নীরব ছায়ার ঋণ


মনোয়ার হোসেন রতন ।।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক চিরন্তন। এ সম্পর্কের অন্যতম নিঃশব্দ রূপ হল বৃক্ষ। তারা কথা বলে না, অভিযোগ করে না, প্রতিদান চায় না; তবু দিনরাত, ঋতুপরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা কিংবা দুর্দান্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাঝেও বৃক্ষ আমাদের ছায়া, জীবনরস এবং বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে পাশে দাঁড়ায়। আজকের এই তপ্ত গ্রীষ্মে, যখন খরতাপে শহর ও গ্রাম উভয়ই হাঁসফাঁস করছে, তখন একটু করে ছায়া যেন জীবনদানের সমান। এই মুহূর্তে আমরা যাদের প্রতি চরম কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারি, তারা নিঃসন্দেহে বৃক্ষ।
গ্রীষ্মের রুক্ষ দুপুরে গ্রামের কোনো এক পল্লীবর্তী পথে বা শহরের কোনো ব্যস্ত মোড়ে, একটুখানি ছায়া খুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা পথিককে যে নিরব পরম স্নেহে আশ্রয় দেয়, তা একমাত্র বৃক্ষই পারে। প্রখর রোদের মধ্যেও মাথার উপর ঢালাও সবুজ ছাউনি বিছিয়ে রেখে যে বৃক্ষ আমাদের দম নিতে সাহায্য করে, সে শুধুই অক্সিজেন সরবরাহ করে না—সে বাঁচার অনুভব জাগায়।
আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, যান্ত্রিকতা আর শহরায়নের দাপটে মানুষ আজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৃক্ষের মহিমা ভুলে যেতে বসেছে। যেখানে বন উজাড় হচ্ছে, নতুন গাছ রোপণের চেয়ে কংক্রিটের দেয়াল গড়ে উঠছে বেশি, সেখানে প্রকৃতি আমাদের প্রতি বারবার কঠোর হয়ে উঠছে। খরায় কৃষি ধ্বংস, বাতাসে দূষণ, নদীতে জলশূন্যতা—সব কিছুর পেছনে কোথাও না কোথাও বৃক্ষহীনতা বা বৃক্ষবিনাশের সম্পর্ক স্পষ্ট।
একটি বৃক্ষ জন্ম নিতে সময় লাগে বছরের পর বছর, কিন্তু কেটে ফেলতে লাগে মাত্র কয়েক মিনিট। অথচ সেই বৃক্ষ এক জীবনে অসংখ্য প্রাণকে ছায়া দেয়, পাখিকে বাসা দেয়, শিশুকে খেলার ছায়াময় উঠোন দেয়, রোগীকে শীতল প্রশান্তি দেয়। কখনো সে হেমন্তের কুয়াশায় দাঁড়িয়ে জীর্ণ পল্লব ঝরিয়ে দেয় নিঃশব্দে, কখনো বর্ষায় ঝড়ের কবলে পড়েও ভেঙে না গিয়ে বুক পেতে রাখে আমাদের নিরাপত্তার জন্য। এই যে অবিরাম ভালোবাসা—এটা নিঃস্বার্থ, নিরব, কিন্তু গভীর।
আজ গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে পথচলা মানুষ, খেতের মাঝখানে চাষি, রাস্তার পাশে বসে থাকা বৃদ্ধা কিংবা মাঠে খেলতে থাকা শিশুরা একসাথে শুধুই এক আশ্রয় খোঁজে—একটি ছায়া। আর সেই ছায়া দেয় যে বৃক্ষ, সে যেন প্রকৃতির এক মহান তীর্থস্থান।
আমরা গাছের কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ তারা নিঃস্বার্থভাবে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। তাদের এ মহানুভবতাকে সম্মান জানিয়ে আমাদের উচিত—প্রতিটি কাটা বৃক্ষের বদলে নতুন বৃক্ষ রোপণ করা, শিশুদের ছায়ার মূল্য শেখানো এবং পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়া। প্রকৃতিকে ভালোবাসা মানে বৃক্ষকে ভালোবাসা, কারণ বৃক্ষই প্রকৃতির প্রাণ। গ্রীষ্মের দাবদাহে একটি ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে আমরা যেন এ একান্ত সত্যটি হৃদয়ে ধারণ করি—বেঁচে থাকার প্রতিটি নিঃশ্বাসে আমরা বৃক্ষের কাছে ঋণী।