গোমতীর ঝোপ-ঝাড়, কচুরীপানা ও আবর্জনা পরিস্কার করে দেশের বৃহত্তম শাপলা ফুলের বাগান করে টিক্কারচর থেকে কাপ্তানবাজার পর্যন্ত নৌবিহারের ব্যবস্থা করতেও অভিমত প্রকাশ করেছেন কুমিল্লার নাগরিক সমাজ। নদ-নদীসহ প্রাকৃতিক সব জলাধার সুরক্ষায় জনসচেতনতা গড়ার দিকে নজর দিতেও সবাই মত প্রকাশ করেন।

বিগত ২৭.০২.২০২১ইং প্রাক্তন যুবলীগ সভাপতি শাহীনুল ইসলাম শাহীনকে সঙ্গে নিয়ে মাননীয় স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রীর দপ্তরে চলে গেলাম। কুমিল্লা পরিবেশ উন্নয়নে গণদাবিসমূহ তাঁর নিকট উপস্থাপন করলাম। বাপা কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি তাসকিন সাহেবও সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং সেথায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। গণদাবির লিখিত পত্রটির উপর তাৎক্ষনিক অ্যাকশন নেয়ার নির্দেশ দিয়ে মন্ত্রী মহোদয় নোট দিলেন। শুনেছি পুরাতন গামতীকে পরিবেশবান্ধব ও বিনোদনমুখী প্রকল্পে রূপান্তরের জন্য বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। কচুরীপানা ও আবর্জনা পরিস্কার করে জলাশয়ের দুধারে শাপলা লাগিয়ে ব্লিচিং পাউডার ফেলে পানি বিশুদ্ধ করে যে চারটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে সেগুলো ভেঙ্গে টিক্কারচর থেকে কাপ্তানবাজার পর্যন্ত ইঞ্জিন নৌকা চালু করে যোগাযোগ ও নৌভ্রমণ শুরু করা যাবে।

 

 

দুপার পাক্কা করে পাশ দিয়ে ম্যানহাইট পিভিসি পাইপ দিয়ে কনসিল্ড ড্রেনেজ চালু করে টিক্কাচরের দিকে দুপারে দুটি ইটিপি স্থাপন করে ড্রেনের পানি পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে। সকল বাড়ীর সেনিটারি পাইপ লিকপ্রুফ পদ্ধতিতে ড্রেনে সংযুক্ত করতে হবে।

Concealed drain এ সকল sanitary pipe leak proof অবস্থায় ঢুকবে। চঠঈ পাইপের যুক্তিসংগত দুরত্বে  stainless steel দিয়ে পুরা পাইপ ঘুরে শক্ত দরজা লিক প্রুফ করে তৈরি করলে পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রবেশ করে পরিস্কার করতে পারবে, তবে PVC পাইপে পলিথিন বা ময়লা আটকায় না বলে সারা পৃথিবীতে PVC পাইপ দিয়ে ম্যানহাইট ড্রেইন করে পরিচ্ছন্নতা ও জলাবদ্ধতা থেকে শহরকে রক্ষা করা হচ্ছে। ম্যানহাইট PVC পাইপ জঋখ কে বললেই তৈরি করে দিতে পারে। বর্তমান পদ্ধতিতে যেভাবে শহরে ড্রেন তৈরি হয়েছে সেভাবে পুরাতন গোমতী পাড়ে ড্রেন করলে শুধু অর্থই অপচয় হবে এবং ৫ বছরের মধ্যেই তা ব্লক বা ধ্বংস হয়ে যাবে অথচ PVC পাইপ দিয়ে করলে তা হবে কমপক্ষে ১০০ বছর স্থায়ী এবং স্বাস্থ্যবান্ধব। এতে পাক্কা ড্রেনের চেয়ে খরচও কম হবে এবং নগরবাসীর নাকেও কোন দুর্গন্ধ লাগবে না।

কনসিল্ড ড্রেনের ওয়াকওয়ে এবং উপরে প্লাইওভার তৈরি করে যে চারটি রাস্তা ভাঙ্গা হবে সে চারটি স্থানে ব্রিজ দিয়ে প্লাইওভার কানেক্ট করে টিক্কার চরের কাছে আমির দিঘির পাড়ে নিয়ে অথবা তেলিকোনা চৌরাস্তায় নিয়ে ফ্লাইওভারের ইতি টানতে হবে। ওয়াকওয়ের অপর পার্শ্বে ওয়াষ্টেইজ বাসকেট তিন কম্পার্টমেন্টে (১। পচনশীল, ২। পলিথিন ও প্লাষ্টিক, ৩। ধারালো ও টিনজাতীয়) বর্জ্য জমানোর ব্যবস্থা করে ১নং বর্জ্য দিয়ে বিদ্যুৎ / সার তৈরি ২নং বর্জ্য রিসাইকেলের ব্যবস্থা ও ৩নং বর্জ্য ভাঙ্গারীর নিকট বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।

 

ওয়াকওয়ের দুপার্শ্বে বৃক্ষ ও পুস্পরাজির সমাহার ঘটাতে হবে। তবেই হবে পুরাতন গোমতী স্বাস্থ্যকর পরিচ্ছন্ন ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য লোভনীয়। টেকসই প্রযুক্তি অবলম্বন করে সামগ্রীক কাজকর্ম সুসম্পন্ন করে দীর্ঘসময়ের জন্য পরিবেশের উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রমান করতে হবে যে এ অঞ্চলটি প্রাচীন কাল থেকেই সুসভ্য বলে খ্যাতি অর্জন করেছিল। প্রযুক্তি ও প্রকৃতির সমন্বয় ঘটাতে প্রয়োজনে পরিবেশ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রকৌশলীর পরামর্শ নিয়ে সামগ্রীক কার্যাবলীতে নির্মাণশৈলীর স্বাক্ষর রাখা হোক।



লেখক:সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও
সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল।

 

আরো পড়ুন