জীবন বনাম জীবিকা: অনন্ত দ্বন্দ্বের অনুপম আখ্যান


মনোয়ার হোসেন রতন।।
“যার বাঁচার জন্য একটি কারণ আছে, সে যে কোনো কষ্ট সহ্য করতে পারে।”— ফ্রিডরিখ নিটশে
জীবন—এক কবিতা, জীবিকা—এক প্রক্রিয়া। একদিকে মন, অনুভব, প্রেম, প্রকৃতি, অন্যদিকে হিসাব, লক্ষ্য, আয়-ব্যয়, নিরাপত্তা। এ দুইয়ের মাঝে বিরাজ করে এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব কেবল ব্যক্তির ভিতরেই নয়, সমাজ, সভ্যতা ও সময়ের গভীর স্তর জুড়েই বিস্তৃত।
আমরা সবাই যেন জীবিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে একদিন জীবনের সুর হারিয়ে ফেলি। প্রাত্যহিক দৌড়ঝাঁপের মাঝে কোথাও যেন ভুলে যাই—আমরা কেন বাঁচি? কীসের জন্য এ আয়, এ অর্জন, এ প্রতিযোগিতা?
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, ‘যে জীবন পরীক্ষা করা হয়নি, সে জীবন বাঁচার যোগ্য নয়।’ আজকের এ যান্ত্রিক সমাজে আমাদের জীবন আর পরীক্ষা নয়—শুধুই প্রোডাক্টিভিটি, পারফরমেন্স, টার্গেট পূরণ। জীবনের প্রতিটি সকাল শুরু হয় এক দৌড়ের প্রস্তুতি দিয়ে, রাত নামে ক্লান্তির ছায়ায়। প্রেম, প্রকৃতি, সাহিত্যের ছোঁয়া—এ সব যেন আজ অলীক বিলাস।
একটা সময় আমরা ভাবতাম—জীবিকা জীবনকে সুন্দর করবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, জীবিকা আমাদের এমনভাবে গ্রাস করেছে যে, জীবনটাই হয়ে গেছে এক হিসাবের খাতা। সেই খাতায় নেই অনুভব, নেই করুণা, নেই আত্মিক প্রশান্তির ছায়াপাত। ‘অনেকে এমন অর্থ ব্যয় করে যা তারা উপার্জনই করেনি, এমন জিনিস কেনে যা তারা চায় না, এমন মানুষকে প্রভাবিত করতে চায় যাদের তারা পছন্দও করে না।”— উইল রজার্স
আজ সমাজ সফলতা মাপে জীবিকার ভিত্তিতে—মাসিক আয়, ফ্ল্যাট, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স, বিদেশ সফর। কিন্তু কেউ বোঝে না কারো নিঃশব্দ কান্না, নিঃস্ব সম্পর্ক, নিঃশেষ হওয়া ‘ভেতরের আমি’কে।
প্রেমিক হারায় কবিতার স্বাদে, কবি হারায় চাকরির বাজারে, প্রকৃতি হারায় নগরের কংক্রিটে। জীবন আর জীবিকার এ সংঘাতে হারায় আত্মা, জয় পায় শূন্যতা। “জীবিকা গড়তে এত ব্যস্ত হয়ে যেও না যে জীবন গড়া ভুলে যাও।”— ডলি পার্টন
তবুও সত্য হলো—জীবিকা বাদ দেওয়া যায় না। কারণ তা আমাদের বেঁচে থাকার উপকরণ। কিন্তু সেই বেঁচে থাকা অর্থহীন যদি তাতে না থাকে জীবনের উষ্ণতা, ভালোবাসা, চেতনার আলোর ছোঁয়া। “সফল মানুষ না হয়ে, মূল্যবান মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো।”— আলবার্ট আইনস্টাইন
এ যুগে সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার—ভারসাম্য। যেখানে জীবিকা আমাদের প্রয়োজন মেটাবে, আর জীবন আমাদের অর্থ দেবে, বেঁচে থাকার আসল মানে। এ ভারসাম্য না থাকলে মানুষ হয়ে উঠে কেবল একটি চাকরি-বাহিত যন্ত্র। এমন যন্ত্র, যেটি কাজ করে, হাসে না। বাঁচে, ভালোবাসে না।
জীবন আর জীবিকার এ টানাপোড়েনে শেষ প্রশ্ন রয়ে যায়-
আমি কি কেবল বেঁচে ছিলাম, না সত্যিকারের জীবন ছুঁয়ে দেখেছিলাম? এ প্রশ্ন আমার, তোমার, আমাদের সকলের। জীবন কেবল রুটিন নয়, এটি এক অনুভব, এক সূর্যাস্তের লাল আভা, শিশির ভেজা ঘাস, প্রেমিকার চিঠি, মায়ের দোয়া।
জীবিকা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, কিন্তু জীবনই আমাদের মানুষ করে তোলে। জীবন ছাড়া জীবিকা শুধুই এক শূন্য খোলস।
তাই, দৌড় থামিয়ে একবার অন্তত দাঁড়াই—জীবনের দিকে তাকাই, দেখি, সে এখনো কি আমার অপেক্ষায়—জীবনটাকে একবার ছুঁয়ে দেখবে বলে।