গোখরার পরে রাসেল’স ভাইপার
বিষধর ৩০টি সাপের তালিকায় নেই
অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
চন্দ্রবোড়ার ইংরেজি নাম রাসেল’স ভাইপার। স্যার প্যাট্রিক রাসেল আমাদের এ উপমহাদেশের সাপের শ্রেনিবিন্যাসের কাজ করেন সতের শতকের শেষের দিকে। তিনিই প্রথম কাগজে কলমে এ অঞ্চলের অনেক সাপের পরিচিতি ও বিশ্লেষণ করেছিলেন। আঠারো শতকে সাপের চূড়ান্ত শ্রেণিবিন্যাসের সময় রাসেল সাহেবের সতীর্থ বিজ্ঞানীরা তাঁর নাম জুড়ে দেয় এ সাপটির সঙ্গে। সেই থেকে চন্দ্রবোড়া হয়ে যায় রাসেলস ভাইপার।
বলা হয় এটা পৃথিবীর পঞ্চম বিষধর সাপ। কথাটা সঠিক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক রেটিং এ এটা মারাত্মক প্রথম ৩০টি সাপের মধ্যেও নাই। বরং এটির অবস্থান আমাদের দেশের গোখরা সাপের পরে। গোখরা সাপ কামড়ালে চিকিৎসা না নিলে গড়ে ৮ ঘন্টা পর, কেউটে সাপের ক্ষেত্রে গড়ে ১৮ ঘন্টা পর ও চন্দ্রবোড়া বা রাসেল’স ভাইপার কামড়ের পর গড়ে ৭২ ঘন্টা বা তিনদিন পরে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে রোগীর অন্য কোন অসুস্থতা না থাকলে ৭২ ঘন্টার আগে রোগী সহজে মারা যায় না। বাংলাদেশে এ সাপের কামড়ের পর ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড আছে।
এক সময় বিলুপ্ত ঘোষণা করা সাপটির ছোবলের কথা ২০১৩ সালে জানা যায় রাজশাহীতে। বরেন্দ্র অঞ্চলে একসময় দেখা যাওয়া সাপটি এরপর ছড়িয়ে পড়ে বিশেষ করে পদ্মা অববাহিকায়। গত এক বছর রাজশাহী অঞ্চল ছাড়াও মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ ২৬টি থেকে ২৭টি জেলায় এ সাপের উপদ্রব দেখা দিয়েছে। সব জায়গায় কৃষিজমি বা চরাঞ্চলে দেখা দিলেও দ্বীপ জেলা ভোলায় কৃষিজমির পাশাপাশি খেলার মাঠ এমনটি ঘরের ভেতরেও সাপ দেখে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলেছে, “রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাতারু হওয়ায় নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। তাই সকলকে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য অনুরোধ জানানো হল”।
সাপের কামড় এড়াতে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলেছে,
১। যেসব এলাকায় রাসেলস ভাইপার দেখা গিয়েছে, সেসব এলাকায় চলাচলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন
২। লম্বা ঘাস, ঝোপ-ঝাড়, কৃষি এলাকায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকুন, গর্তের মধ্যে হাত পা ঢুকাবেন না
৩। সংশ্লিষ্ট এলাকায় কাজ করার সময় বুট ও লম্বা প্যান্ট পরিধান করুন
৪। রাতে চলাচলের সময় অবশ্যই টর্চ লাইট ব্যবহার করুন
৫। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার ও আবর্জনামুক্ত রাখুন
৬। পতিত গাছ, জ¦ালানি লাকড়ি, খড় সরানোর সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন
৭। সাপ দেখলে তা ধরা বা মারা চেষ্টা করবেন না, প্রয়োজনে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ নম্বরে কল করুন বা নিকটস্থ বন বিভাগের অফিসকে অবহিত করুন
সাপে কামড় দিলে যাহা করণীয় :
১। দংশিত অঙ্গ নড়াচড়া করা যাবে না, হাত বা পায়ের নড়াচড়ায় মাংশপেশীর সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া করতে পারে
২। আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে হবে অথবা ভিজা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছতে হবে
৩। ঘড়ি বা আলংকার বা তাবিজ, তাগী ইত্যাদি থাকলে খুলে ফেলুন
৪। দংশিত স্থান কাটবেন না, সুঁই ফোটাবেন না কিংবা কোন প্রকার প্রলেপ লাগাবেন না বা অন্য কিছু প্রয়োগ করবেন না
৫। সাপে কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না
৬। যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যান
৭। আতঙ্কিত হবেন না, রাসেলস ভাইপারের বিষ প্রতিষেধক বা এন্টিভেনম নিকটস্থ সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
সাপের কামড় বা সর্প দংশনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোগীকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া। অনতিবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে এক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। সর্পদংশনের বিষয়ে জনগনকে সচেতন করা খুবই জরুরী। রোগীকে হাসপাতালে আনতে যেন দেরি না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি উদ্বেগজনক হলেও এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষের সঙ্গে এ সাপের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ সাপ সাধারণত নিচু ভূমির ঘাসবন, ঝোপজঙ্গল, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকায় বাস করে এবং মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে। সাপটি মেটে রঙ্গের হওয়ায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে গেলে সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করে। তাই সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
সাপ নিধন না করে প্রাকৃতিকভাবে ভারসাম্য রক্ষার উপায়ও বাতলে দিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে “বেজি, গুঁইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বন বিরাল, মেছো বিড়াল, তিলা নাগ ঈগল, সারস, মদন টাক এবং কিছু প্রজাতির সাপ রাসেলস ভাইপার খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ রাখে।” এসব বন্যপ্রাণীকে মানুষ নির্বিচারে হত্যার কারণে প্রকৃতিতে রাসেলস ভাইপার বেড়ে যাচ্ছে। তাই বনপ্রাণী দেখলেই অকারণে তা হত্যা, এদের আবাসস্থল ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকুন। মনে রাখতে হবে, সাপ শুধু ইঁদুর খেয়ে আমাদের উপকার করে না, তার বিষও অনেক ঔষধের কাঁচামাল, হৃদরোগ, স্ট্রোক, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী, এমনকি ব্যথানাশক নানাহ ঔষধ তৈরিতে সাপের বিষ ব্যবহার করা হয়। কোথাও কোথাও জনপ্রতিনিধিরা সাপ মারার জন্য নগদ অর্থ পুরষ্কার ঘোষণা করেছেন। এটাকে পরিবেশের ভাষায় অপরাধ হিসেবেই গণ্য করতে হবে।
লেখক:সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।