বঙ্গবন্ধুকে দেখার সেই স্মৃতি

।। মিতা সফিনাজ ।।
বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি অনেক দূর থেকে,আসলে দেখেছি কিনা তাও স্বপ্ন, কারণ ১৯৭৪ সালে বন্যায় দুর্ভিক্ষ পীড়িত হাতিয়াবাসীকে দেখতে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন নোয়াখালী। সার্কিট হাউস মাঠে হেলিকপ্টার থেকে তিনি নামলেন। একে তো হেলিকপ্টারের পাখার ভোঁ ভোঁ আওয়াজ অন্যদিকে মানুষে মানুষে সয়লাব! কি করে দেখি? আমার নিজের স্কুল নোয়াখালী সরকারি বালিকা বিদ্যালয় আর নানার বাসার পূর্ব কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলাম ছোট খালার হাত ধরে। ঐঐ শব্দে তাকিয়ে হয়তো সেই মহামানবকে দেখেছি একনজর আর নয়তো আমার কল্পনা। তবে তিনি এসেছিলেন ঠিক, ঐতিহাসিক সত্য। আবার মনে পড়ে গেল স্বপ্ন মানুষকে, যিনি না এলে বাংলাদেশ হতোই না। অথচ আগস্টের মধ্যসময় সেই খাঁ খাঁ দুপুরে সুদূর চৌমুহনীতে ও দুঃসংবাদ বয়ে আনলো গরম বাতাসে, তাঁকে হত্যার খবর। আজকের প্রজন্ম বুঝবেনা নোয়াখালী আর ঢাকার দূরত্ব! কিন্তু সেসময়ের লোকজন জানে ক’টি বাস বা ট্রেন ছিল তখন। আমরা ঢাকা যেতাম, ফেনী-কুমিল্লা হয়ে। বাসটি ঢুকতো কুমিল্লার চকবাজারের ভেতর হয়ে মোগটুলী, পুলিশ লাইনের পরেই শাসনগাছা,আর ঢাকা অবধি পৌঁছাতে ৩টি ফেরী পার হতাম। মানে সকাল থেকে সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে রাজধানী শহরে। সেখানে বঙ্গবন্ধুও যেমন থাকতেন তেমনি কল্পনার রাজ্জাক-কবরী-ববিতারাও। বাসায় আব্বা-আম্মা তাড়াতাড়িই ফিরে এলেন স্কুল-কলেজ থেকে। গম্ভীর মুখ, আর দরজা বন্ধ করে চুপিচুপি রেডিও’র নব ঘুরানো দেখেই বুঝে গেছি, ঢাকায় মহাপ্রলয় ঘটে গেছে। রান্নাবান্না প্রায় বন্ধ,সবাই ফিসফাস করে এখবর সেখবর চালচালি করছে। এসব দৃশ্যের অনেক ছবিই এখন শুধু স্মৃতি। এরপরে ১০ বছর শেষে আমি ঢাবিতে ভর্তি হই, পরের বছর ছোটবোন। আমাদের সে সময় হলের চারদিকে বারান্দা আর মাঠ দিয়ে রাতে মিছিল করতাম চিৎকার করে,মিছিল শেষে খুব ভাব নিয়ে হলের ভেতরে ক্যান্টিনে বিস্কুটে ডুবিয়ে চা, কেমন গমগম করতো সব। অল্প কিছুদিনের মুখচোরা নোয়াখালীর গ্রাম থেকে আসা মিতাও হঠাৎ যেন বড় হয়ে গেল, বাঁধন (পরে শামসুন্নাহার হলের নির্বাচিত ভিপি,ব্রেস্ট ক্যান্সারে অকালে প্রয়াত, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের), নাজলী, পাপড়ী এমন অনেক সমশ্রেণীর বন্ধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্মী হয়ে গেলাম। বাইরে জগন্নাথ হলের মলয়, চিত্ত,অনুপ আর এসএম হলের আনসারী, কুদ্দুস, আতা, মহসীন বা সুর্যসেন হলের চান ভাই(অহিদুজ্জামান চান), অসী ভাই, কত নাম কত স্মৃতি! পোস্টার বিলি, হলে হলে প্রচারণা (ছেলে -মেয়ে উভয় হল)সব করতাম বুকের ভেতর লালিত স্বাধীন দেশের অধিকারের লড়াই,জয়বাংলা, বংগবন্ধু, ২১ শে ফেব্রয়ারিতে মধ্যরাতে শহীদ মিনারে যাওয়া যেন অতি দ্রুতই চলে যাচ্ছিল দিনগুলি। আর লেখাপড়াও চলছিল, মরার এরশাদের ঘন ঘন হল ভ্যাকেন্ট বা ক্লোসসাইনীডাই(নতুন শব্দ শিখেছি বিবিসি’র কল্যাণে) আমাদের সেশন ৪/৫ বছর পিছিয়ে দিলেও এখন সময়মত চাকুরি পাওয়া আর তার শেষের পথে হওয়ায় পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে জাবর কাটি, দেখ কি এক সময়ই না ছিল! আমরাই শেষবারের মত ডাকসু ইলেকশান করেছি ২৯ বছর আগে।
মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে আমাদের প্রিয় হাসিনা আপা (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) সে সময়ের ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের সাথে আমাদের বন্ধুদের একটা স্টলে আসেন। আমার খুব অনুরোধ তিনি একটা শার্ট কিনে মনসুর ভাইকে দেন। আর দাম দেন ২০০টাকা, এসময় একটি ছবি তোলে টিএসসিতে নামকরা পিয়ারু ভাই (তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি তুলেন সাথে সাথেই বিক্রি করে দিতেন)।স্বপ্নের মত লাগছিল, ঐ সময় শার্ট গুলো ২৫/৩০ টাকার বেশী দাম কেউ দেয়নি,আমরা ফ্রিতে এনেছিলাম এক বড় আপার হাসব্যান্ড এর গার্মেন্ট থেকে। এগুলো ছিল রপ্তানী অযোগ্য গুলিস্তান মার্কেটের জন্য রাখা। আমাদের কাছে ২০০টাকা মানে রীতিমতো বিস্ময়! আমাদের বাড়ি থেকে মাসিক খরচই তো ছিল ৫০০ টাকা ( ১৯৮৪-১৯৯০)। এরপরপরই বাকী ৮/১০ টি শার্ট খুব দ্রুত বিক্রি হয়ে গেল, খুব সামান্য সময়ে, আপা আমাদের উৎসাহিত করতে সাহায্য করেছেন এটা বুঝতে বুঝতেই সেদিনের বিক্রি শেষ। এখনও সেই ছবি আর স্মৃতি আমাকে ভালবাসায় মোহিত করে রেখেছে।
বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাসের অংশ উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা মোটামুটি বেশ সক্রিয় ছিলাম,নানা ঘটনা রটনার এগুলো আব্বার কানেও যেত, আর দূর কিসব কথা আব্বা,এসব বলে চলতাম। আমার আব্বা অবশ্য এ নিয়ে খুব বাধাও দেননি, কারণ ১৯৬৩-৬৪ সালে তিনিও যে এসএম হলের ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে নির্বাচনে জি,এস হয়েছিলেন,তবে এরশাদের পতনের পর আর অপেক্ষা করতে দেননি আব্বা-আম্মা। আমাদের বাহানা ছিল বিসিএস দেব। তাই ঢাকায় থাকার দরকার।কিন্তু ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ এ এরশাদের পতনের পরদিনই ফিরে আসতে হলো। পেছনে রইল প্রিয় ক্যাম্পাস,টিএসসি, ডা. মিলন হত্যা, খুনি এরশাদের বিরুদ্ধে মিছিল, মিটিং সব কিছুর সমাপ্তি দিয়ে মনযোগী ছাত্রী হয়ে একটি বেসরকারি কলেজে, (যদিও তখনও মাস্টার্সের রেজাল্ট হয়নি)। চাকুরির পাশাপাশি চতুর্দশ বিসিএসএ উত্তীর্ণ হয়ে একজীবনে মিতা ম্যাডাম হয়ে গেছি।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে যেহেতু শিক্ষক তাই আমার ছাত্রছাত্রীদের বলি, তারা যেন যতœ করে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী আর কারাগারে বঙ্গবন্ধু দুটি বইসহ তাঁর সম্পর্কে পড়ালেখা করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের চেনে, কিভাবে তার বিচার হয়েছিল। এই মুজিবর্ষকে ঘিরে অনেক আয়োজন হচ্ছে,সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ আয়োজন। এগুলো দেখলেও তারা অনুভব করতে পারে, বঙ্গবন্ধু কে! নতুন প্রজন্মের জন্য এটা অভাবিত সুযোগ। লেখক: ভাইস প্রিন্সিপাল,লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ।

inside post
আরো পড়ুন