‘চিঠির উত্তর দিসরে বন্ধু যদি মনে লয়’

 

ব্যক্তিগত চিঠি কমলেও সেবা বাড়ার দাবি ডাক বিভাগের

সাইফুল ইসলাম সুমন।।
‘চিঠির উত্তর দিসরে বন্ধু যদি মনে লয়।’ ‘চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাতে।’ চিঠি নিয়ে কত কবিতা আর গান। সেই চিঠি প্রায় হারিয়ে গেছে।
নব্বই দশকে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। চিঠির অপেক্ষায় বসে থাকতেন প্রিয়জনরা। সেই চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যম ছিল ডাকঘরের ‘ডাকবাক্স’। হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সেই ‘ডাকবাক্স’। ব্যক্তিগত চিঠির গুরুত্ব কমে যাওয়ায় আগের মতো ডাক অফিসে লোকজনের আনাগোনা দেখা যায় না। বর্তমানে মেসেঞ্জার, ইমু, ওয়াটস্অ্যাপ ও ই-মেইলের মাধ্যমে নিজের মনের অভিব্যক্তি অন্যের কাছে প্রকাশ করা যায়। কথা বলতে চাইলে তো মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছবি দেখে কথা বলতে পারছেন।
কুমিল্লা সদর উজেলার শিমপুর উপ ডাকঘরের সাব পোস্ট মাস্টার নুরুল ইসলাম জানান, আগে তিনি দিনে ১০০ থেকে ১৫০ টি ব্যক্তিগত ও অন্যান্য চিঠি বিলি করতেন। চিঠির জন্য অধির আগ্রহে বসে থাকতেন স্বজনরা। কোন কোন স্বজন তো প্রতিদিনই তাকে জিজ্ঞেস করতেন ওনার নামে চিঠি এসেছে কিনা। বর্তমানে ব্যক্তিগত চিঠি আদান প্রদান না হলেও আদালত, ব্যাংক ও বিভিন্ন এনজিও’র চিঠিগুলো প্রতিনিয়তই আসছে।
বেশির ভাগ ডাকঘরের ডাকবাক্স ঝরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কারণ বর্তমানে ডাকবাক্সে গ্রাহক চিঠি এখন আর রাখেন না। যদিও জরুরি কোন চিঠি হয় তাহলে গ্রাহক ডাকঘরে এসে সরাসরি জমা দিয়ে যান।
এদিকে সরকারি বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞপ্তি ডাকঘর থেকে চাকরি প্রত্যাশীরা সংগ্রহ করতেন কিন্তু চাকরির বিজ্ঞপ্তি অনলাইন মাধ্যম হওয়ায় ডাকঘরে আর চাকরি প্রত্যাশীরা ভিড় করেন না।
হারিয়ে যাওয়া ডাকবাক্স নতুন প্রজন্মকে জানান দিতে কুমিল্লা জাদুঘরে সংরক্ষণ করেছেন, জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল আবেদীন। তিনি জানান, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে বর্তমানে মানুষ চিঠি লিখে না। আগে ডাকবাক্সে চিঠি রাখা হত, তা বর্তমান প্রজন্ম জানেই না। ডাকবাক্স কি এটা অনেকে চিনে না। হারানো ঐতিহ্যকে ধারণ করতে ও বর্তমান প্রজন্মকে ডাকবাক্স সম্পর্কে জানান দিতে মূলত এ ডাকবাক্সটি সংরক্ষণ করা হয়েছে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আবু জাফর খান বলেন, বর্তমানে চিঠির যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে মোবাইল ফোন ও ই-মেইল আসার কারণে। আগে আমরা চিঠির উপর নির্ভরশীল ছিলাম। ভার্সিটিতে পড়াকালীন চিঠির মাধ্যমেই বাবা মায়ের খবর নেয়া হত। একটি চিঠির জন্য অন্তত ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হত।
তিনি বলেন, গ্রামের লোকজন আপনজনদের কাছে চিঠি পাঠানোর জন্য আমাকে দিয়ে চিঠি লিখাতো। আবার চিঠি আসলে আমাকে দিয়ে পড়াতো।
কুমিল্লা ডাকঘরের পোস্টাল অপারেটর দীনেশ চন্দ্র দাস জানান, চিঠি বিলি করতে গিয়ে কিছু কিছু জায়গায় প্রতিবন্ধকতার শিকার হোন। কারণ চিঠিতে অস্পষ্ট নাম ও ঠিকানা দেয়া হয়, যা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়।
এদিকে বিকাশ, রকেট ও অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা আদান প্রদান করলে হাজারে ২০ টাকা দিতে হয় কিন্তু ডাক বিভাগের মাধ্যমে মানি অর্ডার করলে হাজারে ১০ টাকা দিতে হয়। এতে গ্রাহক লাভবান হচ্ছেন।
কুমিল্লা ডাকঘরের সহকারী পোস্ট মাস্টার (মেইল) মো. ইউনুছ সরকার জানান, আগের তুলনায় আমাদের ব্যস্ততা দ্বিগুণ বেড়েছে। আগে আগে তো চিঠি আর পার্সেলের কাজ ছিল কিন্তু বর্তমানে আমাদের চতুর্মুখী কাজ করতে হচ্ছে।
ভোরে কুমিল্লা রেল স্টেশন থেকে আরএমএস থেকে ডাক সংগ্রহ করে কুমিল্লা ডাকঘরে এনে বাছাই করে এলাকা ভিত্তিক চিঠি ও পার্সেল বণ্টন করে গ্রাহকের কাছে দিনে দিনে পৌছিয়ে দেয়া হয়।
কুমিল্লা ডাকঘরের সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের চিঠি ও অন্যান্য মালামাল আদান প্রদানের বিশ্বস্ত মাধ্যমই হল ডাক বিভাগ। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার খাতাপত্র ডাকঘরের মাধ্যমেই আদান প্রদান করা হয়।
কুরিয়ার সার্ভিস দ্রুত তাদের সেবা দিয়ে সেক্ষেত্রে ডাক বিভাগ পিছিয়ে কেন? এ বিষয়ে তিনি বলেন, কুরিয়ার সার্ভিস শুধুমাত্র শহর টু শহরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে কিন্তু ডাকঘরের কার্যক্রম একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত। কুরিয়ারে চিঠি কিংবা পার্সেল আসলে তাদের অফিসে গিয়ে তা গ্রাহকদের সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু ডাক বিভাগের চিঠি বিলিকারকরা গ্রাহকের কাছে গিয়ে পৌছে দেন।
কুমিল্লা বিভাগের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম বলেন, ডাক বিভাগ গ্রাহকের ডাক পরিষেবা প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চিঠি ও পার্সেল আদান প্রদানের পাশাপাশি বর্তমানে ডাক বিভাগ মানি অর্ডার, ডাক জীবন বীমাসহ বুক পোস্ট (বুক প্যাকেট ও প্যাটার্ন প্যাকেট), রেজিস্টার্ড সংবাদপত্র, মানি অর্ডার সেবা, এপ্রেস সেবা (জিইপি ও ইএমএস), ই-পোস্ট এবং ইন্টেল পোস্ট সেবা প্রদান করছে। এতে গ্রাহক লাভবান হচ্ছে।