ছোঁয়া রেখো, ক্ষত নয়: কর্পোরেট দুনিয়ার মহাকাব্য

 

inside post

 মনোয়ার হোসেন রতন।।

এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে প্রতিদিনই এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলে—চাকরির প্রাপ্তি আর জীবনের মানে, পেশাদারিত্বের মুখোশ আর অন্তর্গত অনুভবের টানাপোড়েন। কর্পোরেট দুনিয়ার ঝলমলে কাচঘেরা ঘরগুলোয়, যেখানে আলো ঝলমল, সেখানেই জমে থাকে এক একটি না বলা কাহিনি। মানুষ এখানে আর মানুষ থাকে না—হয়ে ওঠে একটি পরিসংখ্যান, একটুখানি ফাইল, বা একটি আইডি নম্বর।

তিন দশকের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি—বিক্রয় ও বিপণন পেশা আসলে এক হৃদয়ভাঙা কাব্য, যেখানে প্রতিটি সকালে উঠে একজন কর্মী তার পরিবার, স্বপ্ন আর আত্মসম্মান কাঁধে করে বেরিয়ে পড়ে। সে শুধু পণ্য নয়—বহন করে তার সন্তানের হাসি, স্ত্রীর অপেক্ষা, বাবার দোয়া আর নিজের আত্মার যুদ্ধ।

তার প্রতিটি ক্লায়েন্ট ফলোআপে থাকে এক অদৃশ্য আশা—আজ হয়তো কেউ তার কথা শুনবে, একটু সহানুভূতি দেখাবে, শুধু সংখ্যা নয়, মানুষ হিসেবে তাকে দেখবে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই সে ফিরে আসে নিঃশব্দে—তার কণ্ঠে জমে থাকে না বলা অভিমান, তার চোখে জমে ওঠে ব্যর্থতার ধোঁয়া।

কর্পোরেট জীবনের এক নিঃশ্বাসে জমে থাকে অনেক বিষ—অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, প্রাপ্য স্বীকৃতির অভাব, ক্ষমতার দম্ভ, বেনামে কাঁটা ছোড়া। একজন তরুণ কর্মীকে শুধুমাত্র ‘টার্গেট মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, একজন নারী সহকর্মীকে রূপে ও আচরণে মাপা হয়; অথচ তারা উভয়েই মানুষ—তাদেরও স্বপ্ন আছে, বেদনা আছে।

প্রতিষ্ঠানের কৃতিত্ব যেখানে চলে যায় শীর্ষ ব্যবস্থাপনায়, ব্যর্থতার সমস্ত ভার তখন চাপিয়ে দেওয়া হয় মাঠের কর্মীর হৃদয়ে। কেউ জানতে চায় না—সেই হৃদয় প্রতিদিন কতবার ফেটে যায়, কত অপমান মুখ বুঁজে সহ্য করে। একজন কর্মী যখন প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যায়, তখন তার বিদায় যেন হয় নির্লিপ্ত, ব্যবস্থাপনামূলক—যেখানে নেই কোনো চোখে চোখ রেখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি—সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। কিছু মানুষ এখনো আছেন, যারা রেখে যেতে চান একটুখানি নরম ছোঁয়া। একজন সিনিয়র যদি হয় মেন্টর, একজন বস যদি হয় পথপ্রদর্শক, একজন সহকর্মী যদি হয় বন্ধুর মতো, তাহলে কর্পোরেট জীবন হয়ে ওঠে মানবিক এক অধ্যায়।

আমরা ভুলে যাই, আমরা প্রতিদিন কারও না কারও জীবনে ছাপ রেখে যাই। সেই ছোঁয়া যেন হয় আশ্রয়দাতা—not a scar, but a spark. আমরা যদি অন্যের জীবনে সাহস রেখে যেতে পারি, তবে সেই সাহস থেকেই জন্ম নেবে নতুন আস্থা, নতুন জীবনবোধ।

প্রতিটি অফিস হোক একটি জীবন্ত বিশ্ববিদ্যালয়—যেখানে শেখানো হবে শ্রদ্ধা, প্রশিক্ষণ যেন না হয় কেবল টার্গেট পূরণের; বরং মানবিক সহমর্মিতা, যা একজন কর্মীকে তার পেশার গর্ব অনুভব করাবে। প্রমোশন হোক শুধু বিক্রয়ের সংখ্যায় নয়—হোক নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সহানুভূতির যোগফলে।

আমি চাই, বিদায়ী কর্মীর দিকে তাকিয়ে বস বলুন—”তুমি আমাদের ইতিহাসের এক অনিবার্য অধ্যায়।”

আমরা যারা কর্পোরেট কাব্য রচনা করছি প্রতিদিন, আমাদের কবিতা যেন হয় ঘামে লেখা—কিন্তু সেই কবিতার ছন্দ হোক মানবিকতার সুরে বাঁধা। কারণ, একজন সেলস এক্সিকিউটিভ যখন হাসিমুখে একজন ক্লায়েন্টের দরজায় দাঁড়ায়, সে কেবল অফার নয়—ভরসা, আত্মবিশ্বাস আর জীবনের বার্তা নিয়ে আসে। তার হৃদয় যদি ভেঙে যায়, প্রতিষ্ঠানও ভেঙে পড়ে—ধীরে, নীরবে, অবধারিতভাবে।

এ লেখাটি শুধু বিক্রয় পেশার নয়—সব পেশার মানুষের জন্য। প্রত্যেক অফিস যেন হয় একটুখানি মমতা, সামান্য সহানুভূতি আর অপার মানবিকতার আশ্রয়। যেখানে লাভের পাশে থাকবে হৃদয়, আর স্মৃতির গভীরে থাকবে কেবল ছোঁয়া—ক্ষত নয়।

এ কেবল কোনো কোম্পানির বিবরণ নয়—এ এক জাতির মনস্তত্ত্ব, যেখানে ভালোবাসার অনুপস্থিতিতে জন্ম নেয় অবিশ্বাস, অবসাদ, এবং এক শুষ্ক অফিস সংস্কৃতি। আমরা যদি পরিবারে ভালোবাসা চাই, রাষ্ট্রে ন্যায় চাই, তবে কর্পোরেট জীবনেও চাই হৃদয়ের ছোঁয়া—যা কর্মীর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেয়।

এসো বন্ধু, আমরা এমন এক কর্পোরেট সংস্কৃতি গড়ে তুলি, যেখানে শ্রমিক শুধু শ্রম দেয় না—সন্মানও পায়। যেখানে নারীর হাসি নিরাপদ, তরুণের স্বপ্ন সুরক্ষিত, আর প্রবীণের অভিজ্ঞতা সম্মানিত।

এসো লিখি এক নতুন মহাকাব্য—যেখানে কেবল Excel Sheet নয়, হৃদয়ের ভাষাও মূল্য পায়। যেখানে মুনাফা শুধু সংখ্যায় নয়—মানুষে, মমতায়, মানসিকতায়।

এ হোক কর্পোরেট দুনিয়ার নতুন মহাকাব্য—মানবিকতার এক অদম্য অনুরণন। এমন এক ইতিহাস, যেখানে প্রত্যেক ছোঁয়া হয়ে উঠবে প্রেরণা। আর কোনো কর্মী চোখের জল গোপন করে নয়—গর্ব নিয়ে বলবে, ”
আমি একজন কর্পোরেট যোদ্ধা, আমারও একটা কবিতা আছে, আমিও মানুষ।”

আরো পড়ুন